হাদিসে বর্ণিত নিষিদ্ধ ক্রয়-বিক্রয়
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৩:৫৭ পিএম, ৬ মে ২০১৯ সোমবার
একজন মানুষ যা ব্যবহার করে তার সবকিছু নিজে উৎপাদন বা তৈরি করতে পারে না বরং অধিকাংশ জিনিসই অন্যের থেকে সংগ্রহ করতে হয়। এর বহুল প্রচলিত একটি মাধ্যম হলো ক্রয়-বিক্রয়।
ব্যক্তি নিজের উৎপাদিত পণ্যের অতিরিক্তটা বিক্রি করে, তা দিয়ে প্রয়োজনীয় অন্য পণ্য কিনে আনে। ক্রয়-বিক্রয়েরও আবার বহু পদ্ধতি আমাদের সমাজে চালু আছে। কিছু পণ্য সরাসরি উৎপাদনকারীর হাত থেকে আমরা ক্রয় করতে পারি। আবার অনেক পণ্য এমন যা অন্যের মধ্যস্থতা ছাড়া ক্রয় করা প্রায় অসম্ভব।
কখনো পণ্য উৎপাদনে রেখে বিক্রি হতে দেখা যায়। সর্বাঙ্গীন জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রেও ইসলামের কিছু মূলনীতি রয়েছে। এগুলোর আলোকে কিছু ক্রয়-বিক্রয় হারাম আর কিছুকে বৈধতা দেয়া হয়। এমন কিছু বিক্রয় পদ্ধতি হচ্ছে-
শহরগামী ব্যবসায়ীদের পণ্য শহরতলি থেকে কিনে নেয়া:
ফিকহি পরিভাষায় এভাবে পণ্য কেনাকে ‘তালাক্কিয়ে জাল্ব’ বলা হয়। ‘তালাক্কিয়ে জাল্ব’ এর পরিচয় ফকিহগণ এভাবে দিয়েছেন, যেমন: শহরের বাহির থেকে যে সকল ব্যবসায়ী কাফেলা পণ্য নিয়ে শহরে আসে, তাদের থেকে শহরতলিতে পণ্য কিনে নেয়া এবং ওই পণ্য শহরে এনে বেশি দামে বিক্রি করা। রাসূল (সা.) এভাবে পণ্য কিনতে নিষেধ করেছেন। এক হাদীসে রাসূল (সা.) বলেন, বাজারে পৌঁছার আগে পণ্য যেন ক্রয় করা না হয়। (সহিহ মুসলিম-১৫১৮)।
হজরত আবু হুরাইরা (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে, এভাবে ক্রয় করার পর ব্যবসায়ী দল যদি শহরে আসে তাদের অধিকার থাকবে, উক্ত চুক্তি রহিত করার। (সহিহ মুসলিম-১৫১৯)।
উল্লিখিত হাদিসের ভিত্তিতে হানাফি ফকিহ ছাড়া অন্য সকল ফকিহদের মত হচ্ছে, শহরগামী বণিকদের পণ্য শহরতলিতে কিনে নেয়া সর্বাবস্থায় মাকরূহ ও গোনাহের কাজ। হানাফি ফকিহদের মত হচ্ছে, এভাবে পণ্য কিনা মাকরূহ হবে যখন মানুষের ক্ষতি হবে। কারণ, এভাবে পণ্য কেনার দ্বারা দুই পক্ষ্যের ক্ষতি করা উদ্দেশ্য থাকে- (১) গ্রাম থেকে আগত ব্যবসায়ী (২) শহরবাসী।
রাসূল (সা.) এই বিধান জারি করে মূলত উভয় পক্ষ্যকে লাভবান করাতে চেয়েছেন। গ্রামের ব্যবসায়ীরা শহরে এসে বিক্রি করবে। এতে উপযুক্ত মূল্য পাবে। সরাসরি গ্রামের ব্যবসায়ীদের থেকে কেনার কারণে শহরবাসীও কিছু কম মূল্যে পণ্য কিনতে পারবে। তাই এভাবে কেনার দ্বারা যদি কারো ক্ষতি করা উদ্দেশ্য না থাকে তাহলে এই পদ্ধতি মাকরূহ হবে না।
ওলানে দুধ জমা করে পশু বিক্রি করা:
বিক্রয়ের এই পদ্ধতিকে ফিকহের পরিভাষায় ‘তাশরিয়া’ বলা হয়। ‘তাশরিয়া’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে জমা করা। যেহেতু আরবের প্রচলন ছিলো, কোনো দুধের পশু বিক্রির আগে কিছুদিন ওলানে দুধ জমা করে তা বিক্রি করত তাই বিক্রয়ের এই পদ্ধতিকে ‘তাশরিয়া’ বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে হাদিস হচ্ছে, রাসূল (সা.) বলেন, তোমরা উট, ছাগল ইত্যাদিকে এভাবে দুধ আটকে রেখে বিক্রি করো না। যদি কেউ এভাবে বিক্রি করে তাহলে দুধ দোহনের পর ক্রেতার ওই পশু নেয়া বা না নেয়ার এখতিয়ার থাকবে। তবে না নিলে পশু ফেরৎ দেয়ার সময় এর সঙ্গে সাড়ে তিন সের খেজুর দিতে হবে। (সহিহ মুসলিম-১৫১৫)।
স্বাভাবিক কথা, ওলান বড় দেখলে ক্রেতা বেশি দামে কিনে নিবে। যেহেতু এর দ্বারা ক্রেতাদের ধোঁকা দেয়া হয় তাই পশুর দাম বৃদ্ধি করার জন্য এভাবে দুধ আটকে রাখা সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। যে এই কাজ করবে সে ফাসেক হিসেবে গণ্য হবে। এবং উল্লিখিত হাদিস থেকে এ কথাও বুঝে আসে যে, প্রতারণার বিষয়টি প্রমাণিত হলে ক্রেতার না নেয়ার এখতিয়ার থাকবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে ফেরৎ দেয়ার সময় খেজুর বা তার মূল্য দিতে হবে কী-না। অধিকাংশ ফকিহের মত হচ্ছে, পশু ফেরৎ দেয়ার সময় খেজুর বা তার সমমূল্য বিক্রেতাকে দিতে হবে। অতিরিক্ত খেজুর দেয়ার কারণ হচ্ছে দোহন করে দুধ রেখে দেয়া। তবে হানাফি মাজহাব ও মালেকি মাজহাব মতে দুধের বিনিময়ে অতিরিক্ত খেজুর দিতে হবে না।
গাছের ফল কয়েক বছরের জন্য অগ্রীম বিক্রি করা:
গাছের ফল কয়েক বছরের জন্য অগ্রীম বিক্রি করাকে ফিকহি পরিভাষায় ‘মুআওয়ামা’ বলে। রাসূল (সা.) এভাবে অগ্রীম গাছের ফল বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন। (সহিহ মুসলিম-১৫৩৭)।
কারণ, শরিয়াহ মোতাবেক বিক্রির শর্ত হচ্ছে পণ্য বিদ্যমান থাকা। এখানে চূক্তির সময় পণ্য বিদ্যমান নেই। তাছাড়া এখানে এমন পণ্য ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে যা গাছে আসতে পারে আবার নাও আসতে পারে। রাসূল (সা.) এক হাদিসে পণ্য বিদ্যমান না থাকা অবস্থায় তা বিক্রি করা থেকে নিষেধ করেছেন। (মুসলিম-১৫১৩)। তবে ফল ধরার পর পরিপক্ক হওয়ার আগে যদি বিক্রি করা হয় তাহলে অনেক ফকিহ এটাকে জায়েজ বলেছেন।
গ্রাম্য কারবারির পক্ষ থেকে শহুরে ব্যবসায়ীর বিক্রি:
ফকিহগণ এই বিক্রয়ের সুরত বর্ণনা করেছেন এই যে, গ্রামের এক লোক বিক্রির জন্য পণ্য নিয়ে শহরে আসার পর, এক শহুরে বলে যে, এখন পণ্য বিক্রি করো না। কারণ এখন দাম কম। সামনে বাজার বাড়বে। সুতরাং তুমি পণ্যগুলো আমার নিকট দিয়ে চলে যাও, মূল্য বাড়লে আমি তা বিক্রি করে তোমার কাছে টাকা পাঠিয়ে দিব। রাসূল (সা.) এক হাদিসে বলেছেন, শহুরে গ্রাম্য ব্যক্তির পক্ষ থেকে বিক্রি করবে না। বরং লোকদের স্বাভাবিকভাবে বিক্রি করতে দাও। আল্লাহ তায়ালা কতককে কতকের দ্বারা রিযিক দিয়ে থাকেন। (সহিহ মুসলিম-১৫২২)।
অর্থাৎ সাধারণ শহরবাসীকে আল্লাহ তায়ালা গ্রামের লোকদের দ্বারা কম মূল্যে খাওয়াবেন। এই ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্থ করা ঠিক হবে না। রাসূল (সা.) এর এই হাদিসের ভিত্তিতে ফকিহগণ এভাবে মধ্যস্থতার ভিত্তিতে বিক্রিকে মাকরূহ বলেছেন। কারণ, এর দ্বারা শহরবাসীর কষ্ট হবে এবং সিন্ডিকেট করে পণ্যের মূল্য বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হবে। যদি এ সমস্যাগুলো না হয় তাহলে মাকরূহ হবে না।
গ্রাম্য কারবারির পক্ষ থেকে শহুরে ব্যবসায়ীর বিক্রি নিষেধ হওয়ার হাদিস এ কথাই প্রমাণ করে যে, ভোক্তা ও উৎপাদনকারীর মাঝে মধ্যস্থতাকে ইসলাম পছন্দ করে না বা কম হওয়াকে পছন্দ করে। কারণ, মধ্যস্থতাকারী যত বৃদ্ধি পাবে পণ্যের মূল্যও তত বাড়বে। সুতরাং মধ্যস্থতা বা দালালি যদিও জায়েজ কিন্তু ইসলামের নির্দেশনা হচ্ছে না করা বা যত কম করা যায়।
বর্তমানে বাজার ব্যবস্থা পাইকারদের দ্বারা এত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত যে, তাদের মধ্যস্থতা ছাড়া বাইরের কোনো কারবারি বাজারে পণ্যই ওঠাতে পারে না। আবার পণ্য বিক্রিও করতে হয় ওদের নির্ধারিত মূল্যে; এর কমে বিক্রির কোনো সুযোগ নেই। এ কারণে বাংলাদেশের কৃষক ও ভোক্তা উভয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। সরকারেরও ওদের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই রাষ্টীয় আইন ওদের ওপর প্রয়োগ করতে পারে না। কিন্তু মুসলমানের অন্তরে দ্বীনের কথার গুরুত্বই অন্য রকম। তাই দ্বীনি বিষয় হিসেবে যদি আমরা উক্ত বিষয়কে পেশ করতে পারি তাহলে ফলাফল অন্য রকম হবে ইনশাআল্লাহ।
দালালির ভিত্তিতে বিক্রির নিষিদ্ধ একটি সুরত:
দালালির ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয় জায়েজ। এখানে দালালি বলতে বুঝানো হয়েছে, পণ্য বিক্রির জন্য ক্রেতা সংগ্রহ করে দেয়া বা ক্রেতাকে পণ্যের সন্ধান দেয়া। তবে অপর এক প্রকার দালালি আছে, যার ভিত্তিতে বিক্রি করা নিষেধ। হাদিস ও ফিকহের পরিভাষায় এটাকে ‘নাজিশ’ বলা হয়। এই দালালির সুরত হচ্ছে, দালাল নিজে পণ্য কেনার ইচ্ছে নেই, কিন্তু পণ্যের দামাদামি করে অনেক বেশি মূল্যে কিনার আগ্রহ প্রকাশ করে। উদ্দেশ্য, যে ক্রেতা পণ্য কিনতে এসেছে দালালের দাম শুনে ধোঁকায় পড়ে যাবে এবং পূর্বের চেয়ে আরো বেশি মূল্য দিয়ে কিনে নিবে। এজন্যে একজন পণ্যের দাম বলা অবস্থায় অন্যজনের দাম বলতে হাদিসে নিষেধ করা হয়েছে।
রাসূল (সা.) বলেন, এক মুসলমান যেন অপর মুসলমানের ওপর গিয়ে পণ্যের দাম না বলে এবং বিবাহের আলোচনা চলা অবস্থায় প্রস্তাব না দেয়। তবে যদি অনুমতি দেয়। কোনো কোনো বর্ণনায় সরাসরি এ ধরনের দালালি নিষিদ্ধের কথা এসেছে। (সহিহ মুসলিম-১৪১২)। এ ধরনের বিক্রি যেহেতু ধোঁকায় ফেলে করা হয় এ জন্য সর্বসম্মতিক্রমে তা হারাম ও গোনাহের কাজ। তবে এভাবে বিক্রয় চূক্তি সম্পন্ন হয়ে গেলে ইমাম মালেক (রাহ.) এর মতে মালিকানা হাসিল হবে না, কিন্তু অন্যদের মতে বিক্রয় দ্বারা মালিকানা হাসিল হবে। গ্রামদেশের গরুর দালালি সাধারণত এমন হয়ে থাকে। কখনো কখনো গরুকে এমন স্থানে দাঁড় করানো হয় দেখলে বিশাল বড় মনে হয়। কিন্তু বাস্তবে সে রকম না। এগুলো থেকেও বেঁচে থাকা উচিত।
পণ্য কবজা করার আগেই বিক্রি করে দেয়া:
ইসলাম ক্রয়-বিক্রয় সম্পর্কে যে বিধি-বিধান দিয়েছে, এর অন্যতম একটি হচ্ছে, ব্যক্তি পণ্য ক্রয়ের পর কবজা করার পূর্বে অন্যত্র বিক্রি করতে পারবে না। কবজা বলতে নিজের অধীনে নিয়ে আসাই নয় বরং পণ্যে যেকোনো ধরণের অধিকার প্রয়োগের সুযোগ করে দেয়াও কবজার অন্তর্ভূক্ত। যেমন: একজন একটি পণ্য কেনার পর বিক্রেতার ঘরেই রেখে দিলো এবং বিক্রিতাও তাকে পণ্যের মধ্যে সর্বপ্রকার হস্তক্ষেপের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দিলো তাহলে এটাও ক্রেতার কবজায় আছে বলে ধরা হবে। হাদিসে কবজার পূর্বে পণ্য অন্যত্র বিক্রি করতে নিষেধ করা হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেন, কবজা করা ছাড়া যেন কোনো ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করে অন্যত্র বিক্রি না করে। (সহিহ মুসলিম-১৫২৫)।
গাছের ফল, পাড়া ফলের বিনিময়ে এবং খেতের শস্য, ঘরের শস্যের বিনিময়ে বিক্রি করা:
যে সকল পণ্য সুদি মালের অন্তর্ভূক্ত, তাতে কমবেশি করে বিক্রি করা জায়েজ নেই। যেমন গাছের ফল, পাড়া ফলের বিনিময়ে এবং খেতের শস্য, ঘরের শস্যের বিনিময়ে বিক্রি করা। এ ধরণের ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ হওয়া কারণ হচ্ছে, এগুলো সুদি মালের অন্তর্ভূক্ত আর সুদি মাল অনুমান করে বিক্রি করলে কমবেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাই এরূপ বিক্রি জায়েজ নেই। পাড়া ফলের বিনিময়ে গাছের ফল এবং ঘরের শস্যের বিনিময়ে খেতের শস্য বিক্রি করা নিষিদ্ধে হাদীস মুসলিম শরীফে বর্ণীত হয়েছে। (মুসলিম, হাদিস ন-১৫৩৬)।