মঙ্গলবার   ১৯ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৫ ১৪৩১   ১৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শাহনাজ রহমতুল্লাহকে নিয়ে কনকচাঁপার স্মৃতিচারণ

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৪:৫১ পিএম, ২৫ মার্চ ২০১৯ সোমবার

পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ। তার গান, তার স্মৃতি রয়ে গেছে কোটি কোটি মানুষের মনে। তার শোকে কাঁদছে গানের আঙিনা, কাঁদছেন গানের মানুষেরা।

শাহনাজ রহমতুল্লাহর স্নেহধন্য ছিলেন আরেক মধুকণ্ঠী গায়িকা কনকচাঁপা। তিনি প্রিয় শিল্পীর স্মরণে এক দীর্ঘ স্মৃতিচারণ করেছেন ফেসবুকে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ মরে গিয়ে জানিয়ে দিলেন ‘উনি ছিলেন, উনি আছেন, উনি থাকবেন এবং উনাকে ছাড়া উপমহাদেশের সংগীত জগত কতোটা অসম্পূর্ণ।’

 

কনকচাঁপা আরও লিখেছেন, ‘সত্যিই আমরা ভাগ্যবান যে শাহনাজ রহমতুল্লাহ একান্তই আমাদের ছিলেন। সুরসম্রাট আলাউদ্দিন আলী এবং শাহনাজ রহমতুল্লাহ মিলে যে অনবদ্য সৃষ্টির যৌথ অধ্যায় ছিলো তা সত্যি সত্যিই ভিষণ মৌলিক। তার গানের প্রক্ষেপণ, উপস্থাপন, তার কণ্ঠের ট্রিমেলো, রেজোন্যান্স, শব্দচয়ন, সর্বপরি তার বিশেষায়িত অন্যরকম কন্ঠ তার প্রতিটি গানকে অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে।

বেশির ভাগ গান কবিতা থেকে গান হয়ে ওঠে। কিন্তু আমার গবেষণা বলে উনার গান প্রথমে গান হয়ে জন্ম নিয়ে তারপর কবিতা হয়ে উড়ে উড়ে সাহিত্যে ছড়িয়ে যায়। যেমন ‘সেই চেনা মুখ কতদিন দেখিনি’- এই লাইনটি দিয়ে তার সুরের মাধুরীর উপর ভিত্তি করে একজন ঔপন্যাসিক একটি উপন্যাস লেখার প্লট পেয়ে যাবেন।

সেই পরিবেশ শাহনাজ আপা তার গানের অনুরণন দিয়ে তৈরি করে দিয়ে গেছেন হেলায়-অবহেলায়। অথচ এগুলো উনি জেনেশুনে সুনিপুণভাবে করেন নাই। তিনি গান গেয়েছেন অসম্ভব ভালবেসে এবং অতিরিক্ত অপেশাদার ভঙ্গিতে।

গানের জগতে প্রথম-দ্বিতীয় হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে কখনই সামিল হন নাই। নিজের এই বিশেষত্বকে তিনি কখনই সিরিয়াসলি নেন নাই। তারপরও যা গান গেয়েছেন একটা গানও মাটিতে পড়েনি। তা সারা দেশের গানপ্রিয় মানুষের হৃদয়ে ঢুকে স্থায়ীভাবে বসতি গড়েছে।

তার গাওয়া দেশের গানগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করার মত স্পর্ধা আমার নেই। সে গানগুলো কোনো মানবীর গাওয়া, এ ভাবতেই গাঁয়ে কাটা দেয়। তার দেশের গানগুলো শুনে আমি বোকা মেয়ে যখন তখন কাঁদি। আর প্রেমের গান?

তার গানে হয়তো আমার বাবাও প্রেমে পড়েছিলেন, আমার ছেলেও, হয়তো আমার নাতনীও একইভাবে প্রেমে পড়বে। শোনা যায় এমন শাব্দিক দীর্ঘশ্বাস না দিয়েও ভয়াবহ অন্তর্গত দীর্ঘনিঃশ্বাস তিনি অনায়াসেই গানে আনতেন। যা একজন বিরল শিল্পীর পারঙ্গম ক্ষমতা। আমি তার কন্ঠের চাইতেও এই আন্ডার ভয়েজের কারুকার্যময় দীর্ঘ নিঃশ্বাসের অন্ধভক্ত।

এজন্য যতবার আমি তাকে দেখেছি অটোমেটিক আমি কেঁদেছি। উনি তখন বলতেন এই মেয়ে, এই বোকা মেয়ে তুমি কাঁদো কেনো, তুমি আমার কাছে এসো!

ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি অন্যান্য সচেতন সাজানো গোছানো শিল্পীদের চেয়ে একদম আলাদা ছিলেন। স্বামী অন্তঃপ্রাণ মানুষটি শিশুর মত সরল ছিলেন। গল্পে বসলে অনেক কথাই গড়গড়িয়ে বলতেন এবং আমরা হাসলে রেগে গিয়ে বলতেন এই তোমরা হাসছো কেন! এই টেকনিক্যাল হিপোক্রেট জগতের অনেক কিছুই তার অজানা ছিল।

তার সাথে শেষ দেখা আমার ডলি ইকবাল আপার বাসায়। দুপুরের খাওয়া শেষ করে একসাথে আমি আর শাহনাজ আপা ডলি আপার বেডরুমে আসরের নামাজ আদায় করছিলাম। নামাজ শেষে উনি আমাকে ডাকলেন বললেন, ‘কনক, আমার কাছে আসো।’

আমি তার উদ্দেশ্য বুঝে ওনার জায়নামাজের পাশে বসতেই উনি আমার মাথায় হাত দিয়ে কন্যাসম স্নেহে দোয়া পড়ে ফুঁ দিলেন। আমি বরাবরের মতই বোকার মত অশ্রুসিক্ত হতেই আবার বকা, ‘এই মেয়ে, কাঁদবে না। তুমি আমার খুব আদরের জানোতো!’

হেসেখেলে গান ভালবেসে যেভাবে তিনি মুকুটহীন রানীর মতো এই দুনিয়ায় ছিলেন ঠিক তেমনি খেলাচ্ছলেই চলে গেলেন। ভাবখানা এমন যে খেলছিলেন, হঠাৎই কিছু একটা প্রয়োজনে ওপারে যাওয়ার দরকার পড়ায় মিনিট পাঁচেকের নোটিশে চলে গেলেন।

যাক, যার যাবার সে যাবেই। ধরে রাখার শক্তি কি আমাদের আছে! আমরা শুধু চাই আমাদের ‘মোর দেন নাইটিংগেল’ যেন সুখে থাকেন।

 

আল্লাহ, তুমি তাকে কবুল করে নাও।