রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১   ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাসূল (সা.) এর নবুওয়াত প্রাপ্তিতেই বিপ্লবের আভাস ছিলো

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০১:৩২ পিএম, ১৯ এপ্রিল ২০১৯ শুক্রবার

আল্লাহ তায়ালার নিকট মনোনীত দিন হচ্ছে ইসলাম। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। এর মধ্যে রয়েছে আকিদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগি, আচার-ব্যবহার, লেনদেনসহ মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে নিয়ে সর্বস্থরের দিক নির্দেশনা।

মুসলমানদের বিশ্বাস হচ্ছে, এই নির্দেশনা সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত। তিনি রাসূল (সা.) এর মাধ্যমে মানব জাতিকে এগুলো অবহিত করেছেন। আর নবি (সা.)-কে যে পদ্ধতিতে অবহিত করা হয়েছে, সেটাকে বলা হয় ওহি। ওলামায়ে কেরাম বলেন, দিনের সবকিছু নির্ভর করে ওহি প্রমাণিত হওয়ার ওপর। কারণ, মানুষকে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন, তাঁর মর্জি মোতাবেক চলে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানে সফলকাম হওয়ার জন্য। আর ব্যক্তির আল্লাহ তায়ালার মর্জি মোতাবেক চলা নির্ভর করে তার মর্জি কোনটি তা জানার ওপর। 

 

আল্লাহ তায়ালার দেয়া বিধিবিধান মেনে চললেই তার মর্জি মোতাবেক চলা হবে। আল্লাহ প্রদত্ত বিধিবিধান সাব্যস্ত হওয়া নির্ভর করে, তার পক্ষ্য থেকে রাসূল (সা.) এর  ওপর ওহি এসেছে এ কথা সাব্যস্ত হওয়ার ওপর। সুতরাং কোনো ব্যক্তির মেনে নেয়া যে, রাসূল (সা.) এর ওপর ওহি এসেছে, এর অর্থ হচ্ছে, রাসূল (সা.) কর্তৃক বর্ণিত বিধিবিধানই, আল্লাহ প্রদত্ত বিধিবিধান। এ বিধিবিধান মোতাবেক চললেই দুনিয়া ও আখেরাতে শান্তি পাওয়া যাবে।

ওহির গুরুত্ব উপলব্ধি করে, মোহাদ্দীসগণ হাদিসের কিতাবে এ সংক্রান্ত স্বতন্ত্র অধ্যায়ই রচনা করেছেন। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও সুন্দর আলোচনা এসেছে সহিহ বোখারিতে। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাইল আল বোখারি (রহ.) স্বীয় সহিহ গ্রন্ত্রে, প্রথম অধ্যায় রচনা করেছেন ওহি সংক্রান্ত বিষয়ে। তিনি ওহির সূচনা ও এর প্রাথমিক ধাপগুলো কেমন ছিলো, এ বিষয়ে সবিস্তর আলোচনা করেছেন।

ইবনে খালদুনের মোকাদ্দমায় ওহির আলোচনা: ইবনে খালদুনের মুকাদ্দমা, যা কিতাবুল ইবারের মুখবন্ধ তাতেও তিনি ওহির আলোচনা করেছেন। অনেক গবেষকের দাবী, এই মুখবন্ধের বিষয়বস্তু হচ্ছে সমাজ, রাষ্ট্র, জাতির উত্থান-পতনের কারণ, রাষ্ট্রের উৎপত্তির কারণ, শাসনের প্রকৃতি, সার্বভৌমত্ব ইত্যাদি। তো ইবনে খালদুন তার মুখবন্ধে ওহির আলোচনা দ্বারা বুঝিয়েছেন ওগুলোও সমাজের বাইরের কোনো আলোচনা নয়। ইবনে খালদুন মানবাত্মাকে তিনভাগে ভাগ করেছেন। 

 

প্রথম হচ্ছে ওই সকল আত্মা, যা আধ্যাত্মিক জগতে পৌঁছতে অক্ষম। ওরা সাধারণত মানবিয়গুণাবলীর নিম্নস্তর নিয়ে পরিতৃপ্ত থাকে। যেমন- পঞ্চইন্দ্রিয়ের ব্যবহার, ধারণাপ্রসূত বিষয় ও বিভিন্ন বিষয়কে বিন্যাস করনের মাধ্যমে অজানা কোনো তথ্য আবিষ্কার করা ইত্যাদি। 

দ্বিতীয় ওই সকল আত্মা, যারা খোদা প্রদত্ত যোগ্যতার দ্বারা আধ্যাত্মিক ও মানুষের পঞ্চইন্দ্রিয়ের বহির্ভূত জগতের দিকে ধাবিত হয়। তো এই আত্মার জানার পরিধি প্রথমটার চেয়ে আরো বিস্তৃত হয়ে থাকে। এই স্তরের ব্যক্তিবর্গ হচ্ছেন ওলিগণ। 
তৃতিয় পর্যায়ে আছে নবিগণের আত্মা। তাদের আত্মাকে ফেরেস্তাতাদের গুণাগুণ দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে, যেন যে কোনো মুহূর্তে বাস্তবিকপক্ষেই ফেরেস্তায় পরিণত হতে পারেন। নবিগণের আত্মায় ফেরেস্তার গুণাবলী যখন আসে তখন তাঁরা উর্ধ্ব জগতের অনেক কিছু দেখতে পারেন। কালামে নফসি ও আল্লাহ তায়ালার সম্বোধন শুনতে পারেন। এই আলোচনা শেষ করে ইবনে খালদুন ওহি সংক্রান্ত অন্যান্য আলোচনা করেছেন। (মুকাদ্দাতু ইবনে খালদুন, ১৩৩)।

ওহির পরিচয়: ওহি আরবি শব্দ, যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে গোপনে কিছু বলে দেয়া। কেউ কেউ ওহির শাব্দিক অর্থ করেছেন, ইশারার দ্বারা দ্রুত বলে দেয়া। ফেরেস্তা যেহেতু গোপনে  এবং খুব দ্রুত নবিগণকে আল্লাহর নিদের্শ পৌঁছে দিতেন তাই এই শব্দ দ্বারা ওহির নামকরণ করা হয়েছে। পরিভাষায় ওহি ওই বাণীকে বলা হয়, যা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে নাজিল হয়। চাই তা ফেরেস্তার মাধ্যমে হোক বা অন্য কোনো মাধ্যমে এবং এতে বাহ্যিক কোনো উপকরণ বা সাধারণ কোনো বিষয়ের দখল থাকে না। (কাশফূল বারি শরহু সহিহিল বোখারি, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-২০১)।

 

রাসূল (সা.) এর ওপর ওহির সূচনার পূর্বে মহাবিশ্বে পরিবর্তন: রাসূল (সা.) ছিলেন সর্বশেষ নবি। তাঁর পর আর কোনো নবি আসবেন না। তাই তাঁর রেখে যাওয়া ব্যবস্থা দ্বারা মানব জাতি কেয়ামত পর্যন্ত নিজেদের জীবন পরিচালনা করবে। তাছাড়া হজরত ঈসা (আ.) এর পর বিশ্বে জাহিলি যে ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে, মুহাম্মাদ (সা.) এর বিপ্লব দ্বারা তা নির্মূল হবে। তাই তাঁর নবুওয়াত প্রাপ্তির আগেই মহাবিশ্বে একটা পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছিলো। যেমন- 

(এক) রাসূল (সা.) এর নবুওয়াত প্রাপ্তির আগে, আল্লাহ তায়ালা ও ফেরেস্তাদের মাঝে বিভিন্ন আলোচনা জিন শয়তানরা শুনতে পেতো। ওরা শুনে এসে গনকদেরকে এগুলো জানাত। গনকরা লোকদেরকে উক্ত বিষয়ের আগাম সংবাদ দিয়ে প্রমাণ করতো গনকরাও অদৃশ্যের খবর জানে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা রাসূল (সা.)-কে নবুওয়াত দেয়ার আগ মুহূর্তে সকল রাস্তা বন্ধ করে দেন। ফেরেস্তাদের দ্বারা কঠোর পাহারাদারির ব্যবস্থা করেন। এই পরিবর্তন দেখে আকাশের জিনরা পর্যন্ত আশ্চার্যান্বিত হয়ে পড়ে। আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর আমরা (জিনরা) আকাশ পর্যবেক্ষণ করেছি, তো তাকে কঠোর প্রহরী ও উল্কাপিণ্ড দ্বারা পরিপূর্ণ পেয়েছি। আমরা (এর আগে আকাশের) বিভিন্ন স্থানে সংবাদ শুনার জন্য বসতাম, এখন যে শুনতে চাইবে, সে দেখতে পাবে এক উল্কাপিণ্ড, যা ওর জন্য ওঁত পেতে আছে। আমরা জানি না (এই কঠোর ব্যবস্থা দ্বারা) পৃথিবীবাসীদের জন্য অমঙ্গল চাওয়া হয়েছে, নাকি তাদের রব তাদেরকে সৎ পথে আনার ইচ্ছা করেছেন।’ (সূরা জিন-৮,৯,১০)।

(দুই) যারা পূর্ববর্তী আসমানি কিতাব সম্পর্কে অবগত ছিলো তারাও বিভিন্ন পরিবর্তন ও আলামতের দ্বারা বুঝতে পেরেছিলো যে, রাসূল (সা.) এর আবির্ভাব হতে যাচ্ছে। যেমন সহিহ বোখারিতে এসেছে, রোমের বাদশা হিরাক্লা একদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠে দুঃশ্চিন্তা করছিলেন। সহযোগীরা তার অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করে, আপনি কিসের জন্য এত পেরেশান? হিরাক্লা বলে, গতকাল আমি দেখতে পেয়েছি, খতনাকারীদের বাদশার আবির্ভাব হচ্ছে। হিরাক্লা তা জানতে পেরেছিলেন, পূর্বের আসমানি কিতাব ও জ্যোতির্বিদ্যার মাধ্যমে। জ্যোতির্বিদ্যা হচ্ছে, মহাকাশ সম্পর্কীয় জ্ঞান। রাসূল (সা.) এর আবির্ভাবের সময় মহাকাশেও পরিবর্তন হচ্ছিলো, যা দেখে হিরাক্লা বাদশা বুঝতে পেরেছিলো আখেরি নবির আবির্ভাব সন্নিকটে।

ওহি নাজিল হওয়ার আগে রাসূল (সা.) এর নির্জনবাস: রাসূল (সা.) এর ওপর ওহি নাজিল হওয়ার সময় যত ঘনিয়ে আসছিলো, ততোই তিনি নির্জনবাসের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠছিলেন। নির্জনতার জন্য তিনি মক্কা থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে হেরা গুহাকে বেছে নেন। জায়গাটি জনপদ থেকে খুববেশি দূরে নয় আবার একেবারে কাছেও নয়। বর্ণিত আছে, হুজুর (সা.) এর দাদাও উক্ত স্থানে নির্জনবাস করতেন। সেখান থেকে বাইতুল্লাহ শরিফ দেখা যায়। বিধায় তিনি নির্জনবাসের জন্য উক্ত স্থানকে নির্বাচন করেন। নির্জনবাসের সময় রাসূল (সা.) এর পদ্ধতি ছিলো, তিনি কিছু দিনের খাবার, প্রয়োজনিয় সামান সঙ্গে নিয়ে যেতেন। মাঝে মাঝে হজরত খাদিজা (রা.) এগুলো পৌঁছে দিতেন। ওগুলো শেষ হয়ে গেলে তিনি পরিবারের কাছে ফিরে আসতেন। সামানা সংগ্রহ করে আবার সেখানে যেতেন। (সহিহ বোখারি-৩) তবে এখান থেকে ভুল বুঝার কোনো সুযোগ নেই যে, ইসলামে বৈরাগ্যতা আছে। কারণ রাসূল (সা.) সুস্পষ্টভাষায় বলে গিয়েছেন ইসলামে কোনো বৈরাগ্যতা নেই।

 

সর্বপ্রথম কোন সূরা নাজিল হয়? রাসূল (সা.) এর ওপর সর্বপ্রথম কোন সূরা নাজিল হয়েছিলো এ ব্যাপারে তিনটি মত পাওয়া যায়। এক. সূরা আলাকের প্রথম কয়েকটি আয়াত। দুই. সূরা মুদ্দাছ্ছিরের প্রথম কয়েক আয়াত। তিন. সূরা ফাতিহা। উলামায়ে কেরাম এই তিনটি মতের মাঝে সমন্বয় করেছেন এভাবে যে, সূরা আলাকের প্রথম কয়েকটি আয়াতই সর্বপ্রথম নাজিল হয়েছিলো। তারপর প্রায় তিনি বছর পর্যন্ত ওহি নাজিল বন্ধ থাকে। তিন বছর ওহি নাজিল বন্ধ থাকার পর আবার যখন ওহি নাজিল শুরু হয় তখন সর্বপ্রথম নাজিল হয় সূরা মুদ্দাছ্ছি। আর পূর্ণাঙ্গ সূরা হিসেবে সর্বপ্রথম নাজিল হয় সূরা ফাতিহা। এতে তিনটি সূরাই প্রথম নাজিল হয়েছে। তবে একেক দিক থেকে একেকটি প্রথম। (কাশফূল বারি শরহু সহিলিল বোখারি, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৩০৫)।

প্রথম ওহি নাজিল হওয়ার পর রাসূল (সা.) এর ভয়: প্রথম ওহি নাজিল হওয়ার পর, নবি করিম (সা.) এর জীবন শংকায় পড়ে যায়। তিনি ভয়ে কাঁপছিলেন। আর বলছিলেন, আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও।  মানুষ কোনো দায়িত্ব পেলে মিষ্টি বিতরন করে। কিন্তু, নবি করিম (সা.) নবুওয়াতের মতো এত সুমহান দায়িত্ব পেয়েও কেন ভয়ে কম্পমান ছিলেন? এর কারণ বিশ্লেষণ করে মুহাদ্দিগণ বলেন, রাসূল ভয় পেয়েছিলেন হজরত জিব্রাঈল (আ.)-কে তার আসল চেহেরায় দেখে। দ্বিতীয়ত, তিনি নবুওয়াতের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার ব্যাপারেও ভয় পাচ্ছিলেন। দায়িত্বের অনুভূতি নবি করিম (সা.) এর মাঝে কতটুকু ছিলো, তা এই হাদিস দ্বারা আন্দাজ করা যায়। পরবর্তীতে তাঁর সহচরদের মাঝেও তা ফুটে ওঠেছিলো। হজরত ওমর (রা.)-কে বলা হলো, আপনার পরবর্তী খলিফা হিসেবে ছেলেকে মনোনীত করে যান। এই প্রস্তাবের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, এই দায়িত্বের হিসাবের জন্য আমার বংশের এই আমি একজনই যথেষ্ঠ। অর্থাৎ আমি ছেলেকে এই দায়িত্ব দিয়ে তাকেও হিসাবের কাঠগড়াই দাঁড় করাতে চাই না। অথচ আমাদের অবস্থার আজ কত অবনতিই না হয়েছে! নিজে অযোগ্য, তবু একটা দায়িত্ব চাই-ই চাই। কারণ এর জবাবদিহিতার চিন্তা আমাদের মাঝে নেই।

হজরত খাদিযা (রা.) নবি করিম (সা.)-কে যা বলে শান্তনা দিয়েছিলেন: নবি করিম (সা.) যখন নিজ জীবনের ব্যাপারে শংকায় ছিলেন, হজরত খাদিযা (রা.) তাকে শান্তনা দিলেন এই কথা বলে যে, আপনাকে আল্লাহ তায়ালা কখনো লাঞ্চিত করবেন না। কারণ, আপনি আত্মীয়দের হক আদায় করেন, প্রতিবন্ধিদের দায়িত্ব নেন, বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন, মেহমানের মেহমানদারী করেন ও ন্যায়ের পথে অটল অবিচল থাকার কারণে যারা বিপদগ্রস্থ হয় তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করেন। এই গুণগুলো থাকার কারণে আল্লাহ তায়ালা আপনাকে লাঞ্চিত করবেন না।

রাসূল (সা.) এর যে সকল গুণাবলীর কথা বলা হলো, কোনো ব্যক্তির চারিত্রিক উৎকর্ষতার সর্ব্বোচ্চ পর্যায় হচ্ছে এটা। কোনো ব্যক্তি যদি এই গুণগুলো নিজের মাঝে ধারণ করতে পারে তাহলে কোনো কিছুই তার ক্ষতি করতে পারবে না। সমাজের সকলের মাঝে তার গ্রহণযোগ্যতা হবে আকাশচুম্বি।