ইসলামে প্রতিবন্ধীর সম্মান সমাদর
ধর্ম ডেস্ক
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৫:৫৫ পিএম, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ সোমবার
আল্লাহ তায়ালা আমাদের অসংখ্য ও অবর্ণনীয় নেয়ামতের মাঝে ডুবিয়ে রেখেছেন। তিনি আমাদের সুস্থ রেখেছেন। অথচ অনেক ভাই আছেন অসুস্থ। অনেকে আছেন, যারা মসজিদে আসতে খুব আকাক্সক্ষী; কিন্তু অসুস্থতা হেতু আসতে পারেন না। এ জন্য আমাদের হৃদয়ে আল্লাহর শুকরিয়া থাকা উচিত। যখন একজন মানুষের সবগুলো অঙ্গ সুস্থ থাকে, আমরা তাকে বলি সুস্থ লোক। পক্ষান্তরে আমরা দেখি আল্লাহর প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্তে কিছু মানুষ মায়ের গর্ভ থেকে এমনভাবে দুনিয়ায় আসে হয়তো তাদের দুটি চোখই অন্ধ থাকে, কথা বলার ক্ষমতা থাকে না, হাত-পা নাড়াচাড়া করতে পারে না। মোটকথা কেউ কেউ নানা অসুস্থতা নিয়ে দুনিয়ায় আসেন অথবা দুনিয়ায় সুস্থ অবস্থায় আসার পর অসুস্থ হয়েছেন।
নোয়াখালীর এক যুবক অফিসে ফোন করে আমার মোবাইল নম্বর নিয়েছেন। যখন তার জীবনে হতাশা নেমে আসে, আমাকে ফেন দেন। তার দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাবেন। অথচ একসময় তিনি সুস্থ ছিলেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন তিনি ধীরে ধীরে অন্ধত্বের দিকে চলে যাবেন। ছয় মাসের মধ্যে যা দেখার তা যেন দেখে নেন। প্রচ- হতাশায় তার মাঝেমধ্যেই সুইসাইড করতে ইচ্ছে করে। সৌভাগ্যক্রমে যুবক ভাইটি নামাজি। তার ভেতরে ঈমান আছে।
তিনি আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমার জন্য কি আত্মহত্যা বৈধ হবে? ডাক্তার বলেছে আমি অন্ধ হয়ে যাব, চাকরি করতে পারব না।’ আমি তাকে বলি, ‘আপনাকে এর মাধ্যমে আল্লাহ পরীক্ষা করছেন। আমি প্রত্যেকবারই একজন ব্যক্তির কথা তাকে বলেছি। তিনি বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। যার সব ধরনের প্রতিবন্ধকতাই ছিল। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। শারীরিক বাধা অতিক্রম করে তিনিই এমনসব গবেষণা উপহার দিয়েছেন, যা অসংখ্য সুস্থ মানুষ পারেনি।’
তো এ অসুস্থতাগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ মানুষকে অক্ষম বানান না। তাদের অন্য জায়গায় বিশেষ ক্ষমতা দান করেন। মানুষ যদি এ ক্ষমতা কাজে লাগায়, আল্লাহর ফয়সালায় ধৈর্যধারণ করে, তবে তিনি বাধা জয় করতে পারেন। আর পরকালে তো আল্লাহ তার বিনিময় নির্ধারণ করেছেনই।
আজকাল সমাজে একশ্রেণির অসুস্থকে প্রতিবন্ধী বলা হয়। ‘প্রতিবন্ধী’ একটি নেতিবাচক শব্দ। আধুনিক দুনিয়ায় বলা হয় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন। অর্থাৎ এ লোকটির জন্য বাধা আছে। বস্তুত পৃথিবীর কোনো মানুষের সঙ্গে কোনো মানুষের মিল নেই। আল্লাহ একেজনকে একেকভাবে সৃষ্টি করেছেন। কাউকে ডান হাতে শক্তি বেশি দিয়ছেন, কাউকে বাঁ হাতে। কেউ বাঁ হাতে বোলিং করেন এটা কি তার দোষ? না, এটি আল্লাহর সৃষ্টিবৈচিত্র্য। যাকে আল্লাহ একদিকে কম দেন, অন্য দিকে তা পুষিয়ে দেন। দেখবেন ‘প্রতিবন্ধীরা’ বিশেষ প্রতিভাবান হয়।
আমি জীবনে প্রথমবার অন্ধ দেখি যখন মাদ্রাসায় পড়তাম। তিনি নিজে নিম গাছে উঠে মিসওয়াকের ডাল পেড়ে আনতেন। আমাদের মাদ্রাসা গেটে বসে মিসওয়াক আর আতর বিক্রি করতেন। এর দ্বারা তার জীবিকা নির্বাহ হতো। তিনি মানুষের কাছে হাত পাততেন না।
সৌদি আরবের একটি অন্ধ বালকের কথা বলি। যে সাত বা আট বছর বয়সে কোরআনের হাফেজ হয় আর এগারো বছর বয়সে হাদিসের প্রসিদ্ধ ছয় গ্রন্থেরও হাফেজ হয়ে যায়! গত বছর হজের সফরে মসজিদে হারামে আমি তাকে দেখেছি। কী চমৎকার তার চেহারা। তার সঙ্গে মোসাফাহা করেছিলাম। ইউটিউবে তার এক টিভি সাক্ষাৎকার দেখেছি। উপস্থাপক কোরআনের আয়াতের অংশ বললে সে তা বলে দেয়। সূরার নাম, নম্বর ও পৃষ্ঠা ও পৃষ্ঠার লাইনও বলে দেয়! তার ওস্তাদ তাকে হাদিসের এক অংশ থেকে বলেন আর সে বর্ণনাকারীর নাম দেয়!
আমাদের দেশে কোনো অন্ধ হাফেজ হলে আমরা তাকে ভিক্ষুক বানাই। তাকে উপরে ওঠার পথ না দেখিয়ে পরমুখাপেক্ষী বানিয়ে দেই। এখন প্রতিবন্ধীদের নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। ৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস পালন করা হয়। রাষ্ট্র থেকে প্রতিবন্ধীদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা হয়। প্রতিবন্ধী বিষয়ে আমাদের কয়েকটি পয়েন্ট আমাদের মনে রাখা উচিত।
যার যে অঙ্গ নেই, তার সে অঙ্গ সম্পর্কে অন্তরে একটা কষ্ট আছে। আপনার আমার ভাবতে হবে, আল্লাহ আমার এই অঙ্গগুলো সুস্থ রেখেছেন। আমি আমার সেই অঙ্গ কোন কাজে লাগাচ্ছি? আল্লাহ আমাদের দৃষ্টিশক্তি দিয়েছেন, আমি সেটা কোথায় কাজে লাগাচ্ছি? আমি আমার দৃষ্টিশক্তি কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর সবকিছুই শিখলাম; কিন্তু কোরআনই শিখলাম না। আল্লাহ আমাকে শ্রবণশক্তি দিয়েছেন, আমি কী শুনছি? আমরা একে কাজে লাগাচ্ছি অবৈধ গান, অশ্লীল কথা ও পরনিন্দা শোনায়। সফরে-যানবাহনে একান্ত জিকিরের সময়ও কানে এয়ারফোন লাগিয়ে শুনছি অবৈধ কিছু!
আল্লাহ আমাদের ইচ্ছে করলে দৃষ্টিহীন, বাকহীন তথা প্রতিবন্ধী বানাতে পারতেন। আমরা কি কখনও এর জন্য শোকর করেছি। আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা আল্লাহর নেয়ামত গণনা করো, শেষ করতে পারবে না।’ (সূরা নাহল : ১৮)। তিনি আরও বলেন, ‘নিশ্চয় কান, চোখ ও অন্তঃকরণÑ এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৩৬)। আমরা আমাদের শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তিকে ইতিবাচক ও কাম্য কাজে কতটুকু ব্যবহার করছি?
আল্লাহর মনোনীত দ্বীন প্রতিবন্ধীদের হক নিশ্চিত করেছে। তাদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে তা শিক্ষা দিয়েছে। কোরআন-হাদিসের সাগরে চোখ দিলে আমরা এ সংক্রান্ত অনেক উপাত্ত দেখতে পাই। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ বলেন, ‘আমি যার দুই প্রিয় জিনিস (দুই চোখ) নিয়ে নিয়েছি, তার জন্য জান্নাত রেখে দিয়েছি।’ (বাইহাকি : ৫৩৬৭)।
আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে আল্লাহ আমাদের সুষ্ঠু করলেন ওদের কেন অসুস্থ করলেন? উত্তরে বলা হবে, দুনিয়া হচ্ছে পরীক্ষার জায়গা। আল্লাহ যে ব্যক্তিকে বিশেষ অসুস্থ করেছেন তা তার জন্য পরীক্ষা। তার বাবা-মায়ের জন্যও পরীক্ষা। আমাদের জন্যও পরীক্ষা। আল্লাহ ওই ব্যক্তিকে বিশেষ মর্যাদা দিতে চান। দয়াময় আল্লাহর ভাষ্য- আমি যার দুই প্রিয়তম অঙ্গ নিয়ে নিয়েছি। তারপর সে এই দৃষ্টিহীনতার ওপর সবর করেছে। আল্লাহর কাছে সওয়াব প্রত্যাশা করেছে। আমি তাকে কোনো সওয়াব দিয়েই তৃপ্ত হতে পারব না। আমি তাকে সরাসরি জান্নাত দেব। যদি কোনো ব্যক্তি অন্ধ হন বা অঙ্গহীন হন আর তিনি ঈমান নিয়ে কবরে যেতে পারেন, আল্লাহর ওপর অসন্তুষ্ট না হন, আল্লাহ তাকে কোনো সওয়াব দিয়েই তৃপ্ত হবেন না। আল্লাহ তাকে জান্নাত দেবেন। এ হাদিসটি শোনার পর কারও আর অসুস্থতার জন্য মন খারাপ থাকতে পারে না। এসব রোগকে আমরা কখনও বিপদ ভাবব না। কেউ শারীরিক প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত হলে এমন বলা বৈধ নয় সে বা তার বাবা-মা এই দোষ করেছে তাই আল্লাহ এমন করেছেন। যে বাচ্চাটি পাবিহীন অবস্থায় জন্ম নিল, তার কোনো অপরাধ নেই। তেমনি অসুস্থ বাচ্চাকে কষ্ট করে লালন-পালনের বিনিময়ে আল্লাহ তাকে ও তার বাবা-মাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।
পৃথিবীতে প্রতিবন্ধীদের কথা আল্লাহর ও রাসুল (সা.) এর মতো করে আর কেউ বলেননি। পবিত্র কোরআনের একটি সূরার নাম সূরা আবাসা। আবাসা অর্থ কপাল ভাজ করা। এ সূরার প্রথম কয়েকটি আয়াত এক অন্ধ সাহাবিকে কেন্দ্র করে নাজিল হয়। নবী (সা.) মক্কার কয়েকজন বড় বড় নেতাকে নিয়ে ইসলাম বিষয়ে কথা বলছিলেন। নবীজি (সা.) চাইছিলেন তাদের অন্তরে ইসলাম নিয়ে যেসব প্রশ্ন ও সংশয় আছে যদি তা দূর করে ওরা মুসলিম হোক। তারা ইসলাম গ্রহণ করলে তাদের দেখাদেখি আরও অনেক লোক ইসলাম কবুল করবে। নবী (সা.) তাদের দিকে অনেক মনোযোগী ছিলেন, তিনি চাচ্ছিলেন তারা ঈমান আনুক। এ সময় অন্ধ সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.) এসে উপস্থিত হন। তিনি রাসুলকে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। নবী (সা.) মক্কার নেতাদের প্রতি অতি মনোযোগী হওয়ায় কথায় বিঘ্ন ঘটছিল। কথার মাঝখানে কথা বলায় তিনি কিছুটা বিব্রত ও বিরক্তবোধ করছিলেন। এমন নয় যে, লোকটা অন্ধ, গরিব তাই আল্লাহর রাসুল তাকে গুরুত্বহীন ভাবছেন। বরং তিনি চাইছিলেন উম্মে মাকতুম তো ইসলাম গ্রহণ করেছেই। আমি পরেও তার উত্তর দিতে পারব। এখন কাফের নেতাদের কাছে মনোযোগ দিলে ইসলামের খেদমত বেশি হবে।
তথাপি রাসুল (সা.) এর এ কাজ আল্লাহর পছন্দ হয়নি। আল্লাহ আয়াত নাজিল করে নবীজিকে শুধরে দিয়েছেন। আল্লাহ বলছেন, ‘তিনি ভ্রুকুঞ্চিত করলেন এবং মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কারণ, তাঁর কাছে এক অন্ধ আগমন করল। আপনি কি জানেন, সে হয়তো পরিশুদ্ধ হতো অথবা উপদেশ গ্রহণ করত এবং উপদেশে তার উপকার হতো। পরন্তু যে বেপরোয়া, আপনি তার চিন্তায় মশগুল। সে শুদ্ধ না হলে আপনার কোন দোষ নেই। যে আপনার কাছে দৌড়ে এলো এমতাবস্থায় যে, সে ভয় করে, আপনি তাকে অবজ্ঞা করলেন। কখনও এরূপ করবেন না, এটা উপদেশবাণী।’ (সূরা আবাসা : ১-১১)।