সহীহ হাদিসে শবে বরাতের করণীয়-বর্জনীয়
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৩:৫৮ পিএম, ২২ এপ্রিল ২০১৯ সোমবার
সব কিছুরই একটি মৌসুম থাকে। থাকে একটি সুনির্দিষ্ট কাল। এমনিভাবে আমাদের ধর্মসৌরভেও আছে আমলের কাল। আছে আমলের বসন্ত। যেমন ধরুন, রমজান ঈমানদার বান্দাদের জন্য আমলের বসন্ত।
আমলে আমলে মুমিন বান্দা পাড় করে রমজানের প্রতিটি সময়খণ্ড। এমনই একটি আমলের কাল হলো শবে বরাত। অনেকের ধারনা শবে বরাত বলে আমলের কোনো দিনক্ষণ নেই। আসলে তা ঠিক নয়। আমরা যদি ধরেও নিই, শবে বরাত বিষয়ের হাদীসগুলো রেওয়াতের দিক দিয়ে অতিদুর্বল, তাহলেও বলবো আমল যে কোনো সময়ই আপনি করেন না কেন, তার বদলা আপনি পাবেন-ই। তাই অযথা বিতর্কে না জাড়িয়ে আমলের দিকেই মনোনিবেশ করা ভালো।
আর বিষয়টি তো এমন নয় যে, এটা বিদআত ও শরীয়ত পরিপন্থী কাজ। আসুন শবে বরাত সম্পর্কে প্রথমে একটি নির্ভরযোগ্য হাদিস শুনি- হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম আবু হাতিম মুহাম্মাদ ইবনে হিব্বান তার জগৎ বিখ্যাত হাদিসগ্রন্থ সহীহ ইবনে হিব্বানে; হজরত মু’য়াজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে (শবে বরাত) তাঁর সৃষ্টির প্রতি মনযোগী হন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যক্তি ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। দেখুন সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস, হাদীস- ৫৬৬৫। শুধু তাই নয় এই এই হাদিসটি ইবনে মাযাহ, হাদীস-১৩৯০, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ, হাদীস - ৩০৪৭৯, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস- ৬২০৪ অনুরূপভাবে বর্ণিত রয়েছে।
এখন কথা হলো হাদীসটি সম্পর্কে হাদীস শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ ইমামগণ বলেছেন এটি সহীহ। তাতে কোনো দুর্বলতা নেই। এমনও উল্লেখ আছে যে শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে অন্য হাদিস নাও থাকতো তবুও যথেষ্ঠ ছিলো। দেখুন- কিতাবুস সুন্নাহ ১/২২৪, আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব ২/২৪১ এ ছাড়াও হাদিস শাস্ত্রের বহুগ্রন্থ ও হাদিস বিশারদদের বর্ণনায় শবে বরাতের ফজিলতে কথা জানা যায়। শাইখ আলবানী (রহ.) কৃত সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহাহ এর ৩/১৩৫-১৩৯ পর্যন্ত এই হাদীসের সমর্থনে আরো সাতটি হাদীস এনেছেন। আর আলবানী (রহ.) লিখেন এ সব বর্ণনার মাধ্যমে এই হাদিসটি নিঃসন্দেহে সহীহ প্রমাণিত হয়। আর সহীহ হওয়ার জন্য এতো ব্যাপক সমর্থন লাগেনা, এর চেয়ে কমের দ্বারাও সহীহ প্রমাণিত হয়ে যায় যদি তার মাঝে বড়ো ধরণের কোনো আপত্তি না থাকে। যেমন আমাদের উল্লিখিত হাদীসটি। শাইখ আলবানী (রহ.) এর বিশ্লেষণেও উক্ত হাদীসটি সহীহ প্রমাণিত হলো। এখন আমল করা না করা আপনার ব্যাপার!
দ্বিতীয় হাদীসটি ইমাম ইবনে মাযাহ (রহ.) তার কিতাবে এনেছেন। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম ইরশাদ করেন, অর্ধ শাবানের রাত যখন আসে তখন তোমরা এ রাতে ইবাদত বন্দেগীতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখো। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা এ রাতে সূর্যাস্তের পর প্রথম আসমানে আসেন এবং বলতে থাকে যে, আছে কী কোনো ক্ষমাপ্রার্থী, আমি তাকে ক্ষমা করবো। আছে কী কোনো রিযিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিযিক দিব। আছে কী কোনো বিপদগ্রস্থ, আমি তাকে বিপদমুক্ত করে দিব। এমনি এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত বলতে থাকেন। হাদীসটি আছে- সুনানে ইবনে মাযাহ, হাদীস : ২৩৮৪, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস : ৩৮২২। সনদের বিচারে হাদীসটির মান দুর্বল হলেও আমলের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই। কারণ সকল হাদীস বিশারদগণ এ ব্যাপারে একমত যে, হাদীস দুর্বল হলেও তার ওপর আমল করার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই।
এছাড়াও আরো অনেক হাদিস রয়েছে শবে বরাতের ফজিলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে। সুতরাং আমলকারী এবং আল্লাহর নৈকট্য অন্বেষণকারী কোনো মুসলমান এ রাতে আমল থেকে বিরত থাকতে পারে না। রাতের ফজিলত সম্পর্কে প্রথম হাদীসটিই প্রমাণ করে এরাতের গুরুত্ব কতোটুকু। সে রাতে আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি মনযোগী হন এবং কাফের মুশরিক বেঈমান ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন। একথা শুনেও কী কোনো মুসলমান শবে বরাতের আমল ছেড়ে ঘুমাতে পারে? অন্য একটি হাদিসে হজরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত। তাতে আছে- এক রাতে রাসূল নামাজে দাঁড়ালেন। দীর্ঘ কেরাত আর এতো দীর্ঘ সিজদায় ছিলেন যে আমার আশঙ্কা হয়ে গেছে তার জীবনের ওপর! তখন আমি উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়ালাম, তাঁর আঙ্গুলগুলোও নড়লো। আমি নিশ্চিত হলাম। যখন রাসূল নামাজ শেষ করে বললেন, হে আয়েশা অথবা বললেন, ওহে হুমায়রা! তোমার কী এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূর তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসূলুল্লাহ; আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলবেন, তুমি কী জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসূলই ভালো জানেন। তিনি তখন বললেন- এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত। (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত) আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে তার বান্দাদের প্রতি মনযোগ দেন, ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই। ইমাম বায়হাকী (রহ.) এই হাদীসটি বর্ণনা করার পর এর সনদের ব্যাপারে বলেন হাদীসটি মুরসাল তবে তার সনদ সেরা ও উৎকৃষ্ঠ মানের। দ্রষ্টব্য শুয়াবুল ঈমান ৩/৩৮২-৩৮৩। ক্ষমার এতোপষ্ট ঘোষণার পরও কী কোনো মানুষ এ রাতে আমল ছাড়া থাকতে পারে? অবশ্যই না। তবে এ রাত সম্পর্কে যে বাড়াবাড়ি সমাজে আছে তা অবশ্যই বর্জনীয়।
আমরা এখন এ রাতের করণীয় বিষয়গুলো সন্নিবেসিত করছি-
১. মাগরিব ও ফজরের নামাজ যেন অবশ্যই জামাতের সঙ্গে হয়
২. সাধারণভাবে যে নিয়মে নফল নামাজ পড়া হয় সেভাবেই নফল পড়া অর্থাৎ দুই রাকাত করে যার রাকাত সম্ভব হয় পড়বে। শবেবরাতের নির্দিষ্ট কোনো নামাজ নেই, আমলও নেই। নিয়তের মাঝেও কিছু অতিরিক্ত করার কথা শরীয়তের কোথাও নেই
৩. তাওবা করা
৪. কোরআন শরীফ বেশি থেকে বেশি তেলাওয়াত করা
৫. দরুদ পড়া
৬. যিকির আযকার করা ও বেশি করে ইসতিগফার পড়া
৭. এ রাতে খুববেশি গুরুত্বের সঙ্গে দোয়া করা; কেননা এ রাতে দোয়া কবুল হওয়ার কথা হাদিসে অনেকবার এসেছে
৮. সম্ভব হলে কিছু সদকা করা
৯. মৃতদের জন্য দোয়া করা
১০. পরদিন রোজা রাখা।
এ রাতের বর্জনীয় বিষয়গুলো-
১. আতশবাজি, পটকা, তারাবাতি ইত্যাদি ফুটানো
২. মসজিদ, মাদরাসা, ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে আলোকসজ্জা করা
৩. এ রাতের উপলক্ষে অপচয় না করা
৪. বিধর্মীদের সঙ্গে সদৃশ্য হয় এমন কাজ করা
৫. খিচুরি বিরানী হালুয়া রুটি পাকানো
৬. দলবেঁধে এক মসজিদ থেকে অন্য মসজিদে গমন করা
৭. এ রাত উপলক্ষে মেহমান দাওয়াত করা
৮. এ রাত উপলক্ষে সফর করা থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি
আল্লাহ আমাদরে সবাইকে এ রাতের যথাযথ মর্যাদা রক্ষা করে একাগ্রতার সঙ্গে তাঁর ইবাদত করার তওফীক দার করুন। আল্লাহুম্মা আমীন।