রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১   ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ইসলাম

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ১২:২৮ পিএম, ১২ এপ্রিল ২০১৯ শুক্রবার

আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম যে আওয়াজ তুলেছিলো, কেয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্ম, জাতি বা গোষ্ঠী, তথাকথিত নারীবাদী এবং এনজিও তার দৃষ্টান্ত দিতে সম্পূর্ণরূপে অক্ষম।

ইসলাম নারীদের কতটুকু অধিকার এবং কত বড় মর্যাদা দিয়েছে- এটা বুঝা যায় তাদের সম্পর্কে বর্ণিত কোরআনের অসংখ্য আয়াত ও অগণিত হাদিসের প্রতি লক্ষ্য করলেই। তাদের প্রতি সদাচরণ ও ন্যায়সঙ্গত বিধানের যে অনুপম নিদর্শন ইসলাম রেখেছে, তা অমুসলিমদের কাছেও প্রশংসিত। তারা এ কথা বলতে বাধ্য হয়েছে যে, নারীদের জন্য ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সকল প্রকার অবিচার দূর করার ক্ষেত্রে ইসলামই একমাত্র আদর্শ।

বর্তমান যুগে পশ্চিমা বিশ্ব নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা না করার বিষয়ে ইসলামের প্রতি যে বিষোদগার ও কুৎসা রটনা করছে, তা কেবল নিজেদের স্বার্থ অর্জন ও মানুষের সামনে ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায় নিয়ে করছে। অথচ বর্তমানেও অনেক অমুসলিম চিন্তাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা নারীদের শ্রেণিবৈষম্য দূর ও তাদের পরিপূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইসলামকেই মূল উৎস মনে করেন। নিম্নে তাদের কিছু উক্তি তুলে ধরা হলো।

 

ইসলামই নারীদের জীবনের সকল অধিকার প্রতিষ্ঠাকারী, ইসলাম পূর্ব যুগে যার কল্পনাও করা যেত না- এ কথার স্বীকারোক্তি দিয়ে ‘ইবাইডন’ লিখেন, ‘প্রকৃত ইসলাম তাই, যা নবী মোহাম্মাদ (সা.) নিয়ে এসেছেন। তিনি নারী জাতিকে সেই সম্মান ও অধিকার দিয়েছেন, যা তাঁর পূর্বের মানব ইতিহাসে বিরল।’ (সুন্নতে নববি ও নব বিজ্ঞান)।

‘ডবালাইর’ লিখেন, ‘হজরত মোহাম্মাদ (সা.) নারী সমাজকে যে মান-মর্যাদা দিয়েছে, তা পশ্চিমা সমাজ বা অন্য কোনো জাতি দিতে অক্ষম।’ নবীয়ে আবারি (সা.) এর অনুপম শিক্ষা এবং তিনি কর্তৃক নারী জাতির জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়নের প্রশংসা করতে গিয়ে 'ইডরমঙ্গম' লিখেন, ‘এ কথা অনস্বীকার্য যে, মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর আদর্শ শিক্ষা মূর্খ আরব জাতির জীবনকে বদলে দিয়েছিল। তাঁর আগমনের পূর্বে নারী জাতির সে সম্মানটুকু ছিলো না, যা তাঁর সুমহান শিক্ষার কারণে অর্জিত হয়েছে। পতিতাবৃত্তি, অস্থায়ী বিবাহ ও অবৈধ প্রেম-ভালোবাসাকে তিনি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। আগে কৃতদাসীদের মনিবের মনোরঞ্জন ও ভোগের সামগ্রী মনে করা হতো; তিনি এসে তাদের অধিকার পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত করেন।’ (দি লাইফ আফ মোহাম্মাদ সা.)।

'ডবিউ ডবিউ কিশ’ লিখেন, ‘সর্বপ্রথম ইসলাম নারীদের অধিকার দিয়েছে। তাদের ইসলামে খোলা করার অধিকার দেয়া হয়েছে।’

 

নারীদের চার অবস্থা: ইসলাম কেবল নারীদের লাঞ্ছনা-বঞ্ছনার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করেনি, বরং তাদের সকল প্রকার অধিকার সর্বোত্তম পন্থায় নিশ্চিতও করেছে। এমনকি ইসলাম পূর্ব যুগে যারা নারীদের অবহেলার পাত্র মনে করতো, ইসলাম আসার পর তারাই নারীদের ব্যাপারে কোনো কথা বলতে সাবধানতা অবলম্বন করতে লাগলো। এ কারণে বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত হিসেবে খ্যাতি পাওয়ার যোগ্য একমাত্র ইসলাম। ব্যক্তিসত্তার দিকে লক্ষ্য করলে নারীদের চারটি অবস্থা আমাদের সামনে আসে। যথা: ১. মা, ২. বোন, ৩. স্ত্রী ও ৪. মেয়ে।

ইসলাম মা হিসেবে নারীর মর্যাদা যথোচিতভাবে আদায় করেছে। মাকে দিয়েছে সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা। হজরত মোওয়াবিয়া ইবনে জাহিমা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, 'আমার পিতা হুজুরে আকরাম (সা.) এর খেদমতে হাজির হয়ে বলল হে আল্লাহর রাসূল! আমার খুব ইচ্ছে জিহাদে যাওয়ার। তাই আমি আপনার কাছে পরামর্শের জন্য এসেছি।’ রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তোমার মা কি জীবিত আছেন?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, জীবিত আছেন।’ রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তাহলে তুমি তার সঙ্গেই থাকো। কেননা মায়ের পায়ের নিচেই রয়েছে জান্নাত।’ (নাসাই)।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, এক ব্যক্তি হুজুর আকরাম (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলো, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার কাছ থেকে সদাচরণের কে বেশি হকদার?’ রাসূলুল্লাহ (সা.) তিনবার বললেন, ‘তোমার মা।’ চতুর্থবার বললেন, ‘তোমার বাবা।’ (বুখারি)।

 

এই হাদিসের ভাষ্য দ্বারা বুঝা যায়, পিতার চেয়ে মা তিনগুণ বেশি খেদমতের হকদার। মা যদি কাফেরও হন, তবুও তার প্রতি সদাচারণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হজরত উসামা (রা.) হুজুর (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার মা ইসলামকে ঘৃণা করে। এখন আমি কী তার সঙ্গে উত্তম আচরণ করবো কীনা?’ রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘নিজের মায়ের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করো।’ (বোখারি)। নবি করিম (সা.) মায়ের পর নিজ খালার সঙ্গে মায়ের মতো ব্যাবহার করতে নির্দেশ দেন। (মুসনাদে আহমদ)।

পবিত্র কোরআনে বোনের সামাজিক ও পারিবারিক অধিকার সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্বারোপ হয়েছে। তার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্য সম্পত্তি সম্পর্কেও অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। তাছাড়া নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যার তিনটে কন্যা বা বোন থাকে, আর সে তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করে, সে জান্নাতের হকদার’। (তিরমিজি)।

ইসলাম পূর্ব যুগে কন্যা সন্তান জন্ম নেয়াকে একটি লজ্জাকর ও নিন্দনীয় বিষয় মনে করা হতো। নবী করিম (সা.) আগমন করে এইসব অবান্তর সামাজিক প্রথাকে দূর করে কন্যাসন্তানকে দান করেন সুমহৎ অধিকার ও মর্যাদা। ইসলাম কন্যাদের সামাজিক মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়ে উত্তরাধিকারলব্ধ সম্পত্তিতেও হকদার বানিয়েছে। পবিত্র কোরআনে মানুষের বংশ পরিক্রমা চলমান রাখতে বৈবাহিক জীবন ও আত্মীয়তার সম্পর্ককে আল্লাহর পক্ষ থেকে নেয়ামত হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। এর সঙ্গে বৈবাহিক জীবনের গুরুত্ব ও স্ত্রীর সঙ্গে উত্তম আচরণেরও গুরুত্বারোপ হয়েছে।

ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করো। এরপর যদি তাদের তোমাদের পছন্দ না হয়, তাহলে হতে পারে তোমাদের কাছে কোনো জিনিস অপছন্দ, অথচ আল্লাহ তায়ালা তাতে তোমাদের জন্য অফুরন্ত কল্যাণ রেখেছেন’। (সূরা নিসা) নবিয়ে আরাবি (সা.) ও স্ত্রীর সঙ্গে উত্তম আচরণের অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। হাদিস পর্যালোচনা করলে অসংখ্য ঘটনা এমন দেখা যায়, যাতে নবী করিম (সা.) অনেক সময় নিজ স্ত্রীদের মনোরঞ্জনের জন্য হাসি-আহ্লাদ করেছেন। কখনো তিনি হজরত আয়েশা (রা.) এর সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করেছেন, আবার কখনো তাকে হাবশিদের খেলাধুলা থেকে আড়াল করে রেখেছেন (আড়াল করে তাদের খেলাধুলা তাকে দেখতে দিয়েছেন)।

হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে এক সফরে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) দৌড় প্রতিযোগিতা করলাম এবং আমি তাঁর আগে চলে গেলাম। এরপর যখন দ্বিতীয়বার আমি এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) দৌড় প্রতিযোগিতা করলাম তখন নবিজি (সা.) আমার আগে চলে গেলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘এটা হলো তার বদলা। তুমি প্রথমে আমার আগে চলে গিয়েছিলে, এখন আমি! এভাবে আমরা দু’জনে সমান হয়ে গেলাম’। (আবু দাউদ)।

 

কোরআন ও হাদিস অধ্যয়ন করলে আমরা দিবালোকের মতো স্পষ্ট দেখতে পাই যে, কোরআন-হাদিসে নারীদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, বৈবাহিক ও সামাজিসহ সকল অধিকার অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। মোটকথা, ইসলাম এসে নারীদের উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে, তাদের নিজ পছন্দমত বিবাহের অধিকার দিয়েছে, বংশীয় লোক, স্বামী ও অন্যান্য নিকটাত্মীয়দের সম্পদে উত্তরাধিকার বানিয়েছে, যেভাবে পুরুষকে তালাকের অধিকার দেয়া হয়েছে, তেমনি নারীদেরও ‘খোলা’ করার মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদের ইচ্ছাধিকার দেয়া হয়েছে।

মানুষ হিসেবে ইসলাম নারী-পুরুষের সমান অধিকার দিয়েছে। যেমনিভাবে নারীর ওপর পুরুষের অধিকার রয়েছে, ঠিক তেমনি পুরুষের ওপরও নারীর অধিকার রয়েছে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) নারীদের জন্য যে অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা পরিপূর্ণরূপে পালন করাই ছিলো আমাদের পূর্ববর্তী আলেমদের নীতি। নারীদের অধিকার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বিদায় হজের ভাষণে ইরশাদ করেন, ‘সাবধান! নারীদের ওপর তোমাদের যেমন অধিকার রয়েছে, তোমাদের ওপরও তাদের অধিকার রয়েছে। তোমাদের পক্ষ থেকে নারীদের প্রাপ্য অধিকার হলো, তাদেরকে উত্তম পোশাক পরিধান করানো এবং উত্তম খাবার খাওয়ানো।’

আমাদের উচিৎ হলো, ইসলাম নারীদের যে অধিকার দিয়েছে তা মনেপ্রাণে গ্রহণ করে যথাযথভাবে পালন করার চেষ্টা করা এবং নারী অধিকার প্রতিষ্ঠাকারীদের সঙ্গ দেয়া। কারণ, অন্য কোনো ধর্ম নয়; একমাত্র ইসলামই নারীদের দিয়েছে উপযুক্ত অধিকার এবং তা সংরক্ষণের তাকিদও করেছে বিশেষভাবে।

নারী অধিকারের নামে প্রতারণা: ইসলাম নারীদের যে অধিকার দিয়েছে পৃথিবীর অন্য ধর্ম বা সভ্যতায় এর নজির নেই। এরপরও ইসলাম বিদ্বেষীরা আমাদেরই কিছু নির্বোধকে মাধ্যম বানিয়ে নারী অধিকারের নামে বিভিন্ন প্রোপাগান্ডা জন্ম দিচ্ছে। অত্যন্ত অনুতাপের বিষয় হলো, নারী অধিকারের নামে এসব অবান্তর যুক্তি ও প্রোপান্ডাগা আগে তথাকথিত কিছু বিশেষজ্ঞ ও বিধর্মী নাস্তিকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু বেশ কয়েকদিন যাবৎ কিছু সরকারি চাটুকার ও সুযোগ সন্ধানী নেতা মিডিয়ার মাধ্যমে ইসলামের বিধিবিধানের ওপর আপত্তি তোলার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে।

অনেকে ভেতরগত পারিবারিক মাসায়েলগুলোকে মুসলিম নারীদের বিপরীতে দাঁড় করানোর হীন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা এটা প্রমাণ করতে চাচ্ছে যে, ইসলামে তালাকের বিধান নারী স্বাধীনতার পরিপন্থী। এর দ্বারা নারীদের পুরুষদের দাসী করে রাখা হয়। অথচ ইসলামে তালাকের বিধান দেয়া হয়েছে, যাতে নির্যাতিত নারীরা মুক্তি পেতে পারে এবং দুটো মনের অমিল হলে তালাকের মাধ্যমে লাঞ্ছনা ও কষ্ট থেকে উভয়েই বাঁচতে পারে। এমনিভাবে খোলা’র বিধান রাখা হয়েছে, যাতে নারীরা অশান্তিপূর্ণ বিবাহিত জীবনে স্বামী থেকে বিচ্ছেদ হতে পারে। এমন অতুলনীয় বিধান অন্য কোনো ধর্মে মিলবে না।