মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১   ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কালিমা তাইয়েবার দাওয়াত ও গুরুত্ব

ধর্ম ডেস্ক

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৫:৪০ পিএম, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ সোমবার

 

কালিমা তাইয়েবার গুরুত্ব ও ফজিলত নিয়ে কোরআন ও হাদিসে অনেক আলোচনা হয়েছে।

হাদিসে রয়েছে হজরত আমবাসা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবীজি (সা.) এর খেদমতে হাজির হলেন। তিনি ছিলেন অনেক বৃদ্ধ। বৃদ্ধ লাঠির ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি তো অনেক গুনাহ করেছি, আমার আচল ভরে আছে গুনাহ দ্বারা। আমার জন্যও কি ক্ষমা হতে পারে? নবীজি (সা.) বলেন, তুমি কি এই সাক্ষ্য দাও না যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই? তিনি বললেন, কেন নয়, অবশ্যই এই সাক্ষ্য দিই, আরো সাক্ষ্য দিই যে, আপনি আল্লাহর রাসূল। তখন নবীজি (সা.) বলেন, তাহলে তো তোমার সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। (মুসনাদে আহমাদ, পৃ ১৯৬৫২)

আল্লাহর পথে নবীজির নজীরবিহীন কোরবানি:

হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, নবীজি (সা.)-কে প্রশ্ন করা হলো, আপনার ওপর সবচেয়ে কঠিন কোন আয়াত নাজিল হয়েছিল? তিনি বললেন, হজের সময় আমি মিনায় ছিলাম। আরবের মুশরিকরা সেখানে ছিল। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন সেখানে জমা হয়েছিল। তখন জিবরাঈল (আ.) এই আয়াত নিয়ে নাজিল হলেন, ‘হে রাসূল! আপনার রবের পক্ষ থেকে আপনার ওপর যা নাজিল করা হয়েছে, তার প্রচার করুন। যদি আপনি তা না করেন, তাহলে আপনি পয়গাম পৌঁছালেন না। এবং আল্লাহ আপনাকে মানুষদের থেকে হেফাজত করবেন। (সূরা মায়েদাহ- ৬৭)।

 

1.কালিমা তাইয়েবার দাওয়াত ও গুরুত্ব

অতঃপর আমি উপত্যকায় দাঁড়ালাম। উচ্চস্বরে ঘোষণা করি, হে লোক সকল! আমি আমার রবের পয়গাম পৌঁছে দিতে চাই। কে আছো এমন যে আমার সঙ্গ দেবে, সে জান্নাত পাবে। হে লোক সকল! লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলো এবং বলো আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। এই স্বীকারোক্তি দিলে তোমরা সফলকাম হবে এবং জান্নাত লাভ করবে। আমার এই কথার পর কোনো নারী-পুরুষ, ছোটো-বড় এমন কেউ বাকি ছিলো না যে, আমার ওপর পাথর নিক্ষেপ করেনি। আমাকে ধিক্কার জানিয়ে মিথ্যাবাদী আখ্যা দিয়েছে। এমন সংকটের মুহূর্তে ফেরশতারা এসে বলেন, হে মুহাম্মাদ! আপনি যদি আল্লাহর রাসূল হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার জন্য সুযোগ আছে, আপনি মুশরিকদের জন্য বদদোয়া করেন যেভাবে নুহ (আ.) নিজ জাতির ধ্বংসের জন্য বদদোয়া করেছিলেন। তখন নবীজি (সা.) এর জবাবে বলেন, হে আল্লাহ! আমার কওমকে হেদায়াত দিন, কেননা তারা জানে না এবং আমাকে সাহায্য করেন, যাতে তারা আমার দাওয়াত কবুল করে এবং আপনার আনুগত্য করে। তখন নবীজি (সা.) এর চাচা হজরত আব্বাস (রা.) আসেন এবং নবীজিকে তাদের হাত থেকে মুক্ত করেন। এবং বদমাশদের তাড়িয়ে দেন।

এই হাদিসের বর্ণনাকারী হজরত আমাশ বলেন, হজরত আব্বাস (রা.) এর পরিবার এই ঘটনাকে নিজের জন্য গর্বের বিষয় বলে কল্পনা করতেন। এই ধারাবাহিকতায় এই আয়াত নাজিল হয়, হে নবী যাকে আপনি হেদায়াত দিতে চান, তাকে দিতে পারবেন না। কিন্তু আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে হেদায়াত দ্বারা ধন্য করবেন। উদ্দেশ্য ছিল এই, নবীজির ইচ্ছে ছিল চাচা আবু তালেবের ইসলাম গ্রহণের। কিন্তু আল্লাহ চাইলেন চাচা ইবনে আব্বাস ইসলাম গ্রহণ করুক এবং এমনই হলো, চাচা আব্বাস (রা.) ইসলামের ছায়াতলে আসেন। (আহাদিস আল মুখতারাহ লিল মুকাদ্দাসি পৃ: ২)

এই হাদিস থেকে বেশ কয়েকটি শিক্ষা:

১. এই কালিমার স্বীকারোক্তির ওপর নবীজি (সা.) সফলতা ও জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। ২. নবীজি (সা.) দুশমনদের ওপরও কতোটা রহম দিল ছিলেন যে, এতো কষ্ট পাবার পরেও দুশমনদের জন্য বদদোয়া করেননি। বরং যারা কষ্ট দিয়েছে তাদের জন্য দোয়া করেছেন। এখন এটা মুসলমানদের জন্য চিন্তার বিষয়, কষ্ট প্রদানকারী অমুসলিমদের জন্য তারা বদদোয়া করছে না তাদের হেদায়াতের জন্য দোয়া করছে। নবীজি (সা.) এর আদর্শ কি ছিলো? এ ব্যাপারে মুসলমানদের চিন্তাভাবনা করা জরুরি। আহলে ইলমের জন্য নবীজি (সা.) এর এ কথার ওপর বিশেষভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন।

সেখানে এমন সুযোগ ছিল নবীজি (সা.) যদি নুহ (আ.) এর মতো বদদোয়া করতেন তাহলে সেখানেই সমস্ত দুশমনি খতম হয়ে যেতো। কিন্তু তিনি অমুসলিম দুশমনদের জন্য বদদোয়া নয়, নেক দোয়ার সওগাত দিয়েছেন। যদি মুসলমানরা গভীর দৃষ্টিতে এই ঘটনা পাঠ করে এবং নবীজি (সা.) এর আদর্শের ওপর আমল করে তাহলে পৃথিবীর হয়তো পাল্টে যাবে।

 

৩. নবীজি (সা.) এই কালিমার জন্য কী পরিমান কষ্ট সহ্য করেছেন। তাকে মিথ্যাবাদি আখ্যা দেয়া হয়েছে, পাথর নিক্ষেপ করা হয়েছে, মুখে থুতু দেয়া হয়েছে। এইসব কিছু তিনি মুসলমানদের মধ্যে দ্বীনের দাওয়াত এসলাহের জন্য সহ্য করেননি বরং অমুসলিমদের মাঝে কালিমায়ে লা ইলাহা ইল্লাহর দাওয়াত পৌঁছানোর জন্য সহ্য করেছেন। যার দ্বারা বুঝা যায় নবীজি (সা.) এর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিল অমুসলিমদের ইসলামের দাওয়াত দেয়া। যে ব্যাপারে মুসলমানরা এখন গাফেল। যারা দীনি কাজ করেন তারা দীনের অন্যান্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছেন। যখন তাদের অমুসলিমদের মাঝে দাওয়াত দেয়ার কথা বলা হয় তখন তারা বলে আগে নিজেদের ঘর ঠিক করে নেই পরে তাদের কথা চিন্তা করা যাবে। অর্থাৎ আগে মুসলমানরা প্রকৃত মুসলমান হয়ে উঠুক পরে অন্যদের ইসলামের দাওয়াত দেয়া যাবে।

কিন্তু এমন কল্পনা করা চরম খাম খেয়ালি। কারণ নবীজি (সা.) আমাদের এবং সকল মানুষের জন্য আইডল স্বরূপ। নবীজি (সা.) এক সঙ্গেই দুই দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথমত অমুসলিমদের ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন। যখন তারা ইসলাম গ্রহণ করেছে তখন তাদের তালিম ও তাজকিয়ার ব্যবস্থা করেছেন। যেমনিভাবে কোরআনের সূরায়ে জুমার ২ নম্বর আয়াতে নবীজি (সা.) এর দায়িত্বের বিবরণ দেয়া হয়েছে। সেখানে প্রথম জিম্মাদারি অমুসলিমদের মাঝে দাওয়াত এর কথাই বলা হয়েছে।

 

নবীজি (সা.) পৃথিবীতে যখন আগমন করেন সারা পৃথিবী কুফুরের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। পুরনো মুসলমান (অর্থাৎ, আহলে কিতাব ইহুদি, নাসারা) সকলেই ইসলাম থেকে দূরে ছিল। তখন তাদের সঠিক ইসলামের দিকে আনার জন্য নবীজি (সা.)-কে প্রেরণ করা হয়। নবীজি (সা.) আগমন করে সারা জীবন অমুসলামদের মাঝে ইসলামের প্রচারে ব্যয় করেছেন। যেখানে নিজে যেতে পারতেন না, সেখানে নিজের পত্রাবলি প্রেরণ করেছেন। সাহাবায়ে কেরামদের দীনের দাওয়াতের জন্য প্রেরণ করেছেন। এসব নবী জীবনের এমন কিছু অধ্যায় যে ব্যাপারে অধিকাংশ উম্মত এমনকি উম্মতের বিশেষ তবকাও এ ব্যাপারে গাফেল এবং ইসলামের দাওয়াতের ব্যাপারে কোনো তৎপরতা নেই।

ফলাফল হলো, সমস্ত মানুষের জন্য উম্মাতে মুসলিমার ওপর যে আমানত ছিল তার খেয়ানত হচ্ছে। এই জন্য সকল মানুষের কল্যাণকামীতার জন্য এবং সমস্ত মানুষের আমানত তাদের পযর্ন্ত পৌঁছানোর জন্য এই উম্মত যদি তৎপর না হয় তাহলে অবস্থা খারাপ থেকে খারাপই হবে। হেদায়াত দেয়া এটা আল্লাহ তায়ালার জিম্মাদারি। কিন্তু ভালোবাসা, সহনশীলতা ও কল্যাণকামিতার সঙ্গে হেদায়াতের আলো দ্বারা দুনিয়ার মানুষকে আলোকিত করা এবং ভুল পথে চলা মানুষদের কাছে প্রতিপালকের পয়গাম পৌঁছানো উম্মাতে মুসলিমার ওপর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। যা থেকে গাফলতির পরিনাম আজ সামনেই আছে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের দীর্ঘস্থায়ী কামিয়াবি হাসিলের জন্য দাওয়াতি কাজ করার তাওফিক দান করেন।

কালিমার অনুসারিদের জন্য হাশরের দিনের মহা সুসংবাদ:

হজরত আওফ ইবনে মালেক (রা.) এর রেওয়ায়াত মুসনাদে রুয়ানি, মুজামে তাবরানি এবং সমস্ত তাফসিরের কিতাবে বণির্ত হয়েছে। তিনি রাসূল (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, নবীজি (সা.) বলেন, আমার উম্মতের মধ্যে তিনটি ভাগ হবে। এক জামাত বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আরেক জামাতের যৎ সামান্য হিসাব-কিতাবের মুখোমুখি হতে হবে। এরপর জান্নাতে প্রবেশ করবে। তৃতীয় জামাতের হিসাব কঠোরতার সঙ্গে নেয়া হবে। এমন সময় ফেরেশতারা এসে বলবে। যাদের হিসাব নেয়া হচ্ছে তাদেরকে আমরা পৃথিবীতে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা অবস্থায় পেয়েছি। তখনই আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে ঘোষণা হবে, আমার এই বান্দারা সত্য বলেছে। আমি ব্যতিত কোনো মাবুদ নেই। যারা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলেছে, তাদের জান্নাতে দাখেল করে দাও। তাদের গুনাহগুলো ওইসব মিথ্যাবাদিদের ওপর ঢেলে দাও যারা কালিমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল। নবীজি (সা.) বলেন এ কথার সত্যায়ন হলো এই আয়াত .. এবং তারা নিজেদের বোঝা উঠাবে, এবং নিজেদের বোঝার সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের বোঝাও। ( মুসনাদে রুয়ানি-৫৯৬)

এই রেওয়াত এর মধ্যে আরো রয়েছে, কালিমায়ে তাইয়েবার অনুসারিদের হিসাব-কিতাব সহজ হবে। ফেরেশতারাও তাদের পক্ষে সাক্ষ দিবে। তখন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করার হুকুম দিবেন। তাওহিদের অনুসারিদের ক্ষমার জন্য প্রতিপালকের কাছে নবীজি (সা.) এর দরখাস্ত:

 

সহিহ ইবনে হিব্বান ও মুসনাদে আবু ইয়ালায় হজরত আওফ ইবনে মালেক থেকে বণির্ত। নবীজি (সা.) বলেন, আমাকে এমন চারটি জিনিস দেয়া হয়েছে, যা আমার পূর্বে আর কাউকে দেয়া হয়নি। তখন আমি রবের নিকট আরেকটি জিনিস প্রার্থনা করি, সেটাও আমাকে দেয়া হয়। প্রথমটি হলো, আমার পূর্বে নবীদের বিশেষ এলাকা ও জাতির উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হতো। কিন্তু আমাকে সমস্ত উম্মতের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। দ্বিতীয়টি হলো- এক মাসের দূরত্ব পরিমান ভয়-ভীতি দুশমনদের অন্তরে ঢেলে দেয়া হয়েছে। তৃতীয়টি হলো, সমস্ত জমিন আমাদের জন্য পবিত্র ঘোষণা করা হয়েছে। জমিনের মাটি দ্বারা পবিত্রতাও অর্জন করা যায় এবং এই জমিনের যেকোনো স্থানে নামাজ পড়ারও অনুমতি আছে। চতুর্থটি হলো, আমাদের জন্য গনিমতের মালের অংশ হালাল করা হয়েছে। যা পূর্ববর্তীদের জন্য হালাল ছিল না। আর পঞ্চমটি যা আমি আল্লাহর কাছে চেয়েছি তা হলো, আমার উম্মতের মধ্যে থেকে যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে এ অবস্থায় মিলিত হয় যে, সে তাওহিদকে স্বীকার করে (অথার্ৎ কালিমায়ে তাইয়েবা মানে) তাকে যেন জান্নাত দেয়া হয়। আমার এই দরখাস্তও আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান: ৬৩৯৯)

হাদিসের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। নবীজি (সা.) এর মর্যাদার কথা বলা হয়েছে, যে নবীজিকে সমস্ত উম্মতের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে। নবীজি (সা.) এর ভীতি দুশমনদের অন্তরে সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে। সমগ্র জমিনে নামাজ ও ইবাদতের অনুমতি দেয়া হয়েছে। যখন অন্যান্য জাতির ইবাদত শুধু বিশেষ ইবাদত খানায় করা জরুরি ছিলো। গনিমতের মাল ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। যখন অন্য জাতির গনিমতের মাল ব্যবহারের অনুমতি ছিলো না। এবং সর্বশেষ এই কালিমার গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি এই কালিমায়ে তাওহিদের ওপর বিশ্বাস রেখে আল্লাহ পাকের সঙ্গে মুলাকাত করবে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে।

আল্লাহ পাক আমাদের এই কালিমার প্রচার-প্রসারে ভূমিকা রাখার তাওফিক দান করুন।