সোমবার   ১৮ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৪ ১৪৩১   ১৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পুরির বর্নাঢ্য জীবন ও অধ্যায়ের শেষ যেভাবে

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ১১:০১ এএম, ৬ এপ্রিল ২০১৯ শনিবার

ওম পুরি। নাম শুনে বা ওপরের ছবি দেখে তাকে না চেনার কিছুই নেই। কারণ তিনি যাচ্ছেতাই অভিনেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন বলিউডের একজন অসম্ভাব্য অভিনেতা, যাকে দিয়ে অদ্ভুদ ধরণের কোন কিছু বানানোর কথা ভাবা হত সবসময়। এককথায় বলিউডে তিনি ছিলেন আইকনিক ও অভিজাত এক বুড়ো। সেখানে ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি দর্শকদের মাতিয়ে গেছেন নানা রূপে নানা গেট আপে। 

 

ক্যারিয়ার জীবনে ওম পুরি সব ধরণের সিনেমায় অভিনয় করেছেন। বলিউড, হলিউড, ব্রিটিশ-আমেরিকান সব ধরণের সিনেমাই তাকে পাওয়া গেছে। ভাল সিনেমা, মন্দ সিনেমা, তৃতীয় সারির দর্শকদের সিনেমা সব কিছুতে হাজির হয়েছিলেন তিনি। বস্তুত তিনি যে মানের অভিনেতা ছিলেন, সে মানের অভিনেতা এখন আর পাওয়া যায় না বললে চলে।

 

জন্ম ও শৈশব কাল: ওম পুরির সঠিক জন্ম তারিখটা এখনো কেউই জানে না। তবে তার জন্ম তারিখ নিয়ে মা শুধু বলেছিলেন, দশমীর দু’দিন বাদে তিনি পৃথিবীর মুখ দেখেন। ওই সময় পুরির পরিবার থাকতো পাঞ্জাবের আম্বালায়। তিনি প্রথম স্কুলে ভর্তি হন ১৯৫০ সালের ৯ মার্চ। এরপর পুরি যখন যখন মুম্বাই চলে আসেন তখন তিনি বলেন তার জন্ম তারিখ ১৮ অক্টোবর। কারণ তিনি নাকি ১৯৫০ সালের ক্যালেন্ডার ঘুটে দশমীর সময়টা জেনে নিয়েছিলেন ১৫ বা ১৬ অক্টোবর।

পুরির শৈশবটা কেটেছে অর্থাভাবে। ছোট বেলায় তাকে সংগ্রাম করতে হয়েছে প্রতিটা মুহূর্ত। তার বাবা রাজেশ পুরি চাকরি করতেন রেলওয়েতে। সে সময় তাদের পরিবার আরো বেশি অর্থাভাবে পতিত হয়। কারণ রেলওয়েতে থাকাকালীন একবার সিমেন্ট চুরির মামলায় বাবাকে জেলে যেতে হয়। ওই সময় পুরির বয়স ছয় কি সাত! ওই সময় তার পরিবারের থাকার জায়গাটাও ছিল না বললে ভুল হবে না। বাধ্য হয়ে একটা চায়ের দোকানে কাজ নিয়েছিলেন পুরি। কখনো ধাবায় কাজ করেছেন, কখনা রেলওয়েয় কয়লা বিক্রি করেছেন। শুধু মাত্র দু’মুঠো অন্নের জন্য!

 

তবে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার হলো, এত কিছুর পরও কখনো পড়াশোনা বন্ধ করেননি ওম পুরি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই ধরণের অভাব পড়াশুনায় একদিন দূর হবে। তাই প্রাথমিক শিক্ষার পরই তিনি যোগ দেন দিল্লীর ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামাতে। এখানে তার পরিচয় হয় নাসিরুদ্দিন শাহ’র সঙ্গে। ফলে দুজনের মধ্যে হয়ে ওঠে বন্ধুত্ব। কালক্রমে এই দুই বন্ধু মিলে একটা সময় রাজত্ব শুরু করেন সিনেমার দুনিয়ায়। 

মূলত উপমহাদেশের ইতিহাসসেরা অভিনেতাদের তালিকা করলে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি তাতে উঠে আসবে এই দুই সিংহ তারকার নাম। পুরি-নাসিরুদ্দিন দুজনই ছিলেন জাঁদরেল অভিনেতা। তাদের বন্ধুত্ব নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। শোনা গেছে, একদিন নাকি তারা দুজনে এক রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। ওই সময় নাসিরুদ্দিনের এক ব্যাচমেট (জাসপাল) এসে তার মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে প্রতিহত করতে উঠে দাঁড়ান পুরি। একপর্যায়ে জাসপাল সেখান থেকে চলে যান। 

 

ওইদিনটাই পুরি না থাকলে হয়তো হুমকির মুখে পড়তে হত নাসিরুদ্দিনকে। এরপর সে বন্ধু নাসিরুদ্দিনের অনুপ্রেরণায় পুরি পুনের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট অব ইন্ডিয়ায় ভর্তির ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। যদিওবা সেখানে ভর্তির জন্য পুরো নাকাল হতে হয়েছিল পুরিকে। একজন তাকে দেখে বলেছিলেন, তুমি দেখতে হিরোদের ধারে কাছে না, ভিলেন হিসেবে তোমাকে একদমই মানায় না, কমেডিয়ান হিসেবেও তুমি যাও না, ইন্ডাস্ট্রি তোমাকে দিয়ে কী করবে বুঝা আসছে না!

তবে, সে যাত্রায় শেষমেশ ঠিকে যান পুরি। পরে ইন্ডাস্ট্রিকে তিনি কী দিতে পেরেছেন কী দেননি সেটা সকলের জানা। পরপর দু’বছরই (১৯৮২ ও ১৯৮৩) সেরা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়ে যাওয়াতো আর চারটিখানি ব্যাপার নয়।

তবে শুরুর দিকে পুনের ফিল্ম ইন্সটিটিউটে প্রথম ক’টা দিন মানিয়ে নিতে বেশ কষ্ট হয় পুরির। কারণ, নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে এসেছিলেন তিনি। তাই তার হাতে একদমই টাকা-পয়সা থাকতো না বললে চলে। পরে স্টার হওয়ার পর তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ওই সময় আমার পরিবার এতটাই গরীব ছিল যে, ইন্সটিটিউটে পরে যাওয়ার মত ভাল একটা ভালো শার্টও আমার ছিল না!

এদিকে, ফিল্ম ইন্সটিটিউটে আসার পর পুরির রুমমেট যে ছিলেন, তার নাম শুনলে আবারো চমকে উঠবেন সকলে। তিনি হলেন বলিউডের বিখ্যাত পরিচালক ডেভিড ধাওয়ান। নিজের সিনেমার ঘরানার মত ধাওয়ান ওই সময়ও বেশ রসিক মানুষ ছিলেন, যা একেবারে সহ্য করতে পারতেন না পুরি। তাই তিনি বাধ্য হয়ে রুম পাল্টে দেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদনও করেছিলেন।

 

ফিল্ম ইন্সটিটিউটে থাকা অবস্থায় পুরি প্রায়ই টিউশন ফি দিতে পারতেন না। এই নিয়ে অনেকটা কষ্টের দিন কাটে তার। তবে হাস্যকর ব্যাপার ছিল, যখন তিনি খ্যাতিমান হয়ে গিয়েছিলেন, তখনো ইন্সটিটিউটের পক্ষ থেকে তাকে ২৮০ রুপি বাকি আছে বলে একটা নোটিশ পাঠানো হয়েছিল। তবে সেই দেনাটা তিনি পরিশোধ করেননি কারণ স্বয়ং পুনে ফিল্ম ইন্সটিউটিটে টিউশন ফি ‘বাকি’ রাখতে পারাটা তার কাছে রোমাঞ্চকর একটা ব্যাপার ছিল।

বড় পর্দায় পুরির আবির্ভাব হয় ১৯৭৬ সালে। ওই সময় মারাঠি ভাষায় তিনি একটি সিনেমায় অভিনয় করেন। যার নাম ছিল ‘ঘাসিরাম কোতওয়াল’। তবে ওম পুরির ক্যারিয়ারে সবচেয়ে স্মরণীয় সিনেমা নি:সন্দেহে ১৯৮২ সালের ‘অর্ধ সত্য’। প্রতাপশালী পুলিশ অফিসারের চরিত্রে তিনি দারুণ অভিনয় করে দর্শকের মনে স্থান করে নিয়েছিলেন। যদিও পরিচালক গোবিন্দ নিহালিনী প্রথমে ওই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রের জন্য চেয়েছিলেন অমিতাভ বচ্চনকে কিন্তু পরে শাহেনশাহ’র শিডিউল না মিলায় ওম পুরিকে নিয়ে কাজ করেন তিনি। পরে ওম পুরি ওই সিনেমায় কেবল পরিচালকের আস্থাই জিতেননি, জিতেছিলেন দর্শকদের মনও। সিনেমাটি ব্যবসায়িকভাবে দারুণ সাফল্য পায়।

তবে পুরির ক্যারিয়ারের আরেকটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল ‘গান্ধী’। হলিউডেও এই সিনেমাটি অস্কারের জন্য ১১টি বিভাগে মনোনয়ন পেয়ে আটটিতেই জেতে। আর এই সিনেমাটিতে অল্প কিছুক্ষণের জন্য ছিলেন পুরি। সে সময়টাই মানুষের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টে দেন তিনি। এই নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে পুরি বলেছিলেন, গান্ধীতে আমি দেড় মিনিটের মত স্ক্রিনে ছিলেন। তবে, এই ছোট্ট চরিত্রটা আমার পেশাদার জীবনে দারুণ ভূমিকা রাখে। কারণ অস্কারের অনুষ্ঠানে আমার অভিনয়ের দেড় মিনিটের ফুটেজটুকু দেখানো হয়েছিল। এটা ছিল আমার জন্য বিশাল সম্মানের।

মূলত ওম পুরি ছিলেন পরিশ্রমীক অভিনেতা, কারণ ছোটবেলায় তিনি ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন। যা তাকে আরো পারিশ্রমিক হতে সহায়তা করেছে। ১৯৯২ সালে ‘সিটি অব জয়’ সিনেমায় তিনি ছিলেন একজন রিকশাচালক। এই চরিত্র করার জন্য তিনি দু’জন রিকশাচালকের কাছে থেকে রিকশাচালনা শিখেছিলেন। ঢাকার রিকশা নয় কিন্তু, কলকাতার টানা রিকশা। এখানেই শেষ নয়, নিয়ম করে খালি পায়ে রাস্তায় দৌঁড়ানোও শুরু করেন। কারণ অধিকাংশ রিকশাচালকই তখন পায়ে স্যান্ডেল-ট্যান্ডেল পরার মত সামর্থ্যবান ছিলেন না।

এখানেই শেষ নয়, ওম পুরি তার জীবদ্দশায় মুম্বাইয়ের একটা অভিনয়ের স্কুলে ক্লাস নিতেন, অভিনয়ের শিক্ষক হিসেবে। আগেই বলেছি তিনি কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন। সেখানে তার শিক্ষার্থীদের জন্য উল্লেখযোগ্য ছিলেন, অনিল কাপুর ও গুলশান গ্রোভার। ১৯৯০ সালে পুরি ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মশ্রীতে ভূষিত হন। ২০০৪ সালে তিনি ব্রিটিশ সম্মাননা ‘অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’-এর সম্মানজনক অফিসারের মর্যাদা পান।

 

তবে পুরির প্রসঙ্গে একটা নির্ভুল তথ্য দিতে চায়। তা হলো, অনেকেই মনে করেন প্রয়াত কিংবদন্তিতুল্য অভিনেতা অমরেশ পুরির সঙ্গে তার পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। তবে এটা ভাবলে ভুল করবেন। কারণ পুরি ও অমরেশ পুরি কেউ কারো আত্নীয় নন। তাদের দু’জনের মধ্যে পারিবারিক কোনো সম্পর্কও নেই। কাকতালীয় ভাবে তারা দু’জন একই পদবীর অধিকারী।

 

 

বৈবাহিক জীবন: ১৯৯১ সালে পুরি বিয়ে করেন অভিনেতা অনু কাপুরের বোন সীমা কাপুরকে। যদিও সেই সংসার আট মাসের বেশি টেকেনি। এরপর ১৯৯২ সালে পুরি বিয়ে করেন সাংবাদিক নন্দিতা পুরিকে। এই দম্পতির ইশান নামের একটি ছেলেও রয়েছে। তবে সে দ্বিতীয় স্ত্রীর (নন্দিতা) সঙ্গে বিচ্ছেদ না হলেও শেষ দিকে আলাদা থাকতেন তারা। কারণ তাদের মধ্যে টানাপোড়েন ছিল। ২০০৯ সালে নন্দিতা প্রথম স্বামীর বায়োগ্রাফি লেখেন। ‘আনলাইকলি হিরো: দ্য স্টোরি অব পুরি’ বইটা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেপে যান পুরি। কারণ, সেখানে জীবনের আগের সম্পর্কগুলোর ব্যাপারে খোলামেলা লেখা হয়েছিল। আসলে পুরি কখনো চাননি তার অতীতের কোন জীবন সামনে আনতে। এরপরই দুজনের মনের অমিল হতে শুরু হয়। এখান থেকে মূলত তাদের আলাদা থাকা। 

এদিকে, ২০১৩ সালে এসে নন্দিতা তার স্বামী পুরির বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এনে আলাদা থাকার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হন। আদালত সেই অনুমতির আবেদন মঞ্জুরও করেন। এরপর থেকে শুরু হয় পুরির একাকী পথচলা। শেষ বয়সটাতে একদম ছন্নছাড়া জীবনযাপন করেছেন পুরি। কাজ ছাড়া বাকিটা সময় কখনো রান্না করতেন, কখনো বা বাগানে কাজ করতেন। 

 

এই ছিল পুরির শেষ জীবনের করুণ গল্প। হয়ত শেষ জীবনে সেবা পেলে আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতেন পুরি। হয়ত কষ্টের জীবন তাকে বেশীদিন টিকিয়ে রাখেনি। ২০১৭ সালের গোড়ায় হুট করেই তিনি চলে যান জীবন নদীর ওপারে। এর মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে যায় ভারতীয় সিনেমার একটি বর্নাঢ্য অধ্যায়ের। মূলত যে জায়গাটাই পুরি ছিলেন, সেটা অন্য কারো পক্ষে পূরণ করা অসম্ভব।