দুর্বলতা কাটাতে ৯টি আইন সংস্কারের উদ্যোগ
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৭:৫৭ পিএম, ২১ এপ্রিল ২০১৯ রোববার
আর্থিক খাতের দুর্বলতা কাটাতে বড় ধরনের আইনি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর আওতায় আর্থিক খাত পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত ৯টি আইন সংস্কার করা হবে।
এগুলোয় সময়োপযোগী ধারা সংযোজন আর যেগুলো প্রয়োগ করা যাচ্ছে না সেগুলো বাতিল করা হবে। খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানো, বেনামি ঋণ ঠেকানো, পরিচালকদের প্রভাব নিয়ন্ত্রণে আনা, দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূত বা মার্জার করার লক্ষ্যে নেয়া হয়েছে এসব উদ্যোগ। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ব্যাংক কোম্পানি আইন, ব্যাংক জাতীয়করণ অধ্যাদেশ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, অর্থঋণ আদালত আইন, দেউলিয়াবিষয়ক আইন, ব্যাংকার বহি সাক্ষ্য আইন, সমবায় আইন ও নেগোশিয়েবল ইনস্ট্র–মেন্ট অ্যাক্টে পরিবর্তন আসছে। বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে এসব আইনের বিভিন্ন ধারা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় এসব আইনের বিধিবিধানগুলোও পর্যালোচনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এ লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামালকে প্রধান করে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। দশ সদস্যের কমিটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা রয়েছেন। এ কমিটি আইনগুলো পর্যালোচনা করে প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছে। সমস্যা সমাধানের জন্য তারা সুপারিশ তৈরি করছে। সেই সঙ্গে দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কিছু ধারা সংযোজনের সুপারিশ করবে।
এ সরকার টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণ করেই ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কারের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে। এ লক্ষ্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক ও এমডিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এরই আলোকে এসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক খাতে সুশাসনের বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তা দূর করতে সংস্কারের বিকল্প নেই। একটি শক্তিশালী কমিশন করে সমন্বিত সংস্কার করলে সুফল পাওয়া যেত। তিনি বলেন, আর্থিক খাতের প্রচলিত আইনগুলোয় অনেক সমস্যা রয়েছে। এগুলো সমাধান করা গেলে খেলাপি ঋণের প্রবণতা কমানো যেত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংক খাতকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে কমিটি কাজ করছে। এর মধ্যে ঋণের গুণগত মানোন্নয়ন, খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানো ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আইনি সংস্কারের কাজ চলছে।
সূত্র জানায়, ঋণের গুণগত মান বৃদ্ধি ও খেলাপি ঋণ কমাতে কমিটি ব্যাংক কোম্পানি আইন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, অর্থঋণ আদালত আইন ও দেউলিয়াবিষয়ক আইনের বিষয়ে বেশকিছু সুপারিশ তৈরি করেছে। এগুলোর মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায়ের নীতিমালা আরও কঠোর করা হচ্ছে। অর্থঋণ আদালত আইন ও দেউলিয়াবিষয়ক আইনের কিছু ধারা সংশোধন করে খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হয়ে গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করার আগে ব্যাংককে সর্বাত্মক চেষ্টা করার বিধান করা হচ্ছে। একই সঙ্গে মামলায় গ্রাহকের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে রায় হলে এর বিরুদ্ধে আপিল করতে খেলাপি ঋণের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ পরিশোধ করতে হবে। তবে এ হার ২০ থেকে ৩০ শতাংশ করার পক্ষে কমিটির কয়েক সদস্য। ক্ষুদ্রঋণ ছাড়া অন্য কোনো ঋণ যাতে কোনো গ্রাহক পর্যাপ্ত জামানত ছাড়া নিতে না পারে, সে বিষয়েও নতুন বিধান সংযোজন করা হবে। ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে শাখা পর্যায় থেকে আঞ্চলিক ও প্রধান কার্যালয় পর্যন্ত দায়-দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হবে। ঋণখেলাপি হলে সে অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহি করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ের বিষয়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। তাহলে যে আইন আছে, এগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে খেলাপিরা ভয় পাবেন। তখন খেলাপি ঋণ বাড়ার প্রবণতাও কমে যাবে।
সূত্র জানায়, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে বাণিজ্যিক ব্যাংক পরিচালনায় পরিচালকদের জবাবহিদিতা ও দায়-দায়িত্ব বাড়ানো হবে। বড় অঙ্কের ঋণের বিষয়ে বিধিবিধানে সুনির্দিষ্ট করা হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন সংশোধন করে এখানেও পরিচালকদের দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হবে। ব্যাংকের মতো আইনি কাঠামো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয়ও প্রয়োগ করা হবে।
বর্তমানে ঋণ বিতরণের সময় গ্রাহকের কাছ থেকে জামানত বাবদ কিছু চেক অগ্রিম নেয়া হয়। গ্রাহক কোনো কারণে ঋণ শোধ না করলে ওইসব চেক ভাঙিয়ে ব্যাংক ঋণের টাকা সমন্বয় করতে পারে। এসব ক্ষেত্রে প্রায় দেখা যায়, গ্রাহকের হিসাবে টাকা নেই। ফলে চেক ভাঙানো যায় না। এক্ষেত্রে গ্রাহকের বিরুদ্ধে নেগোশিয়েবল ইনস্ট্র–মেন্ট অ্যাক্টের আওতায় মামলা করলে তা নিষ্পত্তি হতেও অনেক সময় লেগে যায়। এ কারণে এ আইনটি সংশোধন করে শাস্তির বিধান বাড়ানো হচ্ছে।
ব্যাংকার বহি সাক্ষ্য আইন আইন সংশোধন করে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং ব্যাংক থেকে নতুন ঋণ নেয়ার সময় গ্রাহকের অন্য ঋণের মান যাচাইয়ের জন্য তথ্য দেয়ার আইন আরও শিথিল করা হচ্ছে।
ব্যাংক জাতীয়করণ অধ্যাদেশ সংশোধন করে সরকারি ব্যাংকগুলোর পর্ষদের দায়-দায়িত্ব বাড়ানো হবে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকেও তদারকি বাড়ানো হবে। এর আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রক হিসেবে ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ মালিক হিসেবে তদারকি করবে। কমিটির এক সদস্য জানান, আইনি কাঠামো সংস্কারের বিষয়ে তারা সুপারিশ করার কাজ করছেন। এর ভিত্তিতে পরে মন্ত্রণালয় কাঠামো চূড়ান্ত করবে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ সংশোধন করে আর্থিক খাত তদারকিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা বাড়ানো হবে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তদারকি করে। এর বাইরে বিশেষ আইনে কয়েকটি ব্যাংক পরিচালিত হচ্ছে। এগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেই। সংশোধনীতে আর্থিক ব্যবস্থাপনার সব খাতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ করার সুযোগ রাখা হচ্ছে।