রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১   ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তা ছিন্ন করার পরিণাম

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৩:৫৫ পিএম, ২২ এপ্রিল ২০১৯ সোমবার

আত্মীয়তা-সম্পর্ক বলতে বুঝানো হয়, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে এবং এসবের উর্ধ্বতন ও নিম্নতন আত্মীয়।

আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করা যে জরুরি, আত্মীয়তা-সম্পর্ক ছিন্ন করা যে হারাম আর আত্মীয়দের ভালো-মন্দের খোঁজ-খবর রাখা, বিপদাপদে তাদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের সার্বিক কল্যাণ কামনা করার ফযীলত সম্পর্কে কোরআনে কারিমে এবং হাদিসে অনেক বাণী উল্লিখিত হয়েছে। 

আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন, আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার নামে তোমরা এক অপরের কাছে কিছু চাও এবং রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্কে সর্তকতা অবলম্বন কর। অর্থাৎ রক্ত সম্পর্কীয় সম্পর্ক ছিন্ন করো না। (সূরা আন-নিসা)

আল্লাহ আরো বলেন, পৃথিবীকে অনর্থ সৃষ্টি করবে এবং রক্ত সম্পর্কীয়  আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে- এসব যারা করে, তাদের প্রতিই আল্লাহ অভিসম্পাত করেন। অতঃপর তাদেরকে বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন করে দেন। (সূরা-মুহাম্মাদ,আয়াত-২২,২৩)।

আল্লাহ আরো বলেন, ‘তারাই তো জ্ঞানবান যারা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পূরণ করে এবং অঙ্গীকার ভঙ্গ করে না। আর আল্লাহ আত্মীয়তার যে সম্পর্ক রক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছেন, যারা তা অক্ষুন্ন রাখে, তাদের পালনকর্তাকে ভয় করে এবং কঠোর হিসাবের ভয় রাখে। (সূরা আর-রাদ,আয়াত-২০,২১)।

আল্লাহ পাক আরো ঘোষণা করেন, ‘এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালা অনেককে বিপথগামী করেন, আবার অনেককে সঠিক পথও প্রদর্শনও করেন। বস্তুতঃ তিনি অসৎ ব্যক্তিবর্গ ছাড়া কাউকে বিপথগামী করেন না। বিপথগামী ওরাই, যারা আল্লাহর সঙ্গে অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করে, আল্লাহ যে সম্পর্ককে অক্ষুন্ন রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তা ক্ষুন্ন করে এবং  পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে। তারাই যথার্থ ক্ষতিগ্রস্ত।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-২৬৭, ২৭)।

বস্তুত আল্লাহ পাক যে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখার আদেশ করেছেন,সেগুলোই হচ্ছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।

সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তার বন্ধন ক্ষুন্নকারী কখনো জান্নাতে যেতে পারবে না।’ সুতরাং যে লোক নিজের অসহায়, দরিদ্র আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, যে তাদেরকে পরিত্যাগ করে, তাদের প্রতি অহংকার ও দম্ভ করে সে বিত্তবান আর তারা দরিদ্র, এ ধরনের অবস্থায় সে দয়া-দাক্ষিণ্য ও সহায়তার বন্ধনে চিড় ধরায়, উল্লেখিত হুঁশিয়ারি ও সতর্কতা অনুযায়ী সে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি পাবে না। শুধু আল্লাহর কাছে তওবা ও আপনজনদের সঙ্গে সদাচরণের মাধ্যমে সম্পর্কোন্নয়নের দ্বারাই এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের আশা করা যেতে পারে।

আর এক হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন দুর্বল-দরিদ্র, সে যদি তাদের প্রতি বদান্যতা না দেখিয়ে বরং নিজের দান-সদকা তাদেরকে না দিয়ে (দূরের) অন্য কাউকে দেয়, আল্লাহ তার দান-দক্ষিনা কবুল করবেন না এবং হাশরের দিন তার দিকে দৃষ্টিপাতও করবেন না।’(তাবারানী)।

যদি নিজেই দরিদ্র হয়, তথাপি আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ এবং খোজ-খবর রাখার মাধ্যমে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করা উচিত। কেননা রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘সালাম দেয়ার মাধ্যমে হলেও তাদের সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখ।’ (তাবারানী)।

রাসূল (সা.) আরো বলেন, ‘যে লোক আল্লাহ ও পরকালের ওপর বিশ্বাস রাখে, সে যেন রক্ত সম্পর্কীয়তার সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখে ‘ (বুখারী, আবু দাউদ, তিরমিযী)।

আর এক হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, ‘অনুগ্রহের প্রতিদানে অনুগ্রহ প্রদর্শনকারী রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তার রক্ষক নয়, বরং যে লোক বিচ্ছিন্ন সম্পর্ক নতুন করে গড়ে তোলে, সেই-ই উক্ত সম্পর্কের রক্ষক।’

হাদিসে কুদসীতে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ পাক বলেন, আমার নাম ‘রহমান’(পরম দয়ালু),আর আত্মীয়তার সম্পর্ককে বলা হয় ‘রহন’,যে লোক তা অক্ষুন্ন রাখে আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করি। আর যে তা অক্ষুন্ন করে, আমিও তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন।’ (আবু দাউদ, তিরমিযী)।

হজরত আলী (রা.) তার ছেলেকে বলেছিলেন, ‘ওহে বৎস! কখনো রক্ত সম্পর্ক ছিন্নকারীর সঙ্গে চলো না। কেননা আমি আল্লাহর কিতাবে তিন জায়গায় তাদেরকে অভিশপ্ত আখ্যায়িত হতে দেখেছি।’ (আবু দাউদ, তিরমিযী)।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) এবারে এক সভায় রাসূল (সা.) এর হাদিস বর্ণনা কালে বলেন, ‘আত্মীয়তার ম্পর্ক ছিন্নকারী এ সভা ছেড়ে চলে যাও। কেননা তার সঙ্গে একত্রে বসতে আমি বিরক্তি বোধ করি।’ একথা শুনে সভাস্থলের পেছন দিক থেকে উঠে চলে গেল। সে তার ফুফুর কাছে গেল। যার সঙ্গে সে বহু বছর ধরে সম্পর্ক ছিন্ন করে রেখেছিল। সে তার বিরোধ মিটিয়ে আবার সম্পর্ক বহাল করলো। ফুফু জানতে চাইল, ‘বেটা! কী কারণে তুমি এ কাজ করলে?

সে জবাব দিল, আমি রাসূল (সা.) এর ঘনিষ্ঠ সাহাবী হজরত আবু হুরায়রা (রা.) এর সভায় বসেছিলাম। তিনি বললেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী এ সভাস্থল ছেড়ে চলে যাও।’ তার ফুফু বললেন, ‘তুমি হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ.) এর কাছে গিয়ে জেনে নাও যে নির্দেশ দানের কারণ কী?’ সে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) এর কাছে ফিরে এসে সব বিস্তারিত  বলে জিজ্ঞেস করল, ‘আত্নীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী আপনার কাছে এস বসতে পারবে না কেন?’ হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বললেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি এমন সভাস্থলে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয় না, যে সভায় রক্ত সম্পর্ক ক্ষুন্নকারী কোনো লোক থাকে।

কাহিনী: কথিত আছে, একবার এক বিত্তবান লোক হজে গিয়েছিল। মক্কা শরীফে পৌছে সে খুবই বিশস্ত ও সৎ লোক বলে পরিচিত এক লোকের কাছে নিজের এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা গচ্ছিত রাখলো। পরে সে আরাফাত থেকে ফিরে এসে দেখলো, লোকটি ইন্তেকাল করেছে। তার পরিবারে লোকদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো, তারা তার গচ্ছিত রাখা স্বর্ণমুদ্রার ব্যাপারে কিছুই জানে না। অতৎপর সে মক্কা নগরির বিশিষ্ট আলেমদের কাছে সব কথা জানিয়ে পরামর্শ চাইল। তারা তাকে পরার্শ দিলেন,  তুমি গভীর রাতে যমযম কূয়ার কাছে গিয়ে তার নাম নিয়ে ডাক দাও, যদি সে বেহেস্তী হয়, তবে প্রথম ডাকেই সাড়া দিয়ে তোমার মুদ্রার ব্যাপারে বলবে। লোকটি মধ্যরাতে যমযম কূয়ার পাশে যেয়ে বহু ডাকডাকি করেও কোনো সাড়া পেল না। অবশেষে আলেমদের কাছে ফিরে এলো। তারা বললেন, ‘ইন্না লিল্লাহি’ আমাদের আশংকা হচ্ছে, তোমার বন্ধু সম্ভবত দোযখী হয়েছে। তুমি ইয়ামানে চলে যাও। সেথায় বারহুত নামে একটি কূয়া আছে। বলা হয়ে থাকে, উক্ত কূয়াটি জাহান্নামের মুখে অবস্থিত এবং সেখানে পাপীদের রুহ বিচরণ করে। মধ্যরাতে তুমি সেখানে গিয়ে ডাক দাও। সে জাহান্নামি হলে তোমার ডাকে সাড়া দেবে।

অতৎপর সে ইয়ামানে এস বহু খোঁজাখুঁজি করে উক্ত কূয়ার সন্ধান পেয়ে মধ্যরাতে কূয়ার পাশে গেল এবং মৃত লোকটির নাম ধরে ডাক দিতিই সে তৎক্ষণাত সাড়া দিল। লোকটি জিজ্ঞেস করল, আমার এক হাজার  স্বর্ণমুদ্রা কোথায় রেখেছ? সে বলল, ‘আমার ঘরে অমুক স্থানে আমি তা পুতে রেখেছি। আমার ছেলেদের বিশ্বস্ত মনে করিনি বলে তাদের কাছে রাখিনি। তুমি আমার বাড়ি গিয়ে উক্ত স্থানে খুড়লেই তোমার মুদ্রাগুলো পেয়ে যাবে। তুমি তা নিয়ে নাও।’ সে বলল, তুমি এখানে কেন? আমরা তো তোমাকে সৎ লোক হিসাবেই জানতাম। সে জবাব দিল, আমার এক অসহায় অভাবগ্রস্থ বোন ছিল। আমি কখনো তার খোজ-খবর নেইনি, তাই মহান আল্লাহ আমায় এ শাস্তি দিয়েছে।