রূপগঞ্জে নির্ঘূম রাত কাটাচ্ছে কুমারপাড়ার মৃৎ শিল্পীরা
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৯:৫৫ এএম, ১৩ এপ্রিল ২০১৯ শনিবার
পহেলা বৈশাখ উৎসব সামনে রেখে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের কুমারপাড়ার মৃৎ শিল্পীরা। ”পহেলা বৈশাখ বাঙ্গালীর প্রানের উৎসব”।
পহেলা বৈশাখ মানেই বাঙ্গালীর মনে নতুন আমেজ। আর এ পহেলা বৈশাখকে ঘিরে গ্রাম-গঞ্জের হাট বাজারে বসে বিভিন্ন রকমের মেলার পসরা। তখন ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা তাদের বাবা মার সঙ্গে মেলাতে যাওয়া বায়না ধরে। মেলায় গিয়ে তাদের প্রথম পছন্দ থাকে মাটির তৈরী রকমারি খেলনা।
নববর্ষের আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। আর এ মাটি দিয়ে মনের মাধুরী দিয়ে তৈরী করছেন বিভিন্ন রং বেরংয়ের পুতুল, সরা, ঘোড়া, হাতি, বানর, বাঘ, সিংহ, গরু, কুকুর, মাটির ব্যাংক, পাতিল, প্লেট ও বাচ্চাদের হাড়িপাতিলসহ নানা রকমের গৃহস্থালির তৈজসপত্র।
নববর্ষের আর সময় বেশী না থাকায় তাদের যেন নিশ্বাস ফেলারও সময় নেই। প্রতিদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন মৃৎ শিল্পীরা। তাইতো তারা রং তুলির শেষ আচড় টুকু দিয়ে দিচ্ছেন তাদের তৈরী খেলনা পুতুলসহ ও গৃহস্থালির নানা রকম তৈজসপত্রে।
এ কাজে ছেলে বুড়ো থেকে শুরু করে পরিবারের সবাই একে অপরকে কাজে সাহায্য করছে। এ কাজে পুরুষদের পাশাপাশি পিছিয়ে নেই নারীরাও। নারীরা তাদের হাতের নিপুন ছোঁয়ায় রাঙ্গিয়ে দিচ্ছেন খেলনা ও তৈজসপত্রগুলোকে।
সরেজমিনের ঘুরে দেখা গেছে, বাঙ্গালীর হাজার বছরের ঐতিয্য পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে মৃৎ শিল্পীরা বাহারি রং বেরংয়ের খেলনা ও গৃহস্থালির তৈজসপত্র তৈরীতে ব্যস্ত সময় পার করছেন মৃৎ শিল্পীরা।
বছরের অন্যান্য সময়ে তাদের ব্যস্ততা কম থাকলেও সামনে পহেলা বৈশাখ থাকার কারনে তাদের ব্যস্ততা একটুও বেশী। মৃৎ শিল্পীরা তাদের হাতের ছোয়ায় তৈরী করছে মনোমুগ্ধকর রকমারি খেলনা ও তৈজসপত্র। এসকল জিনিস তৈরী করতে মৃৎ শিল্পীদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হয়।
মৃত শিল্পীরা নিজেই মাটির তৈরী এসকল খেলনা ও গৃহস্থালীর তৈজসপত্র দূর দুরান্তে গিয়ে ফেরি করে বিক্রি করে আসে। আবার কখনো কখনো পহেলা বৈশাখের মেলা বা হাটবাজারে গিয়ে তারা নিজেরাই বিক্রি করতে চলে যায়। তাছাড়া ঢাকাসহ দেশের দূর দুরান্ত থেকে পাইকাররা এসে ভীড় জমায় এখানে।
পাইকারী দামে কিনে নিয়ে যায় হরেক রকমের খেলনা ও গৃহস্থালির তৈজসপত্র। কুমারপাড়া এলাকাতে প্রায় ২০ টি পরিবার মৃৎ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এসকল পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে মৃৎ শিল্প।
মৃৎ শিল্পী অমিত পাল জানান, পহেলা বৈশাখ সন্নিনিকটে হওয়ায় বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় তাদের কাজের ব্যস্ততা অনেক বেশী। এসকল তৈজসপত্র তৈরী করতে প্রথমে তাদেরকে মাটি প্রস্তুত করতে হয়। মাটি প্রস্তুতের পর এগুলোকে বিভিন্ন ধরনের আকার দেয়া হয়। বিভিন্ন রকমের আকার দেয়ার পর খেলনা ও তৈজসপত্র গুলোকে রোদে শুকিয়ে আগুনে পুড়ে শক্ত করা হয়।
এরপর খেলনা ও তৈজসপত্র গুলোকে মৃৎ শিল্পীরা তার হাতের ছোয়া দিয়ে নানা রকমের রংয়ে রাঙ্গিয়ে দেয়। তারপর এগুলোর বিক্রির জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। পরে কুমারপাড়ার মৃৎ শিল্পীরা গ্রাম-গঞ্জের হাট বাজার ও মেলাতে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেন।
তবে, পর্যাপ্ত মাটির অভাবে এসব খেলনা ও গৃহস্থালির তৈজসপত্র তৈরী করতে প্রতিবন্ধকতার সম্মূখীন হতে হচ্ছে। এ কারণেই পেশাটি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। এসকল মাটির খেলনা ও তৈজসপত্র বিক্রি করে আগের মত এখন আর লাভ করতে পারে না। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় ঝুকতে হচ্ছে তাদের।
রেখা পালের স্বামী অখীল পাল জানায়, রেখা পাল একজন বাকপ্রতিবন্ধি। বাকপ্রতিবন্ধি হওয়ার কারণে কোন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করা হয়নি। কোন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকার কারণে সংসারের বোঝা না হয়ে রেখা পাল তার স্বামী অখীল পালকে এসব মৃৎ শিল্পের কাজের সাহায্য করেন।
সামনে বৈশাখ তাই রেখা পাল মাটির তৈরীর খেলনা ও গৃহস্থালীর বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরী করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। রেখা পাল নিজে কথা বলতে না পারলেও নিজের নিপুন হাতের ছোয়া দিচ্ছেন মাটির তৈরী খেলনা ও গৃহস্থালীর তৈজসপত্র গুলোকে।
রঞ্জিত পাল নামে এক পাইকার জানান, তিনি ঢাকা জেলার কাকরাইল এলাকার থেকে কুমারপাড়াতে মাটির তৈরী খেলনা ও গৃহস্থালীর তৈজসপত্র পাইকারীভাবে কিনতে এসেছেন। তিনি এখান থেকে মালামাল কিনে নিয়ে গিয়ে ঢাকাতে পহেলা বৈশাখের মেলাতে বিক্রি করবেন।
তিনি আরো জানান, মৃত শিল্প বাঙ্গালীর সংস্কৃতির সাথে আছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু বর্তমানে মৃত শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। মৃত শিল্পকে রক্ষা করতে হলে সরকারীভাবে উদ্যোগ নেওয়াটা জরুরি।
এছাড়া স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কুমারপাড়ার অরুন পাল, বর্তমানে বিশ্ব পালসহ প্রায় ২০ টি পরিবার এ পেশায় সংযুক্ত রয়েছে বেশ কয়েক যুগ ধরে। মৃৎ শিল্প তাদের বাপ দাদার পেশা। তাই অনেকে এ পেশার সঙ্গে জড়িত রয়েছে।
আবার অনেকে এ পেশা ছেড়ে অন্যান্য পেশায় ঝুকে পড়েছে। আবার কেউ এ পেশার পাশাপাশি অন্য কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। তবে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এ পেশায় অনাগ্রহ প্রকাশ করছে।
গবেষক, কলামিষ্ট, লেখক ও রূপগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি লায়ন মীর আব্দুল আলীম বলেন, পহেলা বৈশাখ আমাদের প্রানের উৎসব। আর মৃৎ শিল্প আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে আঙ্গাআঙ্গিভাবে জড়িত। মৃৎ শিল্পীরা তাদের হাতের ছোঁয়ায় অনেক অভুতপূর্ব ও রকমারি জিনিস তৈরী করেন। মৃৎ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে সমাজের সচেতন সমাজকে অগ্রনী ভুমিকা রাখতে হবে।
উপজেলার নির্বাহী মমতাজ বেগম জানান, মৃৎ শিল্প টিকিয়ে রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে উপজেলা প্রশাসনও সহযোগীতা করবে।