দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ‘মূর্তিমান আতঙ্ক’ চুন্নুসহ গ্রেফতার ২৪
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৯:৩০ এএম, ২৩ এপ্রিল ২০১৯ মঙ্গলবার
ফতুল্লা থানা পুলিশের বিশেষ অভিযানে র্যাব, পুলিশের তালিকাভুক্ত দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী এলাকাবাসীর ‘মূর্তিমান আতঙ্ক’ মোফাজ্জল হোসেন চুন্নু (৪৪)সহ ২৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ সময় চুন্নুর কাছ থেকে ৫ শতাধিক ইয়াবা ট্যাবলেট ও একটি বিদেশী পিস্তলসহ উদ্ধার করা হয়।
শনিবার দিবাগত রাত ১০টার দিকে চুন্নুকে কুতুবপুর নয়ামাটি এলাকার তার নিজ বাসার সামনে থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ সময় চুন্নুকে ছাড়িয়ে নিতে তার বাহিনীর সদস্যরা পুলিশ উপর হামলা চালালে ৫ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়। তাদেরকে খানপুর ৩০০ শয্যা হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
গ্রেফতারকৃত চুন্নু ফতুল্লার নয়ামাটি এলাকায় মৃত আবু তালেব হোসেন পুইক্কার ছেলে। তার বিরুদ্ধে ফতুল্লা মডেল থানার ১০ টি মামলাসহ বিভিন্ন থানায় ১৯ টি মামলা রয়েছে বলে জানা যায়।
ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশের সুত্রে জানা যায়, এ ঘটনায় চুন্নুর বিরুদ্ধে একটি অস্ত্র ও একটি মাদক মামলা দায়ের করা হয়। চুন্নু ছাড়া মামলায় আরো অজ্ঞাত ১৫ থেকে ২০ জনকে আসামি করা হয়।
ফতুল্লা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আসলাম উদ্দিন চুন্নুকে গ্রেফতার ও মামলার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদের নির্দেশে ফতুল্লার চাঁদমারী, মাসদাইর, পঞ্চবটি সহ বেশ কয়েকটি এলাকায় মাদক বিরোধী বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়।
অভিযানে চুন্নুকে কুতুবপুর নয়ামাটি এলাকায় তার নিজ বাড়ির সামনে থেকে ওই বিদেশী পিস্তল ও ইয়াবাসহ গ্রেফতার করা হয়।
এ ছাড়াও আরো ২৩ জন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ২৩ গ্রাম হেরোইন, ৭০ পিছ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়ছে। শনিবার দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এ অভিযান পরিচালিত হয়।
উল্লেখ্য, মোফাজ্জল হোসেন চুন্নুর সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারনে তার নামের আগে সংযুক্ত হয়েছে ‘দুর্ধষ’ শব্দটি। বর্তমানে এলাকাবাসীর কাছে সে ‘মূর্তমান আতঙ্ক’।
কারো কারো কাছে ‘অস্ত্রবাজ’ হিসেবে রয়েছে তাঁর খ্যাতি। কোনো কোনো মহলের কাছে সে ‘শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী’। এছাড়াও একজন ভূমিদস্যু হিসেবেও এলাবকাবাসীর কাছে পরিচিতি রয়েছে তাঁর।
লামাপাড়া নয়মাটি এলাকার সাধারণ মানুষদের অভিযোগ, একাধিকবার র্যাব পুলিশের হাতে অস্ত্র, মাদকসহ গ্রেফতারও হয়েছিলো এই সন্ত্রাসী। তবে প্রতিবার গ্রেফতারের পর সে আরও বেশি দুর্ধর্ষ হয়ে ফিরে আসে এলাকাতে।
কোনো পদপদবী না থাকলেও তিনি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সহযোগি সংগঠন যুবলীগ নেতা। ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তাঁকে মিছিল নিয়েও যোগ দিতেও দেখা গেছে।
এছাড়াও লামাপাড়া এলাকায় সাংসদ শামীম ওসমানের ছবি সম্বলিত ব্যানার ফেস্টুনও টাঙিয়েছিলো সে নিজেকে যুবলীগ নেতা দাবি করে। সেসব ফেস্টুনে সাঁটানো ছিলো তাঁর নিজেরও ছবি।
স্থানীয়রা বলছেন, একসময় বিএনপির সহযোগি সংগঠন যুবদলের নেতা ছিলেন মোফাজ্জল হোসেন চুন্নু। তাঁর উত্থান সেসময় তথা জোট সরকার আমল থেকে। এরপর জোট সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে রাতারাতি বোল পাল্টে বনে যান যুবলীগ নেতা।
কথিত আছে, নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতার শেল্টারেই নিজের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসী চুন্নু।
ক্রসফায়ারে নিহত র্দুর্ধষ কিলার রেকমত বাহিনীর প্রধান রেকতম নিহত হওয়ার পর তাঁর অস্ত্রভান্ডারের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে তাঁরই উত্তরসূরি মোফাজ্জল হোসেন চুন্নুর কাছে।
স্থানীয়দের মতে, চুন্নু ও তাঁর বাহিনীর কাছে অজ¯্র পরিমাণের আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। যার কিছু একাধিকবার উদ্ধারও করেছিলো র্যাব ও পুলিশ।
লামাপাড়া নয়ামাটি এলাকা ঘুরে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে মোফাজ্জল হোসেন চুন্নু অপরাধ সা¤্রাজ্যের কথা। তাঁদের ভাষ্যমতে রেকমতের নাম শুনলে মানুষ যতটা আতঙ্কিত হয়ে ওঠতো ঠিক ততটাই আতঙ্কিত হয় এখন মোফাজ্জল হোসেন চুন্নুর নাম শোনার পর। এলাকায় তাঁর রয়েছে বিশাল এক সন্ত্রাসী বাহিনী।
স্থানীয়রা জানায়, স্থানীয় মিল ফ্যাক্টরীর ঝুট সেক্টর থেকে শুরু করে মাদক ব্যবসার একচ্ছত্র অধিপতি এই দুর্ধষ সন্ত্রাসী চুন্নু। এছাড়াও এলাকার শীর্ষ ভূমিদস্যু হিসেবেও তাঁর খ্যাতি রয়েছে। এছাড়াও বিদেশী মদ থেকে শুরু করে ইয়াবার পাইকারি ব্যবসায়ীও সে। তাঁর রয়েছে মাদকের বিশাল নেটওয়ার্ক।
নিজ বাড়ি পুরোটাই সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এছাড়াও তাঁর বাড়ির পথের দিকে বেশ কিছু স্থানে স্থাপন করা হয়েছে সিসি ক্যামেরা। ফলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি খুব সহজেই সে অনুমান করতে পারে। আর এভাবেই সে নিয়ন্ত্রণ করে তাঁর অপরাধ জগতের এই সাম্রাজ্য।
এদিকে বিদেশী পিস্তল, ম্যাগজিন, ৬ রাউন্ড গুলি ও বিদেশী মদ বিয়ারসহ ২০১৫ সালের ৩ মার্চ ফতুল্লার লামাপাড়া নয়ামাটি এলাকা থেকে মোফাজ্জল হোসেন চুন্নুকে গ্রেফতার করে ব্যাব-১১।
ওই সময় পুরাতন কোর্ট এলাকার র্যাব-১১ এর সিপিসি-১ এর এএসপি মাসুদ আনোয়ার জানিয়েছিলেন, চুন্নু একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী এবং চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। তাঁর রয়েছে নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী।
এই বাহিনী দ্বারা সে ভূমি দখল ও মাদক বিক্রি করাতো। চুন্নু গ্রেফতার হওয়ার পর তাঁর অস্ত্র ভান্ডারের সন্ধানে নামে র্যাব-১১।
এর আগেই র্যাব জানতে পেরেছিলো চুন্নু তাঁর স্ত্রীর মাধ্যমে তাঁর অস্ত্র নিকট আত্মীয়দের বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছে।
এরপরই একই বছরের ১৪ মার্চ র্যাব-১১ চুন্নুর শ্যালিকা সুমাইয়া আক্তার মুন্নির চোধুরী বাড়ি এলাকার বাড়িতে অভিযান চালায় এবং সেখান থেকে একটি বিদেশী পিস্তল, ২টি ম্যাগজিন, ৮ রাউন্ড গুলি ও চাইনিজ কুড়াল উদ্ধার করে।
২০১৭ সালের ৩ আগষ্ট চুন্নু ও তাঁর বাহিনীর বিরুদ্ধে জেলা পুলিশ সুপার বরাবর লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন লামাপাড়া এলাকার মো. হাবিব মিয়া।
এখানে হাবিব মিয়া দাবি করেছিলেন চুন্নু ও তাঁর বাহিনী অস্ত্র নিয়ে তাঁর উপর অতর্কিত হামলা চালায় এবং তাঁর কাছ থেকে নগদ টাকাসহ মোবাইল ফোন লুটে নেয়।
এছাড়া একই বছরের ১০ নভেম্বর ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. আতাউর রহমান চুন্নুকে গ্রেফতারে অভিযান চালায়।
এসময় চুন্নুর বাড়ির দ্বিতীয় তলা থেকে তাঁকে আটক করলেও তাঁর সহযোগিরা পুলিশের উপর হামলা চালিয়ে তাঁকে ছিনিয়ে নেয়।
এ ঘটনায় চুন্নু পালিয়ে গেলেও তাঁর সহযোগি আরফান মাদবরকে গ্রেফতার করে। এ ঘটনার ঠিক সাড়ে তিন বছর আগে চুন্নুর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড রাফেদ আলীকে একই থানার এসআই জিন্নাহর উপর হামলা চালিয়ে ছিনিয়ে নিয়েছিলো চুন্নু বাহিনী। পরে ২৫ অক্টোবর এই রাফেদ আলীকে গ্রেফতার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ।
২০১৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে সিদ্ধিরগঞ্জের ২ নম্বর ঢাকেশ্বরী এলাকার আবু বক্করের নির্মাণাধীন বাড়ির দোতলা থেকে মাদক সেবনরত অবস্থায় চুন্নুকে গ্রেফতার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ।
বিভিন্ন তথ্যসূত্র অনুসন্ধান করে জানা গেছে সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী মোফাজ্জল হোসেন চুন্নুর বিরুদ্ধে ফতুল্লা, সদর ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় হত্যা, অস্ত্র ও মাদকসহ অন্তত ২০ টি মামলা রয়েছে।