রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১   ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শবেবরাতের প্রামাণ্যতা

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৭:৪১ পিএম, ২১ এপ্রিল ২০১৯ রোববার

মধ্য শাবানের রজনীটি আমাদের দেশে শবে বরাত নামে পরিচিত হলেও হাদিস শরিফে এ রাতটিকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বলা হয়।

দীর্ঘদিন পর্যন্ত রাতটি নিয়ে আমাদের সমাজে ব্যাপক বাড়াবাড়ি ছিল। এ রাতকে কেন্দ্র করে অনেক অমূলক ধারণা ও কার্যক্রম করা হত যা কোরআন হাদিসে নেই। সম্প্রতি আবার কিছু মানুষ এ রাতটি নিয়ে ছাড়াছাড়ি শুরু করেছে। যারা সরাসরি শবেবরাতকে অস্বীকার করছে।

শবেবরাতের ব্যাপারে এক দু’টি নয়; বরং একাধিক সহিহ হাদিস রয়েছে। যেগুলো সর্বসম্মতিক্রমে সহিহ ও নির্ভরযোগ্য। তাছাড়া হাসান ও যয়িফ পর্যায়েরও অনেক হাদিস রয়েছে।

আমাদেরকে একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, হাসান হাদিসও সহিহ ও নির্ভরযোগ্য। কারণ তা সহিহ হাদিসেরই একটি প্রকার। আর যয়িফ বা দুর্বল হাদিস একাধিক সূত্রে বর্ণিত হলে বা একই বিষয়ে একাধিক দুর্বল হাদিস পাওয়া গেলে তাতে এমন শক্তি অর্জন হয় যে, তা সহিহ হাদিসের স্তরে উন্নীত হয়ে যায়। তাছাড়া দুর্বল হাদিসটি যদি অত্যাধিক দুর্বল না হয় এবং দুর্বল হাদিসটির বিরোধী কোনো সহিহ হাদিস না পাওয়া যায়, তাহলে তা ফজিলত প্রমাণের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য। এটি সব ওলামায়ে উম্মতের সর্বস্বীকৃত সিদ্ধান্ত। সুতরাং শবেবরাত বিষয়ে কোনো হাদিসকে যয়িফ বা দুর্বল আখ্যা দিয়ে তা অস্বীকারের অবকাশ নেই।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, শবেবরাতের ফজিলত প্রমাণের জন্য অনেক হাদিসের প্রয়োজন নেই। শুধু একটি সহিহ হাদিসই শবে বরাতের ফজিলত ও মাহাত্ম প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। অথচ শবেবরাতের ফজিলত প্রমাণের জন্য একটি নয়; একাধিক সহিহ হাদিস রয়েছে।

আমাদের দেশে যারা শবেবরাতের ফজিলত অস্বীকার করেন, তাদেরই মান্যবর গবেষক আলেম আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ.) তার লিখিত সিলসিলাতুল আহাদিসিস্ সহিহা গ্রন্থে এ ব্যাপারে সর্বমোট আটটি হাদিস উল্লেখ করেছেন। প্রতিটি হাদিসের সঙ্গে তিনি হাদিসের মান নিয়েও আলোচনা করেন। (যদিও লেখকের দাবি, এ বিষয়ে তিনি একটিমাত্র হাদিস উল্লেখ করেছেন) সর্বশেষ তিনি হজরত আয়েশা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদিস উল্লেখ করে সামগ্রিকভাবে সব হাদিসের ওপর এভাবে মন্তব্য করেন-

‘শবেবরাত সম্পর্কীয় হাদিসের ব্যাপারে সার কথা হলো, শবেবরাত সম্পর্কে বর্ণিত হাদিসগুলো সামষ্টিকভাবে নিঃসন্দেহে সহিহ। হাদিস অত্যধিক দুর্বল না হলে আরও কম সংখ্যক সূত্রে বর্ণিত হাদিসও সহিহ বলে বিবেচিত হয়। হজরত আয়েশা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত এই হাদিসের মানও তাই।

অতএব ‘ইযাহুল মাসাজিদ’ গ্রন্থ প্রণেতা আল্লামা কাসেমী সাহেব কতিপয় হাদিস বিশারদদের উদ্ধৃতিতে যা লিখেছেন যে, ‘শবেবরাতের ফজিলতপূর্ণ কোনো সহিহ হাদিস নেই’ তার এই কথার ওপর আস্থা রাখা উচিত হবে না। তবে কেউ যদি এমনটা বলেই ফেলেন তাহলে বুঝতে হবে অতি চঞ্চলতা হেতু এবং হাদিসের বিভিন্ন সূত্র অন্বেষণে যথাযথ প্রচেষ্টা সীমিত হওয়ার কারণেই এমনটা ঘটেছে। আসলে আল্লাহ তায়ালাই তাওফিক দাতা।’ (সিলসিলাতুস সহিহা ৩/১৩৮-১৩৯)

তাছাড়া শবেবরাতের ফজিলতের ব্যাপারে হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল কর্তৃক বর্ণিত হাদিসটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সব ওলামায়ে কেরামের সম্মতিতে তা সহিহ বলে স্বীকৃত।

হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, (তরজমা) আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে (শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। সহীহ ইবনে হিব্বান (১২/৪৮১, হাদিস নং ৫৬৬৫)

উল্লিখিত হাদিসটি আরও পাওয়া যায়, ইমাম তাবরানী , কাবীর (২০১০৯ হাদিস নং ২১৫), আওসাত (৭/৬৮ হাদিস নং ৬৭৭৬, বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান (৫/২৭২ হাদিস নং ৬৬২৮) ইত্যাদি হাদিস গ্রন্থে।

হাদিসটি সহিহ বলেই আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনে হিব্বান হাদিসটিকে সহিহ কিতাবে নিয়ে এসেছেন। এবং তিনি হাদিসটি উল্লেখ করার পর মন্তব্য করেন, ‘হাদিসটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বর্ণিত অন্যান্য হাদিসের সমর্থনে ‘সহিহ’ বলে বিবেচিত।’

অনেকে বলেছেন, হাদিসটি ‘হাসান’। হাসান হলেও হাদিসটি সহিহ। কারণ ‘হাসান’ হাদিস ‘সহিহ’ তথা নির্ভরযোগ্য হাদিসেরই একটি প্রকার। যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।

হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) কর্তৃক বর্ণিত এই হাদিসটিকে আরব বিশ্বের বিশিষ্ট গবেষক ইমাম হাফেজ নূরুদ্দীন হায়সামীও (রহ.) তার নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ ‘মাজমাউয যাওয়ায়েদ’ এ ‘সহিহ’ বলেছেন। তিনি তার গ্রন্থে এই হাদিস উল্লেখ করার পর মন্তব্য করেন,‘ইমাম তাবরানী স্বীয় হাদিস গ্রন্থ ‘কাবীর’ ও ‘আওসাত’ এ হাদিসটি সংকলন করেছেন। উভয় গ্রন্থে হাদিসের বর্ণনাকারী ‘সিকাহ’ বা নির্ভরযোগ্য। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৮/৬৫)

আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ.) মুয়াজ ইবনে জাবালের হাদিস উল্লেখ করার পর বলেন,‘হাদিসটি সহিহ, সাহাবায়ে কেরামের বিশাল অংশ বিভিন্ন সনদে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, যা একটি অপরটিকে সুদৃঢ় করে।’ (সিলসিলাতুল আহাদিসিস্ সহিহা৩/১৩৫)

এ বিষয়ে শুধু একটি দুটি নয়; বরং আরও অসংখ্য হাদিস বিভিন্ন হাদিসগ্রন্থে পাওয়া। যার কিছু ‘সহিহ’, কিছু ‘হাসান’ ও কিছু ‘যয়িফ’ বা দুর্বল।

সুতরাং ‘আর হাদিসের কিতাবগুলোতেও তেমন শক্তিশালী তথা সহিহ কোনো বর্ণনা নেই’ এ কথা বলে বিষয়টিকে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। বরং এ বিষয়ে বড় বড় সাহাবায়ে কেরাম থেকে হাদিস বর্ণিত আছে। এখানে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হলো। হজরত মুয়াজ বিন জাবাল (রা.), হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.), হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.), হজরত আয়েশা (রা.), হজরত আবু মুসা আশআরী (রা.) হজরত আবু সা’লাবা (রা.), হজরত আবু হুরায়রা (রা.), হজরত আউফ ইবনে মালেক (রা.), হজরত কাছীর ইবনে র্মুরাহ (রা.), হজরত উসমান ইবনে আবীল আস (রা.) ও হজরত আলী ইবনে আবী তালিব (রা.) প্রমুখ।

এ ছাড়া দেশ ও বিদেশের বহু খ্যাতিমান আলেম শবেবরাতের হাদিসগুলোকে সহিহ ও গ্রহণযোগ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। এমনকি শবেবরাতের মর্যাদা অস্বীকার করার ব্যাপারে যাদের অবস্থান খুবই শক্ত, সে সম্প্রদায়ের মান্যবর ওলামায়ে কেরামও শবেবরাতের হাদিসকে সহিহ ও গ্রহণযোগ্য বলতে বাধ্য হয়েছেন।

লেখক: সহকারী মুফতি, জামিয়া রহমানিয়া সওতুল হেরা, টঙ্গী, গাজীপুর।