মানুষের প্রতি মানুষের সমবেদনায় ইসলাম
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৩:৫১ পিএম, ২৭ এপ্রিল ২০১৯ শনিবার
একটি আয়াত ও একটি ছড়া দিয়ে প্রবন্ধের সূচনা করছি। আয়াতটি সূরাতুল ফাতহ’ এর ২৯ নম্বর আয়াত।
وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ
তরজমা : (সাহাবীদের পরিচয়দানে) তারা কাফেরদের প্রতি কঠিন ও নিজের মধ্যে ভালোবাসা প্রতিম।
ছড়াটি আমাদের পল্লীকবি জসিম উদ্দীন এর। ছড়াটির নাম ‘সবার সুখে’
সবার সুখে হাসব আমি
কাঁদব সবার দুখে,
নিজের খাবার বিলিয়ে দেব
অনাহারীর মুখে।
আমার বাড়ির ফুল-বাগিচা,
ফুল সকলের হবে,
আমার ঘরে মাটির প্রদীপ
আলোক দিবে সবে।
আমার বাড়ি বাজবে বাঁশি,
সবার বাড়ির সুর,
আমার বাড়ি সবার বাড়ি
রইবে না ক দূর।
আক্ষরিক বা আকৃতিক মানুষ হওয়ার জন্য ভিন্ন কোনো প্রচেষ্টা বা সাধনা করতে হয় না। শুধুমাত্র মানুষের ঔরসে জন্ম নেয়ার দ্বারা মানুষ হওয়া যায়। এই মানুষ সম্পর্কে আল্লাহ এক আলোচনায় বলেন-
﴿وَلَقَدْ ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيرًا مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ لَهُمْ قُلُوبٌ لَا يَفْقَهُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لَا يُبْصِرُونَ بِهَا وَلَهُمْ آذَانٌ لَا يَسْمَعُونَ بِهَا أُولَئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُولَئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ﴾
তরজমা : আমি জিন ও মানুষের মধ্যে হতে বহুজনকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাদের অন্তর আছে, কিন্তু তা দ্বারা তারা অনুধাবন করে না, তাদের চোখ আছে কিন্তু চোখ দ্বারা দেখে না এবং তাদের কান আছে, কিন্তু তা দ্বারা শোনে না। তারা চতুষ্প্রদ জন্তুর মতো। বরং তার থেকেও নিকৃষ্ট (বিভ্রান্ত)। এরাই গাফেল। সুতরা বুঝা গেল মানুষের ঘরে জন্ম নিলেই মানুষ হয় না, মানুষ হওয়ার জন্য ভিন্ন শ্রম লাগে, সাধনা লাগে। এই ভিন্ন শ্রম ও সাধনা না করতে পারলেই পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট প্রকৃতির হয়ে যায়।
সমবেদনা বলা হয় অন্যের দুঃখে দুঃখি, অন্যের সুখে সুখি। অন্যের হাসিতে হাসি, অন্যের কাঁদায় কাঁদা। অন্যের ক্ষতি না করা অন্যের সঙ্গে দুশমনি না করা। ইসলাম মানবতার ধর্ম। ইসলামে সর্বাগ্রে মানবতাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এখানে প্রতিটি কাজ মানবতার জন্য উপকারী। ইসলামের এমন কোনো বিধান নেই যেখানে মানবতার অনুপস্থিতি বা বিরোধিতা করা হয়েছে। একারণেই দশ শতাব্দী পেড়িয়ে দু’হাজারের পথে চলা এই ধর্ম এখনো সবচে বেশি আবেদনশীল সংবেদনশীল ও গ্রহণীয়। পৃথিবীর পাড়ায় পাড়ায় আজ ধর্ম পরিবর্তনের যে সংবাদ আসছে তা হচ্ছে ইসলাম গ্রহণের সংবাদ। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে আজ সবাই শান্তির ও আরাম খুঁজে পাচ্ছে ইসলামের বারিধারায়। আমাদের এই ইসলাম শিক্ষা দেয় না শুধু সবার জন্য জরুরি করে দিয়েছে যে অন্যের জন্য সমবেদনাবোধ। যে ইসলামের অনুসারি হবে আর ভেতরে অন্যের জন্য সমবেদনাবো জাগবে না’ সে কেমন জানি মুসলমানই হতে পারলো না। হ্যাঁ, এমনটাই আমাদের ঈমানী চেতনার পুরুষ সাইদুনা হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যার হৃদয় অন্য মুসলমানের ব্যথায় ব্যথিত হয় না, সে ব্যক্তি আমার উম্মতের শ্রেণিভুক্ত নয় (সহীহ বুখারী)।
এই বাণী দ্বারা মানবতার শ্লোগান উচ্চ সুরে ধ্বনিত হয়েছে। সহমর্মিতা সববেদনা মানবীয় অনন্য গুণ। কোরআন সববেদনা সহমর্মিতার যে নীতি দিয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে তার বিরল ও দুর্লভ।
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ
তরজমা : শুধুমাত্র মুসলমানরাই পরস্পরে ভাই ভাই।
এর থেকেও আমরা সমবেদনার সবক নিতে পারি। এক হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- ্র الْمُسْلِمُونَ كَرَجُلٍ وَاحِدٍ إِنِ اشْتَكَى عَيْنُهُ اشْتَكَى كُلُّهُ وَإِنِ اشْتَكَى رَأْسُهُ اشْتَكَى كُلُّهُ
অর্থ : গোটা মুসলিম বিশ্ব একটি শরীরের ন্যায়। যদি তার চোখে ক্ষত হয় তাহলে যেন পুরো শরীরের ক্ষত হলো, যদি তার মাথায় ক্ষত হয় যেন তার সারা শরীরে ক্ষত হলো। (মুসনাদে আহমাদ)।
এক মুমিনের প্রতি অপর মুমিনের সমবেদনার প্রকারগুলো ইবনুল কাইয়্যেম খুব সুন্দরভাবে সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন, তিনি বলেন- মুমিনের প্রতি সমবেদনা জানানো কয়েকভাবে হতে পারে। সম্পদ দিয়ে সমবেদনা। প্রভাব প্রতিপত্তির মাধ্যমে সমবেদনা। শারীরিক ও কায়িক শ্রম দিয়ে সমবেদনা। উপদেশ ও সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে সমবেদনা। তাদের জন্য দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করার মাধ্যমে সমবেদনা। তাদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করার মাধ্যমে সমবেদনা। ব্যক্তির ঈমানের সবলতা ও দুর্বলতার ভিত্তিতে এ সমবেদনার তারতম্য ঘটে। ব্যক্তির ঈমান সবল হলে সমবেদনা তীব্র হয়। ঈমান দুর্বল হলে সমবেদনাও দুর্বল হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের প্রতি উল্লিখিত সকল প্রকার সমবেদনার মাধ্যমে সবচেয়ে উত্তম সমব্যথী ছিলেন।
সাহাবাদের সমবেদনা: সাহাবিগণ কীভাবে সমবেদনা প্রকাশ করতেন এর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে মুসলিম শরীফে। এক সাহাবী বর্ণনা করেন একদা আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত ছিলাম। এমন সময় মুদান গোত্রের কিছু লোক আগমন করলো। এরা ছিল জীর্ণশীর্ণ ক্ষীণকায়। গায়ের কাপড় ছিল পুরাতন ও ছেঁড়াফাড়া। গলায় তরবারি ঝুলানো ছিল। তাদের এমন দুর্দশা দেখে রাসূলুল্লাহ খুবই মর্মাহত হলেন ও ভরাক্রান্ত হয়ে পড়লেন। তিনি ঘরে প্রবেশ করলেন। বের হলেন। হজরত বেলালকে ডেকে বললেন আজান দাও। আজান হলো নামাজ পড়ালেন। নামান্তে সকল সাহাবীদের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ খুতবা দিলেন। সূরা নিসা প্রথম আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا
তরজমা : হে মানুষ সকল! আল্লাহকে ভয় করো যিনি তোমাদেরকে একজন মানুষ থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন। অতপর উভয় থেকে অসংখ্য নারী পুরুষ ছড়িয়ে পড়েছে। এবং ভয় করো আল্লাহ যার নামে তোমরা পরস্পরের কাছে কামনা চাও এবং আত্মীয়তার সম্পর্কের ব্যাপারেও আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন।
অতপর রাসূলুল্লাহ সূরা হাশরের আয়াতাংশ তেলাওয়াত করলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ
তরজমা : তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, প্রত্যেক আত্মাই যেন লক্ষ্য করে, সে আগামী দিনের জন্য কী পুজি জমা করেছে।
আয়াত দুটি তেলাওয়াতের পর তিনি উপস্থিত সাহাবিদেরকে দান করার তাগিত দিয়ে বলেন- ব্যক্তি যেন দান করে নিজের দিরহাম থেকে, দিনার থেকে, গম থেকে, যব থেকে। এক সময় তিনি বললেন খেজুরের এক টুকরো হলেও যেন সবাই দান করে। ইতিমধ্যে একজন আনসারী সাহাবি মালভর্তি একটি থলে নিয়ে এলেন। এটা এই পরিমাণ ওজন ছিল যে, তা বহন করা তার কষ্ট হচ্ছিল। তার অনুসরণে অন্য সবাই যার কাছে যা ছিল সামথ্য অনুযায়ী দান করতে লাগলো। দান যখন ব্যাপকহারে শুরু হলো দুটি স্তুপ হয়ে গেছে। একটি কাপড়ের অন্যটি খাদ্যের। রাসূলের চেহারা তখন আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, যেন তাতে স্বর্ণ ঝলমল করছিল। এভাবেই সাহাবীগণ সমবেদনার দৃষ্টান্ত দিয়েছেন।
সমবেদনাবোর বুঝার উপায় কী? নিজের ভেতর সমবেদনার গুণ আছে কী নেই বুঝার উপায় কী? বুঝার উপায় হলো- প্রাণী বলতে পৃথিবীতে যা কিছুর অস্তিত্ব আছে, তাতেই কোনো অবিচার হলে হৃদয়ে ব্যথা অনুভব জাগ্রত হওয়া। যদি ব্যথার অনুভব জাগ্রত না হয় বুঝতে হবে হৃদয়ে সমবেদনা নেই। বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে বোবা একটি কুকুরও যদি অবিচারে ঘেউ করে উঠে, তার জন্য সমবেদনা প্রকাশ করা ও তার সাহায্যে ছুটে যাওয়া মহান চরিত্র। হাদিস শরীফে আছে এক ব্যভিচারি মহিলা কুকুর উপর দয়া ও সমবেদনা প্রকাশ করায় আল্লাহ তাকে মাফ করে জান্নাত দিয়ে দিয়েছেন।
ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিরবণ এই যে, মরুভূমিতে একটি কুকুর পানির তাড়নায় অস্থির ছটফট করছিল। সেই রাস্তা দিয়ে বনি ইসরাইলের এক নষ্টা মহিলা যাচ্ছিল। কুকুরের এমন অবস্থা দেখে ওই মহিলার খুব মায়া হলো। ব্যাকুলতা উঠলো। কুকুরকে পানি পান করানোর জন্য ছুটাছুটি করলো। কিন্তু কোথায় কোনো পানি নেই, পানি সংগ্রহ করার কোনো ব্যবস্থাও নেই। পাশেই জীর্ণশীর্ণ একটি পরিত্যক্ত কূপ ছিল। কিন্তু তার থেকে পানি উত্তোলনের কোনো উপায় ছিল না। মহিলাটি তার চামড়ার মোজা খোলে নিজের কাপড় দ্বারা রশি বানিয়ে পানি উঠালো। কুকুরটিকে প্রাণভরে পানি পান করালো। আল্লাহ তাকে স্বপ্নে দেখালেন যে, আল্লাহ তার এই কাজে খুশি হয়ে তাকে মাফ করে দিয়েছেন।
এই হলো সমবেদনা। এই হলো মানবতাবোধ।
হাদিসে সমবেদনার তালিম: হজরত নুমান ইবনে বাশির (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘পারস্পরিক দয়া ভালোবাসা ও সহানূভুতি প্রদর্শনে সকল মুমিন একটি দেহের মতো দেখবে। শরীরের কোনো একটি অঙ্গ যখন আক্রান্ত হয়, তখন (এর ব্যথায়) শরীরের অন্যান্য অঙ্গগুলোও ব্যথায় অস্থির হয়ে ওঠে, তার জন্য রাত জেগে থাকে। (সহিহ বুখারি : হাদিস- ৬০১১)।
হজরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের কেউ যখন লোকদের সঙ্গে জামাতে নামাজ আদায় করে, তখন যেন সে নামাজ সংক্ষিপ্ত করে। কেননা হয়তো লোকদের মধ্যে দুর্বল বৃদ্ধ অসুস্থ লোক থাকতে পারে। নামাজ দীর্ঘ হলো তাদের কষ্ট হবে। আর একাকী নামাজ আদায়কালীন যত ইচ্ছে দীর্ঘ করুক। (সহিহ বুখারি : হাদিস- ৭০৩)।
একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কোলে একটি শিশু মরণাপন্ন হয়ে ছটফট করছিল। এসময় রাসূলের চোখ থেকে বিন্দু বিন্দু অশ্রু বইছিল। সাহাবী সাদ (রাযি.) বলেন, হে নবী! (মানুষের মরণে আপনিও কাঁদেন?) উত্তরে রাসূল বলেন এহলো রহমতের কান্না। মানুষের প্রতি মানুষের অন্তরে যে ভালোবাসা রয়েছে, সেই ভালোবাসা থেকেই এই কান্নার উৎস। (সহিহ বুখারি : হাদিস- ১২৮৪)।