আরকানে ইসলাম
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৯:৪৭ এএম, ৬ মে ২০১৯ সোমবার
হাদিসের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ মেশকাত শরীফসহ বহু কিতাবের শুরুতে একটি হাদিস বর্ণনা করা হয়েছে, যেখানে সংক্ষিপ্ত শব্দে ইসলামের সারনির্যাস তুলে ধরা হয়েছে। একে হাদিসে জিবরাইল বলা হয়।
কারণ, হজরত জিবরাইল (আ.) প্রশ্নকারী সেজে ঈমান ও ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহ জানতে চেয়েছেন আর রাসূল (সা.) উত্তর দিয়ে বিষয়টিকে স্পষ্ট করেছেন। ওই হাদিসকে উম্মুল আহাদিসও বলা হয়। উম্মুন শব্দের অর্থ হচ্ছে মা বা কোনো বস্তুর মূল। বিষয়বস্তুকে অন্তর্ভূক্ত করার দিক থেকে এই হাদিসটি সমস্ত হাদিসের বিষয়কে শামিল করেছে। এ জন্যে কেমন যেন এই হাদিসটি হচ্ছে মূল আর অন্যসব হাদিস হচ্ছে এর ব্যাখ্যা। তাই একে উম্মুল আহাদিস বলা হয়।
হজরত জিবরাইল (আ.) হজরত নবী করীম (সা.)-কে আরকানে ইসলাম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। রাসূল (সা.) বলেন ইসলামের আরকান হচ্ছে, ‘এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই। হজরত মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহ তায়ালার প্রেরীত রাসূল। নামাজ কায়েম করা। জাকাত দেয়া। রমজান শরীফে রোজা রাখা। হজ ফরজ হলে হজ করা।’ উল্লিখিত হাদিসে জিবরাইল (আ.) এর আলোকে বলা যায় মৌলিকভাবে ইসলামের আরকান তিনটি-
(১) আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদের সাক্ষ্য দেয়া।
(২) হজরত মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহ তায়ালার প্রেরীত নবী এ কথার সাক্ষ্য দেয়া।
(৩) নেক আমল করা’ যার শীর্ষে রয়েছে নামাজ, জাকাত, রোজা ও হজ।
নেক আমল সমূহের মধ্য থেকে এই চারটিকে আলোচনায় আনার কারণ হচ্ছে, এগুলোর গুরুত্ব অন্যগুলোর তুলনায় একটু বেশি এ কথা বুঝানো। হাদিসে আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর ওপর ঈমানের আলোচনার সঙ্গে নেক আমলেন কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। উলামায়ে কেরাম এর কারণ বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল (সা.) এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে এই মেসেজ দেয়া যে, আখেরাতে মুক্তির জন্য শুধু ঈমান যথেষ্ট নয় বরং এর সঙ্গে নেক আমলও লাগবে।
নিম্নে তিনটি আরকানের বিস্তারিত আলোচনা দেয়া ধরা হলো-
(এক) ইসলামের প্রথম রোকন হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদের সাক্ষ্য দেয়া। সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ মনে করা হয় যে, শুধু মুখে মুখে বলা দেয়া ‘আল্লাহ এক’। সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ কখনো এটা নয় বরং মুখে যা বলা হচ্ছে, অন্তরে ওই বিষয়ের বিশ্বাস বা ইতেকাদ রাখা এবং স্বীকার করে নেয়ার নাম হচ্ছে শাহাদত বা সাক্ষ্য। যদি কোনো ব্যক্তি মুখে একটা বলে এবং অন্তরে পোষণ করে অন্যটা তাহলে এটা মিথ্যা সাক্ষ্য হবে। দ্বীনের ক্ষেত্রে এমন করলে, এটা মোনাফিকির শামিল হবে। সাক্ষ্য দেয়ার এই অর্থকে সামনে রেখে আমরা যদি কালিমায়ে তাওহীদ তথা ‘আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অর্থ করি তাহলে এর অর্থ দাড়াবে ‘আমি স্বীকার করছি এবং বিশ্বাস করছি যে, হক মাবূদ, যিনি ছাড়া আর কেউ ইবাদতের উপযুক্ত নয় তিনি হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ তায়ালা।’
আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদ দুই প্রকার-
(১) তাওহিদ ফিল উলূহিয়্যা: ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদকে বিশ্বাস করা। অর্থাৎ বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত আর কেহ নেই। তাওহীদের এই প্রকারকে বাংলা ভাষায় ‘ইবাদতের একত্ববাদ’ শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়। আল্লাহ তায়ালা সকল নবী-রাসূলগণকে, তাওহীদের এই প্রকারের দাওয়াত দেয়ার উদ্দেশ্যেই প্রেরণ করেছিলেন। আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি আপনার পূর্বে যত রাসূল প্রেরণ করেছি, তাদের কাছে ওহি প্রেরণ করেছি এই বিষয়ে যে, আল্লাহ ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত কেউ নেই। অতএব তোমরা আমারই ইবাদত করো।’ (সূরা আম্বিয়া-২৫) এই আলোচনা আরো এসেছে, সূরা নাহল-৩৬, সূরা মুমিনুন-২৩, সূরা আরাফ-৬৫।
(২) তাওহীদ ফির রুবূবিয়্যাহ: এর অর্থ হচ্ছে এই বিশ্বাস রাখা যে, আল্লাহ তায়ালা তিনি একাই এই মহাবিশ্বের প্রভু, পালনকর্তা ও সৃষ্টিকর্তা। তিনিই মানুষের জন্মদাতা, মুত্যুদাতা। তিনিই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী; সৃষ্টির মাঝে তিনি যা চান করেন, তাঁকে বাধা দেয়ার ক্ষমতা কারো নেই। এবং কর্মের জন্য তিনি কারো কাছে জবাবদিহিতার আওতায় নয়। তাওহীদের এই প্রকারকে বাংলা ভাষায় ‘প্রতিপালনের একত্ববাদ’ শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়। তাওহীদের এই প্রকারকে অনেক মুশরিকরাও বিশ্বাস করতো। আল কোরআনে এসেছে , ‘আর আপনি যদি ওদেরকে জিজ্ঞেস করেন, আসমানসমূহ ও জমীনকে কে সৃষ্টি করেছেন? তারা বলবে, মহাপরাক্রশালী ও সর্ববিষয়ে জ্ঞাত আল্লাহ এইগুলোকে সৃষ্টি করেছেন। (যুখরুফ-৯)।
(দুই) ইসলামের দ্বিতীয় রোকন হচ্ছে, হজরত মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহ তায়ালার প্রেরীত নবী এ কথার সাক্ষ্য দেয়া। এর অর্থ হচ্ছে, এ কথার বিশ্বাস রাখা যে, মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহ কর্তৃক প্রেরীত সর্বশেষ রাসূল এবং কথা ও কাজের মাধ্যমে এই বিশ্বাসের বহিপ্রকাশ ঘটানো। কাজের মাধ্যমে এর বহিপ্রকাশ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে ব্যক্তি স্বীকার করবে তিনি আল্লাহ প্রেরীত রাসূল, তার সমস্ত কথা-বার্তা, আচার-ব্যবহার ও লেনদেন রাসূল (সা.) এর আনিত শরীয়ত মোতাবেক হবে। এবং এর পেছনের কার্যকারণ থাকবে রাসূল (সা.) এর অনুসরণ।
খতমে নবুওয়াত: খতম শব্দের অর্থ হচ্ছে শেষ আর নবুওয়াত মানে নবুয়াতের ধারা। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা, হজরত আদম (আ.) থেকে নবী প্রেরণের যে ধারা জারি করেছিলেন রাসূল (সা.) এর মাধ্যমে সেই ধারাবাহিকতা শেষ করেছেন। তাঁর পর আল্লাহ তায়ালা আর কোনো নবী প্রেরণ করবেন না। এ ব্যাপারে বহু হাদিসসহ কোরআনের আয়াত নাজিল হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর মুহাম্মাদ (সা.) তোমাদের কারো পিতা নন বরং তিনি হচ্ছেন আল্লাহর রাসূল ও সর্বশেষ নবী। (সূরা আহযাব-৪০)। রাসূল (সা.) সর্বশেষ নবী এ কথাকে অস্বীকার করলে দ্বীন থেকে বের হয়ে যাবে। এবং ইকফারুল মুলহিদিন নামক গ্রন্থে আছে, যদি কোনো ব্যক্তি এ ব্যাপারে সন্দেহ করে যে, অস্বীকার করলে দ্বীন থেকে বের হবে কীনা তাহলে সেও দ্বীন থেকে বের হয়ে যাবে। তাহলে একজন মুসলমানের কাছে উক্ত বিষয়টি কত গুরুত্ব রাখে! কিন্তু আমরা অসচেতন হওয়ার দরুণ, এ রকম ব্যক্তিদের ব্যাপারে আপোষকামীতার মনোভাব দেখাই, যা আমাদের ঈমানের জন্য ক্ষতিকর। রাসূল (সা.) এর প্রতি ঈমান আনার পর যা করণীয়: রাসূল (সা.) এর প্রতি ঈমান আনার পর, এই ঈমানের চাহিদা হচ্ছে, তাঁর আনিত বিধিবিধানের সামনে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করা। এবং নিঃসংকোচে তাঁর সকল আদেশ নিষেধ মেনে চলা। তাঁর দেয়া কোনো বিধান মানা আর কোনটাকে অস্বীকার করা, এটাও তাঁর প্রতি ঈমানের পরিপন্থি।
(তিন) ইসলামের তৃতীয় রোকন হচ্ছে নেক কাজ করা। নেক কাজের মধ্যে দুটি বিষয় লক্ষণীয়। (১) বান্দার নেক কাজ শরীয়ত মোতাবেক হওয়া। অর্থাৎ ব্যক্তি নেক কাজের নামে যা করছে, শরীয়তে এর কোনো ভিত্তি আছে কীনা এবং ফিকহে বর্ণিত বিধিবিধানের আলোকে তা পালিত হচ্ছে কীনা। (২) আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করার নিয়তে আমল করতে হবে। এই উভয় শর্ত বা কোনো একটি যদি নেক কাজে অবিদ্যমান থাকে তাহলে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। আল্লাহ তায়ালা এ ব্যাপারে নির্দেশনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘অতএব, যে ব্যক্তি স্বীয় প্রভুর সাক্ষাতের আশা রাখে, সে যেন নেক আমল করে এবং রবের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে। (কাহাফ-১১০)। নেক আমল দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, শুদ্ধ আমল; যা শরীয়তে ইসলামির আলোকে হবে এবং উদ্দেশ্য থাকবে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি।
ইসলামে নেক আমলেন গুরুত্ব: এ কথা স্পষ্ট যে, নেক আমলের গুরুত্ব দ্বীনের মৌলিক বিষয় তথা আকীদা-বিশ্বাস থেকে একটু নিচে। দ্বীনের মৌলিক বিষয়ের গুরুত্বই সর্ব্বোচ্চ। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, নামাজ না পড়লেও চলবে যদি ঈমান ঠিক থাকে। বরং ইসলামে নেক আমলের গুরুত্ব অপরসীম। কারণ, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমানের প্রমাণ হচ্ছে এই নেক আমলগুলো। নেক আমলের গুরুত্ব বুঝানোর জন্য, আল্লাহ তায়ালা আল কোরআনের সর্বাধিক আয়াত এই বিষয়েই নাজিল করেছেন। কোনো আয়াতে ঈমানের সঙ্গে নেক আমলের আলোচনা এসেছে। কোনো আয়াতে, নেক আমলের ভালো ফলাফল তুলে ধরেছে। কোনো আয়াতে বলা হয়েছে, মৃত্যুর পর বান্দার নেক আমল ছাড়া আর কিছুই বাকি থাকবে না। আল্লাহ তায়ালা নেক আমল দ্বারা বান্দার ভুলসমূহকে ক্ষমা করে দেবেন। সমস্ত মানুষ ক্ষতির মাঝে আছে তবে যারা নেক আমল করে তারা ব্যতিত ইত্যাদি।
বেদআত কোথাও গ্রহণযোগ্য নয়: পূবেই আলোচনা হয়েছে যে, নেক আমল কবুলযোগ্য হওয়ার জন্য শরীয়তে ইসলামির মোতাবেক হতে হবে। অতএব নিজের বিবেচনায় কোনো আমল যত সুন্দর ও ভালোই মনে হোক, কিন্তু শরীয়তে যদি এর ভিত্তি না থাকে তাহলে তা চালিয়ে দেয়া যাবে না। এমনটি করা হলে তা বেদআত হিসেবে গণ্য হবে; যা পরিত্যাজ্য। বহু হাদিসের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু যুক্ত করবে, যা তার অন্তর্ভূক্ত নয় সে ব্যক্তি আমাদের দলভূক্ত নয়।’
নেক আমলের শ্রেণীবিন্যাস: নেক আমল হুকুমের দিক থেকে সাধারণত চার প্রকার
(১) ফরজ। যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রমজান মাসের রোজা ইত্যাদি।
(২) ওয়াজিব। যেমন রমজানের রোজা ভাঙ্গার পর গরিব-মিসকিনকে সদকাতুল ফিতর দেয়া।
(৩) সুন্নত। যেমন সালাম দেয়া, সকল কাজ ডান দিক থেকে শুরু করা।
(৪) নফল। নামাজ, রোজা যেমন ফরজ আছে তেমনি নফলও রয়েছে।
ইসলামে নফলের গুরুত্ব একদিক থেকে সর্বাধিক। কারণ ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত এগুলো এমন যা না করার অধিকার বান্দার নেই। কিন্তু নফলের ক্ষেত্রে বান্দার করা বা না করার এখতিয়ার আছে। এখন কোনো ব্যক্তি নফল পড়ার অর্থ হচ্ছে আসলে সে আল্লাহকে মহব্বত করে। অন্যথায় সে এগুলো করতো না। কারণ, তা করা ওই ব্যক্তির ওপর আবশ্যক ছিলো না।