রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১   ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তাকওয়া অর্জন : সকল পাপাচার থেকে বাঁচার হাতিয়ার

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০১:২১ পিএম, ১৯ এপ্রিল ২০১৯ শুক্রবার

মুমিনের অন্য নাম হলো মুত্তাকি। মুত্তাকি ছাড়া মুমিন হওয়া যায় না যদিও মুমিন নাম ধারণ করা যায়। মুত্তাকি হতে হলে জীবনের বাঁকে বাঁকে তাকওয়ার সদাই করতে হয়। তাকওয়ার সদাই কী? 

তাকওয়া হলো জীবনের প্রতিটি কাজকর্মের অগ্রপশ্চাতে দিবানিশিতে আল্লাহর ভয়কে অন্তরে জাগরুক রাখা। আল্লাহর ভয়কে অন্তরে জাগরুক রেখে আমলের প্রতিটি স্তর পার হতে পারলেই সে তাকওয়া অবলম্বনকারী মুমিন মুত্তাকি হবে।

 

তাকওয়াকে যদি আমরা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করি তাহলে বলবো- সকল প্রকার অনিষ্ট কাজ থেকে আল্লাহর ভয়ে নিজেকে বাঁচানোর অন্যনামই হলো তাকওয়া। এই তাকওয়ার মধ্য দিয়েই একজন মুমিন পরিশুদ্ধতা লাভ করে। ঈমানশুদ্ধতার আত্মিক সুখ শান্তি লাভ করে। তৌহিদের উপস্থিত প্রফুল্লতায় ভরে উঠে জীবনের চারিধার। তাই একজন মানুষকে মানুষ হতে হলে সর্বাগ্রে তাকে তাকওয়া অবলম্বন করতে হবে। 
তাকওয়াহীন মানুষ হওয়া অসম্ভব। তাকওয়া তথা আল্লাহর ভয় সমাজের কল্যাণকামিতা যদি সদা অন্তরে জীবিত না থাকে, তাহলে তার দ্বারা ভালো কাজের আশা করা যায় না। সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে দুর্নীতি করা যায়, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা যায়, দায়িত্বে অবহেলা করা যায়, আমানতের খিয়ানত করা যায় কিন্তু আল্লাহর চোখকে ফাঁকি দেয়া যায় না, একারণে তাকওয়াহীন মানুষ মানুষই হতে পারে না। 

তাকওয়া কীভাবে অবলম্বন করতে হয়, এর একটি উদাহরণ আমরা নিবো সত্যের মাপকাঠি সাহাবিদের থেকে। একদা হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযি.) হজরত উবাই ইবনে কাব (রাযি.)-কে তাকওয়ার সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। হে উবাই ইবনে কাব! তাকওয়া কী? এর উত্তরে হজরত উবাই ইবনে কাব (রাযি.) বললো হে আমাদের খলিফা আপনি কী কখনো কাঁটাযুক্ত পথে হেঁটেছেন? 
হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযি.) হ্যাঁ, হেঁটেছি
: কীভাবে হেঁটেছেন?
: অতি সতর্কতার সঙ্গে। 
: কীভাবে ওই রাস্তা পার হয়েছেন?
: জামার হাতা গুছিয়ে সাবধানতা অবলম্বন করে বহু পরিশ্রমের সঙ্গে সেই রাস্তা পার হয়েছি। 
তখন উবাই ইবনে কাব (রাযি.) বললো এটাই হচ্ছে ‘তাকওয়া’। 

 

সকল প্রকার গোনাহ থেকে সর্বদা নিজেকে গুটিয়ে শরীর ও মনকে পাপ থেকে অক্ষত রেখে দুনিয়ার জীবন পাড়ি দেয়াই তাকওয়া। 

তাকওয়া অবলম্বন করলে কী হবে? এই কথার উত্তর আমরা আগেই জেনেছি যে, পূর্ণ মুত্তাকি হওয়া যাবে (যে মুত্তাকি হওয়া ছাড়া জান্নাতে যাওয়া যাবে না) এছাড়াও দুনিয়াবী বহু উপকারিতা রয়েছে তাকওয়ার অবলম্বন করার মধ্যে। কী সেই উপকারিতা? 
১. তাকওয়া অবলম্বনকারীকে শয়তানী ষড়যন্ত্র স্পর্শ করতে পারে না-
﴿إِنَّ الَّذِينَ اتَّقَوْا إِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوا فَإِذَا هُمْ مُبْصِرُونَ () وَإِخْوَانُهُمْ يَمُدُّونَهُمْ فِي الْغَيِّ ثُمَّ لَا يُقْصِرُونَ﴾

তরজমা : ‘যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে, তাদেরকে যখন শয়তানের পক্ষ হতে কোনো কুমন্ত্রণা স্পর্শ করে, তখন তারা (আল্লাহকে) স্মরণ করে। ফলে তৎক্ষণাৎ তাদের চোখ খুলে যায়। আর যারা শয়তানের ভাই, শয়তানগণ তাদেরকে বিভ্রান্তির দিকে টেনে নিয়ে যায়। ফলে তারা (বিভ্রান্তি হতে) ফিরে আসে না। (সূরাতুল আরাফ : আয়াত ২০১-২০২)।

একজন খাঁটি মানুষ হতে হলে সর্বপ্রকার শয়তানী থেকে নিজেকে বাঁচাতে হবে। আর শয়তানের শয়তানী থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই তাকওয়া অবলম্বন করতে হবে। যে তাকওয়া অবলম্বন করবে সেই শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাবে। তাই সুন্দর চরিত্রের মূল আকর্ষণে থাকতে হবে তাকওয়া এবং তাকওয়া। তাকওয়া ছাড়া সচ্চরিত্রকে কল্পনা করা যাবে না।
 
২. তাকওয়া অবলম্বনকারীকে আল্লাহ পরিমিত রিযিক দান করেন-
﴿وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا () وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ﴾

 

তরজমা : ‘যে কেউ আল্লাহর ব্যাপারে তাকওয়া অবলম্বন করবে, আল্লাহ তার জন্য সঙ্কট থেকে উত্তরণের কোনো পথ তৈরি করে দিবেন। এবং তাকে এমন স্থান থেকে রিযিক দিবেন যার তার ধারণার বাইরে। (সূরাতুত তালাক : আয়াত- ২)।

কেউ তাকওয়া সম্ভলিত সুন্দর চরিত্র নির্মাণ করতে পারলে তার রিযিকের অভাব হবে না। এই আয়াত থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়। 

৩. তাকওয়া অবলম্বনকারীর জন্য রয়েছে আল্লাহর অফুরন্ত ভালোবাসা ও ভালোলাগা। একজন মানুষের জন্য এর থেকে সুন্দর আর উত্তম কী কোনো প্রতিদান হতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে ভালোবসে? কখনোই তার থেকে উত্তম কোনো প্রতিদান হতে পারেনা। আর এই প্রতিদানটা পাওয়া যাবে চরিত্রের মধ্যে তাকওয়া সম্ভলিত চরিত্র নির্মাণ করলে। দেখুন-
﴿فَإِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ﴾

তরজমা : ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাকওয়া অবলম্বনকারী মুত্তাকিনদের ভালোবাসেন। (সূরাতু আলে ইমরান : আয়াত- ৭৬)

অপর আয়াতে দেখুন- 

﴿وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ﴾

তরজমা : ‘আল্লাহর ব্যাপারে তাকওয়া অবলম্বন করো। জেনে রাখ, আল্লাহ অবলম্বনকারী মুত্তাকিনদের সঙ্গে আছেন’। (সূরাতুল বাকারাহ : আয়াত- ১৯৪)।

৪. তাকওয়া অবলম্বনকারীর ভাগ্যে আল্লাহর নাজান মিলে- দেখুন আলকোরআনে
﴿وَنَجَّيْنَا الَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ﴾

তরজমা : ‘(আগেও) যারা ঈমান গ্রহণ করেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে তাদেরকে আমি রক্ষা করেছি (নাজাত দিয়েছি)’। (সূরাতুল হা-মীম : আয়াত- ১৮)

৫. তাকওয়া অবলম্বনকারী বান্দার আমল কবুল হয়-
﴿إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ﴾

 

তরজমা : ‘আল্লাহ শুধুমাত্র মুত্তাকীদের ইবাদত কবুল করেন’। (সূরাতুল মায়িদাহ : আয়াত- ২৭)। 

৬. তাকওয়া অবলম্বনকারী বান্দার কোন ভয় থাকবে না-
﴿فَمَنِ اتَّقَى وَأَصْلَحَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ﴾

তরজমা : ‘যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে এবং নিজেকে সংশোধন করেছে কিয়ামতের দিন তার কোনো ভয় নেই এবং কোনো দুশ্চিন্তায়ও তাকে গ্রাস করবে না’। (সুরাতুল আরাফ : আয়াত- ৩৫)।

৭. তাকওয়া অবলম্বনকারী বান্দার পুরস্কার বড় করে দেয়া হবে-
﴿وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يُكَفِّرْ عَنْهُ سَيِّئَاتِهِ وَيُعْظِمْ لَهُ أَجْرًا﴾

তরজমা : ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ ওই ব্যক্তির গুনাহ (তার আমলনামা থেকে) মুছে ফেলেন এবং তার পুরস্কারকে বড়ো করে দেন’।  (সুরাতুত তালাক : আয়াত- ৫)।

৮. তাকওয়া অবলম্বনকারী বান্দার কাজ আল্লাহ সহজ করে দেবেন-
وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مِنْ أَمْرِهِ يُسْرًا

তরজমা : ‘যে তাকওয়া অবলম্বন করলো আল্লাহ তার জন্য কাজগুলোকে সহজ করে দেবেন। (সূরাতুত তালাক : আয়াত- ৪)।

৯. তাকওয়া অবলম্বনকারী বান্দার জন্য জমিন ও আসমানের বরকতের দরজা খুলে দেয়া হয়- 
وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنْ كَذَّبُوا فَأَخَذْنَاهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ

তরজমা : ‘যদি এলাকার লোকজন ঈমান গ্রহণ আনায়ন করতো এবং সঙ্গে সঙ্গে তাকওয়া অবলম্বন করতো তাহলে আমি আল্লাহ তাদের আসমান ও জমিনেও বরকাতের দরজাসমূহ খোলে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যাপন্ন করেছে (আমার আয়াতকে) তাদেরকে আমি পাকরাও করবো তাদের অর্জিত পাপের কারণে। (সূরাতুল আরাফ : আয়াত ন- ৯৬)।

১০. তাকওয়া অবলম্বনকারী বান্দার ভেতরে হক বাতিল বুঝার ও পার্থক্য করার বিবেক সৃষ্টি হবে- 
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تَتَّقُوا اللَّهَ يَجْعَلْ لَكُمْ فُرْقَانًا وَيُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ

 

তরজমা :  ‘হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো তোমাদের জন্য আল্লাহ তায়ালা সত্য মিথ্যা হক বাতিল অনুধাবন করার বুঝ দিবেন, তোমাদের থেকে মন্দগুলো দূর করবেন এবং গুনাহসমূহকে ক্ষমা করে দেবেন। মহান আল্লাহ বড়োই দয়ালু ও রহমওলা। (সূরাতুল আনআম : আয়াত- ২৯)।

১১. তাকওয়া অবলম্বনকারী বান্দারা দুনিয়া ও আখেরাতে সুসংবাদ লাভ করে- 
﴿الَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ () لَهُمُ الْبُشْرَى فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ لَا تَبْدِيلَ لِكَلِمَاتِ اللَّهِ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ﴾

তরজমা : ‘যারা ঈমান এনেছে ও তাকওয়া অবলম্বন করেছে- তাদের জন্য পার্থিব ও আখেরাতের সুসংবাদ রয়েছে। আল্লাহ কথা কখনো পরিবর্তণ হবে না। এগুলো মহাসাফল্য। (সূরাতু ইউনুস : আয়াত- ৬৩-৬৭)।