রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১   ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাকাত না দেয়া শাস্তি

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০১:২০ পিএম, ১৯ এপ্রিল ২০১৯ শুক্রবার

মহান আল্লাহ পৃথিবীর মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বৃদ্ধির জন্য জাকাত ফরজ করেছেন।

জাকাত ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম। ঈমান ও ছালাতের পরেই জাকাতের স্থান।  পবিত্র কোরআনে ৩২ জায়গায় জাকাত আদায় করার ব্যাপারে আলোচনা এসেছে। জাকাত না দিলে সম্পদ শুধু ধনীদের কাছে জমা হয়। ফলে সমাজে অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয় এবং ধনীরা ও সূদখোররা জোঁকের মত সমাজের রক্ত শোষণ করে নিজে বড় হয়, আর সমাজকে রক্তহীন করে দেয়। 

 

তাই পবিত্র কোরআন ও সহীহ হাদিছে জাকাত না দেয়ার ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জাকাত না দেয়ার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কেই নিমেন্ কোরআন ও হাদিসের আলোচনা করা হলো-

আল্লাহ তায়ালা বলেন, 

وَلاَ يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللّهُ مِن فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَّهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُواْ بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلِلّهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَاللّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ

‘আল্লাহ তাদেরকে নিজের অনুগ্রহে যা দান করেছেন তাতে যারা কৃপণতা করে এই কার্পন্য তাদের জন্য মঙ্গলকর হবে বলে তারা যেন ধারণা না করে। বরং এটা তাদের পক্ষে একান্তই ক্ষতিকর প্রতিপন্ন হবে। যাতে তারা কার্পন্য করে সে সমস্ত ধন-সম্পদকে কিয়ামতের দিন তাদের গলায় বেড়ী বানিয়ে পরানো হবে। আর আল্লাহ হচ্ছেন আসমান ও যমীনের পরম সত্ত্বাধিকারী। আর যা কিছু তোমরা কর; আল্লাহ সে সম্পর্কে জানেন’।  (সূরা: আলে ইমরান-১৮০)।

আল্লাহ তায়ালা কোরআনুল হাকীমে বলেন, 

قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَاسْتَقِيمُوا إِلَيْهِ وَاسْتَغْفِرُوهُ وَوَيْلٌ لِّلْمُشْرِكِينَ

‘বলুন, আমিও তোমাদের মতই মানুষ, আমার প্রতি ওহী আসে যে, তোমাদের মাবুদ একমাত্র মাবুদ, অতএব তাঁর দিকেই সোজা হয়ে থাক এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। আর মুশরিকদের জন্যে রয়েছে দুর্ভোগ।’

 

الَّذِينَ لَا يُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُم بِالْآخِرَةِ هُمْ كَافِرُونَ

‘যারা যাকাত দেয় না এবং পরকালকে অস্বীকার করে’। (সূরা: হা-মীম সিজদা-৬,৭)।

আল্লাহ আরো বলেন, 

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ إِنَّ كَثِيرًا مِّنَ الأَحْبَارِ وَالرُّهْبَانِ لَيَأْكُلُونَ أَمْوَالَ النَّاسِ بِالْبَاطِلِ وَيَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ اللّهِ وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلاَ يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللّهِ فَبَشِّرْهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٍ

‘হে ঈমানদারগণ! পন্ডিত ও সংসারবিরাগীদের অনেকে লোকদের মালামাল অন্যায়ভাবে ভোগ করে চলছে এবং আল্লাহর পথ থেকে লোকদের নিবৃত রাখছে। আর যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আল্লাহর পথে, তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন’।

يَوْمَ يُحْمَى عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ هَـذَا مَا كَنَزْتُمْ لأَنفُسِكُمْ فَذُوقُواْ مَا كُنتُمْ تَكْنِزُونَ

 

‘সে দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে (সেদিন বলা হবে), এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা রেখেছিলে, সুতরাং এক্ষণে আস্বাদ গ্রহণ কর জমা করে রাখার’। (সূরা: আত-তাওবা-৩৪,৩৫)।

রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি পর্যাপ্ত সোনা, রুপার মালিক অথচ তা থেকে শরীয়তসম্মত প্রাপ্য দেয় না, তাকে কিয়ামতের দিন আগুনের বিছানা বিছিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর সোনা, রুপা আগুনে গরম করে তার কপালে, পিঠে ও দুই পার্শ্বে দাগ দেয়া হবে। যখন ওই স্থানগুলো ঠান্ডা হবে, তখনই আবার দাগ দেয়া হবে। এভাবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান দীর্ঘ এক এক দিন পর্যন্ত দহনক্রিয়া চলতে থাকবে।
তারপর সে বেহেশত অথবা জাহান্নামে যাবে।

সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞাসা করেন, হে রাসূল! উট, গরু, ছাগল প্রভূতির জাকাত না দিলেও কী এরুপ আযাব হবে? রাসূল (সা.) জবাব দিলেন-‘হ্যাঁ’।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, সর্বপ্রথম তিন ব্যক্তি জাহান্নামে যাবে। তারা হচ্ছে- ১.স্বৈরাচারী শাসক, ২.জাকাত দেয় না এমন ব্যক্তি,৩.অহংকারি গরীব। (ইবনে হিব্বান)।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তির নিকট হজ কারার মত সামর্থ তাকা সত্ত্বেও হজ করল না কিংবা জাকাত দেয়ার মত সম্পদ থাকা সত্তেও জাকাত প্রদান করল না, সে মৃত্যুকালে আরেকটু দীর্ঘ হায়াত পেলে আল্লাহর প্রাপ্য হক পরিশোধ করতে পারত বলে আফসোস করবে। জনৈক ব্যক্তি বলল, হে ইবনে আব্বাস! আল্লাহকে ভয় করুন। মৃত্যুকালে কাফেররাই এরুপ আফসোস করবে। ইবনে আব্বাস বললেন, আমি যা বলেছি তার প্রমান হিসাবে আমি এক্ষুণি তোমাকে কোরআনের আয়াত পড়ে শোনাচ্ছি।

আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আমার দেয়া সম্পদ মৃত্যু আসার আগে ব্যয় কর। অন্যথায় সে বলবে, হে আমার প্রভু, আমাকে আরো কিছু কাল  অবকাশ দিলে না কেন? তাহলে আমি সদকা করতাম এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হতাম’। এরপর হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়, জাকাত কখন ফরজ হয়? তিনি বললেন- যখন দুইশত দিরহাম পরিমাণ সম্পদ জমা হয়। (আনুমানিক দশ হাজার টাকার পরিমাণ)। অতঃপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, হজ কীসে ফরজ হয়? তিনি জবাব দিলেন, যখন যাতায়াতের খরচ বহনে সক্ষম হয়। (তিরমিযী,ইবনে কাসির)।

 

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন কিন্তু সে তার জাকাত দেয় না কিয়ামতের দিন সে সম্পদ একটি বিষাক্ত সাপে পরিণত হবে এবং তার গলা পেছিয়ে ধরবে। অতঃপর তার ঠোঁটে কামড়িয়ে ধরে বলবে আমি তোর সম্পদ, আমি তোর পুঁজি। অতঃপর তিনি নিম্নের আয়াত পাঠ করলেন, আল্লাহর দেয়া সম্পদ নিয়ে যারা কৃপণতা করে, তারা যেন ওই কৃপণতাকে নিজেদের জন্য কল্যাণকর মনে না করে। ওটা বরং তাদের জন্য অকল্যাণকর। যে সম্পদকে কেন্দ্র করে তারা কৃপণতা করে, তা কিয়ামতের দিন তাদের গলায় পেঁচিয়ে ধরবে। (সহীহ বুখারি)।

তাবারানীতে বর্ণিত আছে- কিয়ামতের দিন সোনা, রুপা আগুনে পুড়িয়ে উত্তপ্ত করে তাদের কপালে, পিঠে ও পার্শ্বে সেঁক দেয়া হবে। আল কোরআনের এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে হজত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, মুদ্রাগুলো একটির ওপর একটি রেখে সেঁক দেয়া হবে না বরং দেহের চামড়র এত প্রশস্ত করা হবে, যাতে প্রতিটি মুদ্রা একত্রে সেঁক দেয়ার জায়গা হয়।

প্রশ্ন হতে পারে, সেঁক দেয়ার জন্য কপাল, পিঠ ও পার্শ্বদেশকে নির্ধারণ করা হলো কেন? এর জাববে বলা হয় কৃপণ বিত্তবানরা গরীবদেরকে দেখে বিরক্ত হয়ে কপাল কুঞ্চিত করে, মুখ ঘুরিয়ে নেয়। অতঃপর পার্শ্ব দেশ ঘুরিয়ে দেহ বাঁকা করে দাঁড়ায়। তারপর দরিদ্র লোকটি কিছু চাইতে কাছে এলে তার পিঠ ফিরে স্থান ত্যাগ করে। তাই ওই অঙ্গগুলোতে সেঁক দিয়ে কাজের সঙ্গে মিল রেখে শাস্তি দেয়া হবে।

তাবরানীতে আছে হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, পাচঁটি গুনাহের পাচঁটি শাস্তি। সাহাবীগণ বললেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোন পাচঁটি গুনাহের পাচঁটি শাস্তি। রাসূল (সা.) বললেন- যখন কোনো জাতি অংগীকার ভংগ করেব আল্লাহ তাদের শাস্তি  তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবেন। যখনই কোনো জাতি আল্লাহর নাজিল করা বিধান ছাড়া অন্য কনো বিধান অনুসারে শাসন কার্য চালায় আল্লাহ তাদের মধ্যে দারিদ্র্যকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেবেন। যখনই কোনো জাতির মধ্যে অশ্লীলতা-বেহায়াপনা ও ব্যভিচারের প্রচলন ঘটবে, আল্লাহ তাদের মধ্যে মৃত্যুর (অস্বাভাবিক মৃত্যুর) হার বাড়িয়ে দেবেন। যারা ওজনে কম-বেশি করে আল্লাহ তাদেরকে দুর্ভিক্ষ ও ফসলহানীতে ফেলেন। যখনই কোনো জাতি জাকাত দেয়া বন্ধ করবে আল্লাহ তাদেরকে অনাবৃষ্টি কবলিত করবেন।

সম্পদের গর্বে যারা গর্বিত তাদের মনে রাখা উচিত যে, অচিরেই তাদেরকে এ দুনিয়া ও তার সকল সহায় সম্পদ ছেড়ে চলে যেতে হবে। যখন সঞ্চিত সম্পদ পুড়িয়ে পুড়িয়ে তাদের কপালে, পিঠে ও পার্শ্বে সেঁক দেয়া হবে, তা তাদের কোনো উপকারে আসবে না। এ আয়াতটি ভুলে গেলে চলবে না। দরিদ্র ও ভিক্ষুকদের দেখে বিরক্তি প্রকাশ করা উচিত নয়। আল্লাহ ইচ্ছা করলে দরিদ্র লোককে ধনী বানিয়ে দিতে পারেন আবার ধনীকে এক মুহূর্তে দরিদ্রে পরিণত করতে পারেন। 

 

কাউকে দরিদ্র বানানো ও কাউকে বিত্তশালী বানানোর পেছনে আল্লাহর যে গভীর ও মহৎ উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে তা ভুলে যাওয়া উচিত নয়।