সোমবার   ২১ এপ্রিল ২০২৫   বৈশাখ ৮ ১৪৩২   ২২ শাওয়াল ১৪৪৬

প্রযুক্তির কাছে কী মানুষ হেরে যাবে?

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৪:১৯ পিএম, ১০ এপ্রিল ২০১৯ বুধবার

আগে একটা সময় চাবির ব্যবহার ছিল অনেক। যার পকেটে যত চাবি থাকতো, ধরে নেয়াই হত সে অফিসের মহা মূল্যবান পদে আছেন। অর্থাৎ একটা অফিসে তাকে অনেক দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে। তবে এখন এ সময়ে এসে পকেটে চাবি নিয়ে ঘুরার মতো লোকের বড্ড অভাব। আসতে আসতে প্রযুক্তির কাছে হারিয়ে যাচ্ছে সে প্রথা। 

এক ধরনের বিলুপ্তির পথে চাবির ব্যবহার। আগে কোনো অফিস বা দোকানে প্রবেশ করতে অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হত, শুধুমাত্র তালা খোলার জন্য। কিন্তু এখন সে দিন শেষ। এখন সে চাবির ব্যবহার শেষ হয়েছে পাসওয়ার্ডের কারণে। উন্নত দেশগুলোতে এখন চাবির ব্যবহার নেই বললে চলে। সেখানে একটি ডিভাইস বসানো থাকে। তার উপর আঙুলের স্পর্শ অথবা পাসওয়ার্ডের অপশন দেয়া থাকে। আর অফিস বা দোকানের সবার কাছে সে সংখ্যা (পাসওয়ার্ড) দেয়া থাকে। 

 

এছাড়াও আগে এক সময় কাগজের ফাইলপত্র খুব দেখা যেত। তবে এ সময়ে এসে অফিসের টেবিলে তেমন ফাইলপত্র চোখে পড়ে না। এখন সব কিছু ডাটাবেস করে রাখা হয়। একটি ব্যস্ত টেবিলে এখন একটি কম্পিউটারই যথেষ্ট। কাগজ, কলম, তালা, চাবি, সবকিছু এখন ভার্চুয়াল হয়ে যাচ্ছে। এসব কিছুর এখন প্রয়োজন হয় না বললে চলে।

এছাড়াও এখন কোনো কিছু কিনতে বাজারে বা শপিং মলে যেতে হয় না, অনলাইনে ঘরে বসে পেয়ে যাবেন সবকিছু। এমনকি পকেট থেকে কষ্ট করে টাকাও বের করতে হয় না, এর লেনদেনও ভার্চুয়াল। অতি ক্ষমতাধর বিভিন্ন চৌকো বাক্সে সব বন্দি হয়ে যাচ্ছে। এখন শপিং করার জন্য একটি কার্ডই যথেষ্ট। তাছাড়া একটি স্মার্ট ফোন থাকলে অ্যাপসের মাধ্যমে আপনি নিমিষেই কিনতে পারবেন সব পণ্য, তাও আবার ঘরে বসে। মোদ্দাকথা প্রযুক্তি মানুষকে সংক্ষিপ্ত করে ফেলছে।


 

এছাড়া আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করেছেন কিনা? আগে একটি বড় শপে মিনিমাম ১০- ১২ জন লোকের প্রয়োজন হত, তবে এখন প্রযুক্তির কারণে এক বা দুইজন লোকই যথেষ্ট। সেটি সম্ভব হয়েছে সিসি ক্যামেরার বদৌলতে। যেখানে ১০ জন লোকের প্রয়োজন, সেখানে চারটি সিসি ক্যামেরায় যথেষ্ট পুরো শপটিকে নজরে রাখতে। এভাবে আসতে আসতে প্রযুক্তির কারণে মানুষের কর্মসংস্থান কমে যাচ্ছে। সামনে মানুষের কর্মসংস্থান আরো কমে যাবে। ব্যাপক অনিশ্চয়তা দেখা দেবে, সঙ্গে বেকারত্বের হারও বাড়বে।

এখন প্রশ্ন হলো, যন্ত্রই কী পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করবে একসময়? এ নিয়ে নানারকম জল্পনা-কল্পনা আছে। অনেক শিক্ষিত বেকারদের এ প্রশ্নটি এখন বেশ ভাবাচ্ছে। এদিকে, কিছুদিন আগে আবার তৈরি হলো ড্রাইভারবিহীন গাড়ি। যে গাড়ি চালাতে কোনো ড্রাইভারের প্রয়োজন হবে না। তাছাড়াও আবার দেখা গেল সংবাদ পাঠকেরও প্রয়োজন নেই! অর্থাৎ ক্যামেরার সামনে বসে সংবাদ পাঠ করতে এখন প্রয়োজন হবে না কোনো উপস্থাপিকার, রোবট দিয়ে সেই উপস্থাপনা হয়ে যাবে। তবে অনেকের কাছে এও মনে হয়, এই ধরনের আবিষ্কার সংকট তৈরি করলেও শেষপর্যন্ত মানুষই জয়ী হবে। কারণ, মানুষের জন্য যন্ত্র, যন্ত্রের জন্যে মানুষ না।

সামনে অনেক ধরনের কাজে মানুষের প্রয়োজন নেই ঠিকই, তবে একজন কপিরাইটারের কাজ কে করবে? কিংবা মার্কেটিং বিশেষজ্ঞের কাজ? আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলেজিন্সের দৌড় কতটুকু? হ্যাঁ, খুব স্মার্ট এবং এফিসিয়েন্ট চিন্তা করতে পারবে যন্ত্র; কিন্তু আনস্মার্ট, অযৌক্তিক চিন্তা করতে পারবে কি? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আবার মানুষেরই প্রয়োজন আছে। যাই হোক একটা কথা পরিষ্কারভাবে বলা যায়, যন্ত্র আবিষ্কার হলেও শিক্ষিত মানুষের প্রয়োজন এখন পুরো পৃথিবীজুড়ে। হয়ত এসব যন্ত্রের কারণে অশিক্ষিত যুবকদের কাজ কমে যাচ্ছে তবে শিক্ষিত যুবকদের কাজ কিন্তু ঠিকই বাড়ছে।

 

তাছাড়া যন্ত্রের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো এর লজিকাল এ্যালগরিদম। পৃথিবীতে অনেক অনেক শুভ কাজ হয়েছে অযৌক্তিক চিন্তা, পাগলামী আর আবেগ থেকে। যন্ত্রের পক্ষে সেটা কোনোদিনই অর্জন করা সম্ভব না। তারপরেও অবশ্য তার আগ্রাসন চলবে। এতে অনেক মানুষ কাজহারা হবে ঠিকই, কিন্তু মানুষের মধ্যে একটা আদিম প্রবৃত্তি আছে টিকে থাকার, তাই মানুষই টিকে যাবে। ক্ষুধার জন্য হলেও মানুষ তাদের কাজ বেছে নিবে।

তবে যন্ত্রের ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই, পরিবার টানার চাপ নেই, সন্তানের প্রতি দায়বদ্ধতা নেই, সবচেয়ে বড় কথা, তাদের মৃত্যুভয় নেই, জীবন জন্ম দেয়ার ক্ষমতা নাই। তারা কিসের প্রেরণায় পরিশ্রমী হয়ে উঠবে? যন্ত্রের কাছে মানুষই ঈশ্বর। তাই তাদের পরিচালনার জন্য অন্তত মানুষের প্রয়োজন হবে।

এ নিয়ে মুহম্মদ জাফর ইকবালের কপোট্রনিক সুখ দুঃখ বইয়ে একটা অসাধারণ গল্প ছিলো, যা আমার বেশ মনে ধরেছে। সেটি হলো, একটি শহরে বা রাষ্ট্রে রোবটরা সব ক্ষমতার অধিকারী হয়। সেখানে তারা মানুষের কাছ থেকে কর্তৃত্ব কেড়ে নেয়। সবকিছু খুব ভালোভাবে চলতে থাকে। তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ছিলো অসাধারণ পর্যায়ের, মানুষের মতই। ধাঁই ধাঁই করে সবকিছুর উন্নতি হতে থাকে। কিন্তু বছর খানেকের মধ্যেই সব মুখ থুবড়ে পড়ে। কারণ হিসেবে জাফর ইকবাল বলেছেন, তাদের মধ্যে ক্ষুধার অনুভূতি নেই। নেই সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা। তবে তারা কাজ করবে, উন্নতি করবে, কিন্তু কাজ না করলে কী হবে? কিছুই হবে না! দিব্যি বেঁচে থাকবে, না খেয়ে থাকার ভয় নেই তাদের (রোবট)! 

এজন্য মানুষের মতো কী তাদের কাজ চলবে? এখানেই পার্থক্য, মানুষ আর রোবটের! পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষটি থেকে শুরু করে সবচেয়ে দুর্বল মানুষটি, সবাইকেই খাদ্যগ্রহণ করতে হয়, ঘুমোতে হয়। সবচেয়ে সফল মানুষটিও আগামীর পথচলায় নিশ্চিন্ত নয়। পেটের ক্ষুধা মিটে গেলে জৌলুসের ক্ষুধা, বিলাসের ক্ষুধা, ওপরে ওঠার ক্ষুধা, ক্ষুধার তো শেষ নেই! তাই মানুষ ক্ষুধার জন্য দৌড়ে বেড়ায় কিন্তু রোবট কী সে দৌড় দৌড়াবে?

আসলে আদিম গুহামানব থেকে শুরু করে আধুনিক ভার্চুয়াল সেলিব্রেটি, মানুষ কিন্তু খুব বেশি বদলায়নি! তারা সেই আগের চিন্তা এখনো করে। সব মানুষ এখনো পূর্ব পুরুষদের চলনভঙ্গী অনুসরণ করে। বেসিক ইনস্টিংক্ট কখনো বদলায়নি, বদলাবেও না। আদিকাল থেকে এখন পর্যন্ত মানবজাতি একের পর এক ক্রাইসিস মোকাবিলা করে এসেছে, নতুন ক্রাইসিস তৈরি করেছে, যন্ত্রসভ্যতা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, এসব এ যাপনেরই একটা অংশ, এর থেকে বেশি কিছু না! শেষ পর্যন্ত পৃথিবীতে মানুষ বেঁচে থাকবে, আর বাকি সব যন্ত্র যন্ত্রের ন্যায় কাজ করে যাবে। অর্থাৎ পৃথিবীতে মানুষের কোনো বিকল্প নেই।