ঢাকায় উইঘুর আলেম, কতটা জানেন?
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৪:৫১ পিএম, ১৭ এপ্রিল ২০১৯ বুধবার
উইঘুর, বিশ্বের আরেক ভাগ্যাহত মুসলিম জনগোষ্ঠী। কাশ্মীর, ফিলিস্তিন আর রোহিঙ্গাদের মতোই তারা নিপীড়িত। জনগোষ্ঠীটির প্রায় ১ কোটি সদস্যের বসবাস পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সীমান্তে।
এর পরেই প্রায় ১০ লাখ উইঘুরের বসবাস চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে। শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে সেখানে তাদের মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করছে সরকার। যথেচ্ছ গ্রেফতার আর বাড়ি থেকে সন্তানদের তুলে নিয়ে গিয়ে ক্যাম্পে নির্যাতন করা হয়।
বাড়িঘর এমনি মসজিদ পর্যন্ত ধ্বংস করে দেয়া অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে সেখানে ধর্মীয় পোশাক নিষিদ্ধ। ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআনও নিষিদ্ধ। চাপিয়ে দেয়া হয়েছে কোরআনের পরিবর্তে সমাজতন্ত্রের বুলি।
উইঘুর সম্পর্কে জাতিসংঘেরই ভাষ্যে, সমাজতান্ত্রিক চীন প্রায় ১০ লাখ উইঘুরকে বন্দিশিবিরে আটকে রেখেছে, যেটি স্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন। ‘পুনঃশিক্ষা কেন্দ্র (reeducation centres)’ নামে সেখানে উইঘুরদের নির্যাতন করা হয়, অনেকটা বর্বর গুয়ানতানামো বে বন্দিশিবিরের মতো।
অবশ্য চীনের দাবি, এসব কেন্দ্রে মানুষ ‘স্বেচ্ছায়’ পেশাগত প্রশিক্ষণ নিতে আসেন। এরপর তারা তাদের ‘চরমপন্থী’ মনোভাব দূর করতে সাহায্য করে থাকেন।
কিন্তু, ইতিহাস ইসলামের প্রসারে নিরীহ উইঘুরদের পক্ষেই কথা বলে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এখনও এই জনগোষ্ঠীর আলেমরা ইসলামের খেদমত করে চলেছেন। বাংলাদেশও তা থেকে বঞ্চিত হয়নি।
পুরান ঢাকার বকশিবাজারে ঐতিহ্য ও গর্বের সঙ্গে মাথা উঁচু করে আছে খ্যাতনামা সরকারি মাদ্রাসা-ই আলিয়া বা আলিয়া মাদ্রাসা। খ্যাতনামা রাজনীতিক ও আইনজীবী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ঊনিশ শতকে বাংলার মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত ও সমাজসেবক নওয়াব আবদুল লতিফ, কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম মুসলিম বিচারপতি সৈয়দ আমীর আলীর মতো প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বরা ছিলেন এই মাদ্রাসার ছাত্র।
আলিয়া মাদ্রাসার পূর্বদিকে ছাত্রদের আবাসিক ‘আল্লামা কাশগরী (রহ.)’ হল। কিন্তু, কে এই কাশগরী, যার নামে হলের নামকরণ? সেটি অনুসন্ধানেই বেরিয়ে আসে, সোহরাওয়ার্দীদের শিক্ষক ছিলেন এক উইঘুর আলেম। তার নামেই আল্লামা কাশগরী হলের নামকরণ।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত এই আলেম, কবি ও লেখকের পুরো নাম মাওলানা আব্দুর রহমান কাশগরী (রহ.)। তার জন্ম ১৯১২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর চীনের কাশগরে।
কুমিল্লা সিটি কলেজের প্রভাষক ড. শরীফা সুলতানা হাসনাতের লেখা ‘মাদ্রাসা-ই আলিয়ার সোয়া ২শ’ বছরের ইতিহাস’ শীর্ষক বই থেকে জানা যায়, কাশগরের স্থানীয় আলেমদের কাছ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর মাত্র ১১ বছর বয়সে ভারতীয় উপমহাদেশে চলে আসেন আল্লামা কাশগরী।
ভারতে আসার পর ১৯২২ সালে লখনৌর নদওয়াতুল উলামা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানে মাওলানা আব্দুল হাই বেরলভী ও সৈয়দ সুলায়মান নদভীর মতো যুগখ্যাত শিক্ষকদের কাছে তাফসীর, হাদীস, আরবি সাহিত্য বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন তিনি।
এরপর কাশগরী লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফাযেলে আদব ও ফুরকানিয়া মাদ্রাসা থেকে সাত কিরাতের ওপর সার্টিফিকেট লাভ করেন।
১৯৩১ সালে আল্লামা কাশগরী নদওয়াতুল উলামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক নিযুক্ত হন। পরে ১৯৩৮ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার ফিকহ ও আসলে ফিকহের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালে মাদ্রাসাটি ঢাকায় স্থানান্তরিত হলে তিনি এখানে চলে আসেন।
১৯৫৬ সালে আল্লামা কাশগরী ঢাকার মাদ্রাসা-ই আলিয়ার এডিশনাল হেড মাওলানা পদে পদোন্নতি পান। তার মাত্র তিন বছরের মাথায় ১৯৬৯ সালে তিনি হেড মাওলানা পদে আসীন হন। আর অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত তিনি আলিয়া ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন।
আল্লামা কাশগরী চিরকুমার ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল ঢাকায় তার মৃত্যু হয়। পরে আজিমপুর গোরস্থানে দাফন করা হয় এই বিজ্ঞ আলেমকে। পরবর্তীতে মাওলানা কাশগরীর নামেই আলিয়ার ছাত্রাবাসটির নামকরণ করা হয়।
আল্লামা কাশগরীর বিষয়ে জানতে সোমবার বিকেলে মাদ্রাসা-ই-আলিয়ায় যায় পরিবর্তন ডটকমের এই প্রতিবেদক। মাদ্রাসাটির হেড মাওলানার কক্ষে টানানো বোর্ডে চোখ পড়তেই তালিকার ২০ নম্বরে পাওয়া যায় মাওলানা আব্দুর রহমান কাশগরীর নাম। এ ছাড়া তার নামে থাকা হলটিও এখনো মাথা উঁচু করে আছে মাদ্রাসার পাশেই।
মাদ্রাসা-ই আলিয়ার অধ্যক্ষ মো. আলমগীর রহমান পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘মাওলানা কাশগরী একজন উচ্চমানের আলেম ছিলেন। আরবি, ফরাসি, উর্দুসহ বিভিন্ন ভাষায় তার গভীর দখল ছিল। তার সাহচর্য পাওয়া ছাত্ররা সবাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ইসলামের খেদমত করে চলেছেন।’
আল্লামা কাশগরীকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন এমন কেউ এখনো আছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমন কেউ এখনো জীবিত আছেন বলে আমার জানা নেই। তবে বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা আল্লামা কাশগরীর সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি; তিনি ছিলেন খুবই হাস্যরসিক, খোশমেজাজী, অতিথি বৎসল ও নিরহঙ্কার।’
অধ্যক্ষ আরও বলেন, ‘চীনের কাশগর থেকে আসা আল্লামা আব্দুর রহমানের চেহারা অনেকটা চীনাদের মতোই ছিল। তিনি খাটো এবং স্বাস্থ্যবান ছিলেন। শরীরের ভারের কারণে ধীর গতিতে চলাফেরা করতেন। তিনি বিড়াল পুষতেন। বিড়াল সব সময় তার সঙ্গেই থাকতো। তার আধ্যাত্মিকতা বা রুহানি শক্তি ছিল উচ্চমার্গের। যেসব আলেম তার কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছিলেন, তারা সবাই ইসলামের প্রচার বা প্রসারে অবদান রেখে চলেছেন।’
আল্লামা কাশগরীর কাব্যচর্চা
মাওলানা আব্দুর রহমান কাশগরী ছিলেন স্বভাব কবি। তিনি নদওয়াতুল উলামা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবী কবি হিসেবে স্বীকৃতি পান। ১৯৩৪/৩৫ সালে তার ১১০ পৃষ্ঠার কাব্য সঙ্কলন ‘আযযাহরাত’ লখনৌ থেকে প্রকাশিত হয়।
ভাষাতত্ত্ববিদ কাশগরী
কাব্যচর্চার পাশাপাশি আল্লামা কাশগরী ছিলেন একজন ভাষাতত্ত্ববিদ। তার লেখা ‘আল মুফীদ’ তার বড় প্রমাণ। ১৯৬১ সালে আলিয়া মাদ্রাসা থেকে গ্রন্থটির প্রথম খণ্ড আরবী-উর্দু ও বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে বইটির দ্বিতীয় খণ্ডও বের হয়েছিল।
আল্লামা কাশগরীর অপ্রকাশিত বই
মাওলানা আব্দুর রহমান কাশগরীর ৫টি বই অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। বইগুলো হলো- মাহাক্কুন নকদ, আল-মুহাব্বার ফিল মুয়ান্নাসি ওয়াল মুযাক্কার, শে’রু ইবনিল মুকবিল, ইযালাতুল খাফা আনিল খিলাফাতিল খুলাফা ও ফরহাঙ্গে কাশগরী।