রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১   ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সত্যবাদিতার গুরুত্ব ও পুরুস্কার

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০১:৩০ পিএম, ১৯ এপ্রিল ২০১৯ শুক্রবার

কোনো বিষয়, ঘটনা বা সহজ কথায় যে কোনো কিছুর বর্ণনা যদি সঠিক এবং যথাযথভাবে প্রকাশ করা হয় তবে তাকে সত্য বলে বিবেচিত করা হয়। এই প্রকাশ করাটাই সত্যবাদিতা। 

আর যদি কোনো বিষয়, ঘটনা বা কোনো কিছুর বর্ণনা তার বিপরীতভাবে অর্থাৎ যা হয়নি তা হয়েছে বলে এবং যে কোনো কিছু বিকৃতভাবে , অসম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করা হয় যাতে করে পুরোপুরি সত্যটা অপ্রকাশিত থাকে তবে তা মিথ্যা এবং এভাবে প্রকাশ করাটাই মিথ্যাবাদিতা। 

 

মানুষ সামাজিক জীব। আমরা একে অপরের সঙ্গে চলতে বিভিন্ন কথাবার্তা হয়, লেনদেন হয়। সামাজিক রীতিনীতির ক্ষেত্রেও কথা দেয়া নেয়া হয়। জীবনের চলার পথে প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা যায় আমাদের আলাপ আলোচনা, কথা বার্তা, লেনদেনে জড়িয়ে পড়তে হয়। ব্যবসা না হয় চাকুরী সব ক্ষেত্রে আমাদের হয় সত্যবাদী অথবা মিথ্যাবাদী হওয়ার সুযোগ আছে। তবে যিনি সত্যবাদী হন, তিনি হন বিশ্বস্ত এবং সকলের প্রিয়।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেন ,‘ক্রেতা ও বিক্রেতা পরস্পর পৃথক না হওয়া পর্যন্ত তাদের কেনাবেচা বাতিল করে দেয়ার অধিকার সংরক্ষিত থাকে। যদি তারা উভয়েই লেনদেনে সত্য কথা বলে এবং পণ্য ও মূল্য সম্পর্ক পরিষ্কার বর্ণনা দেয় তবে তাদের বেচাকেনায় মঙ্গল হয় । আর যদি তারা উভয়েই পণ্য এবং মূল্য সম্পর্কে কোনো তথ্য গোপন করে এবং মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নেয় তবে তাদের বেচাকেনায় বরকত বিনষ্ট করে দেয়া হয়।’ (সহিহ বুখারি)।

আমরা জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রে সত্যবাদী ব্যক্তির ওপর নির্ভয়ে নির্ভর করতে পারি। আল্লাহ তায়ালার কাছে ইহকালে এবং পরকালে সত্যবাদী ব্যক্তি পুরষ্কার পেয়ে থাকেন। একজন সত্যবাদী আল্লাহ তায়ালা ও মানুষের কাছে অধিক প্রিয়। 
আল্লাহ তায়ালা সত্যবাদীদের মর্যাদা দিয়েছেন এবং মানুষকে সত্যবাদীদের সাহচর্য নেয়ার জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘হে মোমেনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো।’ (সূরা: তওবা)।  অপরদিকে, মিথ্যাবাদিদের কেউ পছন্দ করেন না এবং কনো ক্ষেত্রেই তাদের ওপর আশ্বস্ত থাকা যায় না। মিথ্যাবাদিতা মানুষকে কুপথে পরিচালিত করে। মিথ্যা এমন এক বিষয় যা প্রমাণ করতে বারবার মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। 

 

মিথ্যাবাদীর চরম পরিণতির কথা  আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন। মিথ্যাবাদী তার পাপের ফল দুনিয়া এবং আখিরাতে পেয়ে থাকে। সত্যবাদী হতে হলে অন্তরে, কর্মে এবং কথায় সমভাবে সত্যতা অবলম্বন করতে হবে। প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেন,‘স্মরণে রেখ, সত্যবাদিতা রক্ষা করো এবং মিথ্যাবাদিতার ধ্বংস সাধন করো।’

সত্যবাদিতার পুরস্কার আল্লাহ তায়ালা নিজেই ঘোষণা করেছেন। জান্নাতে সত্যবাদীদের আল্লাহ তায়ালা সিদ্দিক বলে সম্বোধন করবেন।  আমাদের প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম ছিলেন সত্যবাদিতার বিমূর্ত প্রতীক। আল্লাহ তায়ালা এবং নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম আমাদের সত্য বলতে নির্দেশ দিয়েছেন। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘তোমরা সত্যবাদী হও। কেননা সত্য মানুষকে পুণ্যের পথ দেখায় আর পুণ্য দেখায় জান্নাতের পথ। বান্দা সত্য কথাকে আঁকড়ে ধরলে এক সময় সে আল্লাহর নিকট আল-সিদ্দিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তোমরা মিথ্যা বর্জন কর। কেননা মিথ্যা  মানুষকে পাপের দিকে ধাবিত করে আর পাপ জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। বান্দা মিথ্যার আশ্রয় নিতে থাকলে একসময় আল্লাহর দরবারে মিথ্যাবাদী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।’ (সহিহ মুসলিম : ৪৭২১)।

 

ইয়াহিয়াউল উলুম বিখ্যাত গ্রন্থ যার রচয়িতা ইমাম গাজ্জালি। সেই গ্রন্থে ইমাম গাজ্জালি সত্য, সততা এবং সত্যবাদিতা নিয়ে সুস্পষ্ট এবং সুনিপুণ বর্ণনা লিখেছেন। ইয়াহিমুল গ্রন্থটিতে সত্যবাদিতার ব্যাখায় ইমাম গাজ্জালি একে ছয়টি ভাগে বিভক্ত করেছেন। সেই ছয়টি ভাগ হচ্ছে কথায় সত্যবাদিতা, উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্যে সত্যবাদিতা, সংকল্পে সত্যবাদিতা, সংকল্প পূরণ করার ব্যাপারে সত্যবাদিতা, আমল বা কর্মে সত্যবাদিতা, দ্বীনদারীর ক্ষেত্রে সত্যবাদিতা। মূলত মিথ্যা সকল পাপের উৎস। মিথ্যাবাদী আর মুনাফিকের মধ্যে তফাৎ নেই। মিথ্যা জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মিথ্যা তো তারাই সৃষ্টি করে যারা আমার নিদর্শনগুলোর ওপর আস্থা বা ঈমান রাখে না। প্রকৃতপক্ষে তারাই তো মিথ্যাবাদী।’ (সূরা নাহলঃ ১০৫)।

মিথ্যাবাদী লোকের ঈমান নষ্ট হয়ে যায়। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেন,‘তোমরা মিথ্যা থেকে দূরে থাকো, কারণ মিথ্যা ঈমানের পরিপন্থী।’ (ইবনে আবি শায়বা, হাদিস ২৬১১৫)।

একবার এক পাপী লোক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের দরবারে এসে নবীজি (সা.)- বললো, হে রাসূলুল্লাহ! আমি সবরকম অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। আমি কীভাবে এ চরম পাপাসক্তি থেকে রেহাই পেতে পারি? লোকটির কথা শুনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বুঝলেন, আসলেই লোকটি সুপথে আসার উপায় খুঁজছে। তিনি চিন্তা করলেন, লোকটির মধ্যে যতো রকম অন্যায় কাজ রয়েছে তা যদি আমি বর্জন করতে বলি তাহলে হয়তো তার পক্ষে সবগুলো একসঙ্গে বর্জন করা সম্ভব হবে না। তাই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি আজ থেকে মিথ্যা কথা বলা ছেড়ে দাও। দেখবে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের  এর উপদেশকে সহজসাধ্য ভেবে সন্তুষ্ট হয়ে লোকটি মিথ্যা না বলার প্রতিজ্ঞা করল। এরপর লোক নিজের বাড়ি যাওয়ার পর যখন নামাজের সময় উপস্থিত হলো তখন সে চিন্তা করল এখন যদি আমি নামাজ আদায় না করি এবং আগামীকাল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর কাছে যাই, তখন তিনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, গতকাল তুমি কী নামাজ পড়েছিলে- তখন আমি কী উত্তর দেবো? লোকটি জবাবদিহিতার ভয়ে সময়মতো নামাজ আদায় করল। রাতের বেলায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে মদ্যপান করা লোকটির আরেকটি বদ অভ্যাস ছিল। রাতে মদ্যপানের সময় উপস্থিত হলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম এর কাছে কৃত ওয়াদার কথা তার স্মরণ হয়ে গেল। এসব চিন্তা করে সে মদের গ্লাস ছুঁড়ে ফেলে দিলো। মিথ্যা বলার ভয়ে সে সব রকম পাপ থেকে বিরত রইল। নবীজি (সা.) জানতেন শুধুমাত্র মিথ্যা কথা পরিহার করলেই যে কোনো লোকের পক্ষেই আর খারাপ কাজ করা সম্ভব হবে না। যখন কোনো ব্যাক্তি কোনো খারাপ কাজ করে তখন তার জবাদিহিতা করার ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে নেয়।  খারাপ কাজ করলে তা গোপন করা এবং তা মিথ্যার আশ্রয়ে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়। কাজেই মিথ্যা পরিহার করলে সেক্ষেত্রে আর খারাপ বা অসৎ কাজ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। নবীজি (সা.) বলেন,‘যা তোমাকে সন্দেহে পতিত করে তা ছেড়ে দিয়ে যা তোমাকে সন্দেহে পতিত করে না তাই গ্রহণ কর। কেননা সত্যবাদিতা অবশ্যই প্রশান্তিদায়ক । আর মিথ্যা সন্দেহ সৃষ্টিকারী।’ (হাদিসে তিরমিজি শরীফ)।

 

ইসলাম এমন একটি জীবন ব্যাবস্থা যেখানে জীবনে চলার ক্ষেত্রে প্রতিটি স্তরে সুবিচার করা হয়েছে। ইসলামের ভিত্তি ন্যায়বিচার, সততা ও ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সকল আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম, সাহাবীগণ, আউলিয়াগণ ও তাদের অনুসারীগণ সত্যের পথে ছিলেন অবিচল। যারা সত্যের পথে চলে তারা আল্লাহ তায়ালা হতে ক্ষমা ও অতুলনীয় পুরুস্কার পাবেন। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেন, ‘সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী তাদের জন্য আল্লাহ ক্ষমা ও মহা পুরস্কার প্রস্তত রেখেছেন।’ (সূরা আহযাব, আয়াত:৩৫)।

আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের সত্যবাদীদের সান্নিধ্যে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সহযোগী হও।’(সূরা তাওবা, আয়াত : ১১৯)। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ আরো বলেছেন, ‘ঈমানদাররা! আল্লাহকে ভয় করো আর সঠিক কথা বলো।’ (সূরা আহজাব, আয়াত : ৭০)।

সত্য চিরকাল স্থায়ী হবে। সততার চূড়ান্ত ফল হচ্ছে এটি শুধু দুনিয়াতে নয়, আখিরাতেও মহা পুরষ্কার এনে দেবে। মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যদি আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়াদা তারা সত্যে পরিণত করতো, তবে তা তাদের জন্য কল্যাণকর হতো।’ (সূরা : মুহাম্মাদ, আয়াত : ২১)।

সত্যবাদিতা সর্বদাই মানুষকে সুপথে পরিচালিত করে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘সত্যবাদিতা পুণ্যের রাস্তা দেখায়, আর পুণ্য জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। মানুষ সত্যের অনুসরণ করতে করতে সর্বশেষ আল্লাহর কাছে সিদ্দিক বা সত্যনিষ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মিথ্যা পাপের রাস্তা দেখায় এবং পাপ জাহান্নামের আগুনের দিকে নিয়ে যায়। মানুষ মিথ্যার অনুসরণ করতে করতে আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।’(সহিহ বুখারি)।

যারা মিথ্যের বেসাতী হয়ে চলে আল্লাহ তায়ালা তাদের সৎ পথে পরিচালিত করেন না। পবিত্র কোরআনে এসেছে,  ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মিথ্যাবাদী, অবিশ্বাসীকে সৎপথে পরিচালিত করেন না।’ (সূরা যুমার, আয়াত : ৩)।

এক হাদীসে হজরত আবু সুফিয়ান সাখর ইবনে হারব থেকে বর্ণিত এই যে তিনি রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াসের কাছে এক সাক্ষাতকারে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের বিবরণ দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছেন, হেরাক্লিয়াস জিজ্ঞেস করল, ‘তিনি (মুহাম্মাদ) তোমাদের কী নির্দেশ দেন।’ আবু সুফিয়ান বলেন, ‘আমি বললাম, তিনি বলেন, ‘তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে। তাঁর সঙ্গে কোনো কিছু শরীক করবে না। তোমাদের বাপ-দাদারা যা বলে, তা পরিত্যাগ কর।’ আর তিনি আমাদেরকে সালাত, সত্যবাদিতা, কারো কাছে না চাওয়া ও আত্নীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দেন।’(সহিহ বুখারী ও মুসলিম)।

 

একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের সত্যবাদিতার ফজিলত ও মিথ্যাবাদিতার খারাপ পরিণাম সম্পর্কে জানা উচিত। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সঠিকভাবে আমল করার তওফিক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমিন।