শুভ জন্মদিন ‘মহানায়িকা’
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০২:০৬ পিএম, ৬ এপ্রিল ২০১৯ শনিবার
সালটা ১৯৫২। ‘শেষ কোথায়’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্র অঙ্গনে পদার্পণ মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের। তবে নিরাসার বিষয় ছবিটি শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। পরবর্তীতে তার দ্বিতীয় ছবি ‘সাত নম্বর কয়েদী’ মুক্তি পায় ১৯৫৩ সালে। মুলত এই ছবির মাধ্যমেই রমা নামের মহানায়িকার আবির্ভাব। শুরুটা ‘শেষ কোথায়’ ছবির মাধ্যমে হলেও জনপ্রিয়তা পান আরেক মহানায়ক উত্তম কুমারের বিপরীতে অভিনয়ের মাধ্যমে। সেটা ছিল ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে অভিনয়। এই ছবিটি তুমুল সাড়া ফেলে দেয়। আজ ৬ এপ্রিল এ মহানায়িকার জন্মদিন।
১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল পাবনায় সুচিত্রা সেন জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন পরিবারের পঞ্চম সন্তান ও তৃতীয় কন্যা। পাবনা শহরেই ছিল তার শিক্ষাজীবন। এছাড়াও তার আরো একটি পরিচয় হচ্ছে তিনি কবি রজনীকান্ত সেনের নাতনী।
১৯৪৭ সালে বিশিষ্ট শিল্পপতি আদিনাথ সেনের পুত্র দিবানাথ সেনের সঙ্গে সুচিত্রা সেনের বিয়ে হয়। তাদের একমাত্র কন্যা মুনমুন সেনও একজন খ্যাতনামা অভিনেত্রী। এছাড়াও সুচিত্রার দুই নাতনী হলেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী রাইমা সেন ও রিয়া সেন।
সুচিত্রা সেন মূলত বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আর মহানায়ক উত্তম কুমারের বিপরীতে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। যা বক্স-অফিসে সাড়া ফেলে এবং উত্তম-সুচিত্রা জুটি উপহারের কারনে আজও স্মরনীয় হয়ে আছে। বাংলা ছবির এই অবিসংবাদিত জুটি যা পরবর্তী ২০ বছর ছিলেন আইকন স্বরূপ।
উত্তম-সুচিত্রা জুটি হিসেবে কাজ করেছেন প্রায় ২২ বছর। সম্পর্কটা ছিল খুব গভীর। সুচিত্রা উত্তমকে ডাকতেন ‘উতু’ এবং উত্তম সুচিত্রাকে ডাকতেন ‘রমা’ বলে। এ সম্পর্কের মধ্যেও মান-অভিমান, ঝগড়াঝাটি চলত। নানা কারণে দুইজন একসঙ্গে কাজ করেননি অনেকদিন। মাঝে দুইজনের ভুল বোঝাবুঝির কারণে উত্তম কুমার প্রযোজিত ‘সপ্তপদী’ ছবির শুটিং দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল।
একদিন বালিগঞ্জে সুচিত্রা সেনের বাড়িতে এক সন্ধ্যায় উত্তম অনেকটা আবেগের বশেই সুচিত্রাকে বলেছিলেন, রমা, তোমার সঙ্গে যদি আমার বিয়ে হতো। উত্তরে সুচিত্রা বলেছিলেন, একদিনও সেই বিয়ে টিকত না। তোমার আর আমার ব্যক্তিত্ব অত্যন্ত স্বতন্ত্র। আর খুব স্ট্রং। সেখানে সংঘাত হতোই। তার ওপর, তুমি চাইবে তোমার সাফল্য, আমি চাইব আমার। এ রকম দুজন বিয়ে করলে সে বিয়ে খুব বাজেভাবে ভেঙে যেত।ঠিক ওই সময় কলকাতার এক সাংবাদিক এ বিষয়টি নিয়ে একটি সিনে ম্যাগাজিনে লিখেছিলেন। আর উত্তম যেদিন মারা যান সেদিন মধ্যরাতে মালা হাতে তাকে শেষ অর্ঘ্য দিতে এসেছিলেন সুচিত্রা। উত্তম কুমার সম্পর্কে সুচিত্রার মূল্যায়ন ছিল ‘গ্রেট, গ্রেট আর্টিস্ট। তবু মনে হয় তাকে ঠিকমতো এক্সপ্লয়েট করা হয়নি।
চলচ্চিত্রে অভিনয়ের বাইরে ব্যক্তি জীবনেও প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে উত্তম-সুচিত্রার মধ্যে। ১৯৫৪ সালে একটি পোস্টার ঝড় তোলে উত্তম-সুচিত্রার সংসার জীবনে। ঝড় তোলা ওই পোস্টারে সুচিত্রার স্বাক্ষরসহ লেখা ছিল- আমাদের প্রণয়ের সাক্ষী হলো অগ্নিপরীক্ষা।সে সময় ভারতীয় পত্রিকাগুলোতে খবর প্রকাশিত হয়, সেই পোস্টার দেখে উত্তম কুমারের স্ত্রী গৌরিদেবী নাকি সারাদিন কেঁদেছিলেন। আর সুচিত্রাকেও সন্দেহ করতে শুরু করেন স্বামী দিবানাথ। অভিনয় ছেড়ে দিতেও চাপ দেন।
১৯৫৪ সালেই এ জুটির ৬টি ছবি দারুণ জনপ্রিয় হয়। অন্তত ১০টি ছবিতে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন দু’জনে। স্বাভাবিক কারণেই অভিনয় ছাড়তে রাজি হননি সুচিত্রা। ১৯৫৭ সালে উত্তম কুমার তার প্রযোজিত ‘হারানো সুর’ ছবিতে নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব দিলে সুচিত্রা বলেছিলেন, তোমার জন্য সব ছবির ডেট বাতিল করব।
একদিন সুচিত্রা সেনের বালিগঞ্জের বাসায় এক পার্টিতে দিবানাথের আক্রমণের মুখেও পড়তে হয় উত্তমকে। এর পর থেকেই দিবানাথের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে সুচিত্রার। এক সময় শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আলাদা থাকতে শুরু করেন দক্ষিণ কলকাতার নিউ আলিপুরে।
মহানায়িকার দীর্ঘদিনের বন্ধু চিত্রসাংবাদিক গোপালকৃষ্ণ রায় আর চিকিৎসক সুব্রত মৈত্র। এক সাক্ষাৎকারে তারা দু’জন বলেন, মহানায়িকার অন্তরাল রহস্য নিয়ে নানা রটনা আছে। তবে ছয় বছরের চিকিৎসাকালীন সম্পর্কে ডাক্তার সুব্রত মৈত্র জানতে পেরেছেন, গভীর আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন মহানায়িকা। তিনি রামকৃষ্ণের পরমভক্ত ছিলেন। গোপালকৃষ্ণ রায় এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, অন্তরালের রহস্য কী জানতে চেয়েছিলাম মহানায়িকার কাছে। সুচিত্রার উত্তরে বুঝতে পেরেছিলাম, শেষ ছবি ‘প্রণয়’ করার পর মনে হয়েছিল যে তিনি আর দিতে পারছেন না। দীর্ঘ মানসিক অবসাদে ভোগার পর বেলুড় মঠে মহারাজের কাছে বসে উপায় জানতে চেয়েছিলেন। তখন মহারাজ বলেছিলেন, লোভ করো না।
এরপর বহু পরিচালক-প্রযোজক স্ক্রিপ্ট নিয়ে গেছেন তার কাছে। মহানায়িকা মন দিয়ে স্ক্রিপ্ট পড়েছেন, পছন্দ না হওয়ায় ফিরিয়ে দিয়েছেন। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন আধ্যাত্মিকতায় তন্ময় হবেন। সেই থেকে তিনি আর প্রকাশ্যে আসেননি।
ছবিতে অভিনয় করে শুধু দর্শকপ্রিয়তা কিংবা জনপ্রিয়তায় নয় পেয়েছিলেন অসংখ্য পুরস্কারও। সুচিত্রা সেন ১৯৬৩ সালে তার অভিনীত ‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবি দিয়ে মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান। এছাড়া ১৯৭২ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পদ্মশ্রী পান। ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাংলাবিভূষণ সম্মাননা দেয়া হয় তাকে। ২০০৫ সালে সুচিত্রা সেনকে ভারতের চলচ্চিত্র অঙ্গনের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার দেয়ার প্রস্তাব করা হলেও সুচিত্রা সেন দিল্লিতে গিয়ে ওই সম্মান গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
সর্বশেষ ১৯৭৮ সালে ‘প্রণয় পাশা’ ছবিতে অভিনয় করার পর হঠাৎই অন্তরালটা বেছে নিয়েছিলেন তিনি। ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি নিজেকে রেখেছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। যার অবসান হয় ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে। নীরবে নিঃশব্দে ৮৩ বছর বয়সে সকলকে কাঁদিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন তিনি । তবে মৃত্যুতেও শেষ হয়নি সেই রহস্যময় সুচিত্রার গল্প। মহাপ্রস্থানের পরও সবার মনে জায়গা পেয়েছেন তার সেই মন ভোলানো হাসি। আর তাইতো সুচিত্রা সেন রূপকথার গল্পের মতোই এখনও চিরভাস্কর।