রোজার কিছু আধুনিক মাসআলা
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৩:৪৫ পিএম, ১০ মে ২০১৯ শুক্রবার
রোজার কিছু মাসআলা রোজাদারসহ ডেইলি বাংলাদেশের সব পাঠকদের জন্য তুরে ধরা হলো-
(এক) রোজা রেখে রক্ত দেয়া বা নেয়ার বিধান:
অনেকে মনে করেন রোজা রেখে রক্ত দিলে বা নিলে রোজার ক্ষতি হবে বা রোজা ভেঙ্গে যাবে। এ কথাটি ঠিক নয়। বরং রোজা রেখে রক্ত দিলে বা নিলে রোজার কোনো ক্ষতি হয় না। এ প্রসঙ্গে ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা নামক কিতাবে লেখা হয়েছে, ‘রক্ত দিলে বা নিলে কোনো অবস্থাতেই রোজা ভঙ্গ হবে না। কারণ রক্ত দিলে তো কোনো বস্তু দেহের অভ্যন্তরে ঢুকেনি, তাই এতে রোজা ভাঙ্গার প্রশ্ন আসে না। আর রক্ত নিলে যদিও তা দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে কিন্তু তা রোজা ভঙ্গ হওয়ার গ্রহণযোগ্য খালি জায়গায় প্রবেশ করে না। তেমনিভাবে রোজা ভঙ্গ হওয়ার জন্য গ্রহণযোগ্য যে রাস্তা দিয়ে প্রবেশের কথা, তা দিয়ে প্রবেশ করে না। বিধায় রোজা ভঙ্গ হবে না। (পৃষ্ঠা-৩২৬)
(দুই) রোজা রেখে সালবুটামল ও ইনহেলার ব্যবহারের বিধান:
সালবুটামল, ইনহেলার ব্যবহার করলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। শ্বাস কষ্ট দূর করার জন্য ওষুধটি মুখের ভেতর স্প্রে করা হয়। এতে যে জায়গায় শ্বাসরুদ্ধ হয় ওই জায়গাটি প্রশস্ত হয়ে যায়। ফলে শ্বাস চলাচলে আর কোনো কষ্ট থাকে না। ওষুধটি যে শিশিতে যে পরিমাণ থাকে ওই শিশির মুখ একবার টিপলে শিশির আকারভেদে ওই পরিমানের একশ বা দুশ ভাগের এক ভাগ বের হয়ে আসে। অতি অল্প পরিমাণে গ্যাসের ন্যায় বের হওয়ার কারণে কেউ ওষুধটিকে বাতাস জাতীয় মনে করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এমন নয় বরং ওষুধটি দেহ বিশিষ্ট্য। কাঠ ইত্যাদি কোনো বস্তুতে স্প্রে করলে দেখা যায় যে, ওই বস্তুটি ভিজে গেছে। তাই এতে রোজা ভেঙ্গে যাবে।
আরো পড়ুন>>> খেজুর দ্বারা ইফতার করা মুস্তাহাব
অনেককে বলতে শুনা যায় যে, ‘ইনহেলার অতি প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়, তাই এতে রোজা ভঙ্গ হবে না।’ এ কথাটি একেবারেই ঠিক নয়। কেননা কোনো ব্যক্তি যদি ক্ষুধায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে অতি প্রয়োজনে কিছু খেয়ে ফেলে তাহলে কী অতি প্রয়োজনে খাওয়ার কারণে তার রোজা ভঙ্গ হবে না? অবশ্যই হবে। অতি প্রয়োজনে রোজা ভাঙ্গলে পরবর্তিতে কাযা করা ও এতে গুনাহ না হওয়া ভিন্ন কথা। হ্যাঁ, মুখে ইনহিলার স্প্রে করার পর, তা না গিলে যদি থুথু দিয়ে মুখের বাইরে ফেলে দেয়া হয় তাহলে রোজা ভঙ্গ হবে না। কারো যদি এ ভাবে কাজ চলে যায় তাহলে বিষয়টি অনেক সহজ। কারণ এতে শ্বাস কষ্ট থেকে রেহাই পেয়ে যাবে আবার রোজাও ভাঙ্গবে না।
(তিন) রোজা রেখে ইনজেকশন নেয়ার বিধান:
অনেকেই রোজা রেখে ইনজেকশন নেয়াকে সমস্যা মনে করে। এক্ষেত্রে মাসআলা হচ্ছে রোজা রেখে ইনজেকশন নিলে রোজা ভঙ্গ হবে না। চাই ইনজেকশান গোশতে নেয়া হোক বা কোনো রগে। কারণ ইনজেকশনের ওধুষ যে জায়গা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে, তা রোজা ভাঙ্গার জন্য গ্রহণযোগ্য রাস্তা দিয়ে ভেতরে প্রবেশের যে শর্তারোপ করা হয়েছে সেটা নয়। (ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা-৩২৭)
(চার) স্যালাইন নেয়ার বিধান:
রোজা রেখে স্যালাইন নিলে রোজা ভঙ্গ হবে না। কারণ, স্যালাইন নেয়া হয় রগে। আর রগ রোজা ভঙ্গের কোনো গ্রহণযোগ্য রাস্তা নয়। তবে রোজার দুর্বলতা দূর করার লক্ষ্যে স্যালাইন নেয়া মাকরুহ। (ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা-৩২৭)
(পাঁচ) ঋতুবর্তী মহিলা রোজার সময় ওষুধ খেয়ে ঋতু বন্ধ রাখার বিধান:
শরীয়তের মাসয়ালা হচ্ছে, রোজা অবস্থায় কোনো মহিলা ঋতুবর্তী হয়ে গেলে সে আর রোজা রাখবে না বরং পরবর্তীতে কাযা করে নেবে। কোনো মহিলা যদি ওষুধ সেবন করে রোজার মাসে ঋতু বন্ধ করে রাখে তাহলে তার কোনো গোনাহ হবে না এবং নামাজ ও রোজা যথা নীয়মে আদায় করতে হবে।
উল্লেখ্য, চিকিৎসা শাস্ত্রের আলোকে কোনো মহিলা ঋতুবর্তী হওয়া তার সুস্থতার আলামত। এর ব্যতিক্রম ঘটলে অসুস্থ হওয়ার আশংকা থাকে। সুতরাং সুস্থতার পরিপন্থি কাজ থেকে বেচে থাকা শরয়ীর আলোকেও গুরুত্বপূর্ণ। (ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা-৩২৫)
(ছয়) ডুশ নেয়ার বিধান:
ডুশ নেয়ার দ্বারা রোজা ভেঙ্গে যায়। কারণ ডুশ মলদ্বারের মাধ্যমে দেহের ভেতরে প্রবেশ করে। মলদ্বার রোজা ভঙ্গ হওয়ার গ্রহণযোগ্য রাস্তা এবং ডুশ যে জায়গায় প্রবেশ করায় ওই জায়গায়ও রোজা ভঙ্গ হওয়ার গ্রহণযোগ্য খালিস্থান। (ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা-৩৩০)
(সাত) রোজা রেখে কানে ওষুধ বা ড্রপ ব্যবহারের বিধান:
পূর্বের যুগের ডাক্তারদের মত ছিলো কানের সঙ্গে খাদ্যনালী সংযোগ রয়েছে। এতে কানে কোনো ওষুধ ব্যবহার করলে খাদ্যনালী দিয়ে পাকস্থলিতে পৌছে যায়। এ জন্য আগেকার ফকীগণের মত ছিলো কানে ওষুধ ব্যবহার করলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু বর্তমানে ডাক্তারদের মত হচ্ছে কান ও খাদ্যনালীর মাঝে কোনো সংযোগ নেই। তাই বর্তমানের ফকীহদের মত হচ্ছে কানে ওষুধ ব্যবহার করলে রোজা ভাঙ্গবে না।
(আট) চোখে ওষুধ ব্যবহারের বিধান:
কানে ড্রপ, ওষুধ ও তেল ইত্যাদি ব্যবহার করলে যেমন রোজা ভাঙ্গে না তেমনি চোখেও ওগুলো ব্যবহার করলে রোজা ভাঙ্গবে না। যদিও চোখে কোনো ওষুধ ব্যবহার করলে এর স্বাদ গলায় পাওয়া যায়। কারণ চোখে কিছু দিলে রোজা না ভাঙ্গার বিষয়টি হাদিস দ্বারা প্রমাণীত। (ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা-৩২২)
(নয়) নাকে ওষুধ ব্যবহার করার বিধান:
নাকে ড্রপ, তেল, পানি বা অন্য কনো ওষুধ দিয়ে ভেতরে টেনে নিলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। কারণ রোজা ভঙ্গ হওয়ার জন্য ফকীহগণ যে সকল গ্রহণযোগ্য রাস্তা চিহিৃত করেছেন, যেগুলো দিয়ে কোনো বস্তু ভেতরে প্রবেশ করলে রোজা ভেঙ্গে যাবে, নাক এর মধ্যে অন্যতম।
(দশ) রোজা অবস্থায় এন্ডোস্কপি করার বিধান:
চিকন একটি পাইপ মুখ দিয়ে ঢুকিয়ে পাকস্থলীতে পৌছানো হয়। পাইপটির মাথায় বাল্ব জাতীয় একটি যন্ত্র লাগানো থাকে। পাইপটির অপর প্রান্তে থাকা মনিটরের মাধ্যমে রোগীর পেটের অবস্থা নির্ণয় করা হয়। এই পরীক্ষাকে চিকিৎসার বিদ্যায় এন্ডোস্কপি বলে। যদি পাইপের মাথায় কোনো মেডিসিন বা পানি না থাকে তাহলে এর দ্বারা রোজা ভঙ্গ হবে না। সাধারণত এমনটিই হয়ে থাকে। আর যদি ওষুধ বা কোনো মেডিসিন লাগানো থাকে তাহলে এর দ্বারা রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। কখনো পরীক্ষা করতে গিয়ে পাইপের ভেতর দিয়ে পানি ছিটিয়ে দেয়া হয়, এর দ্বারাও রোজা ভেঙ্গে যাবে। (ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা-৩২৫)
(এগার) রোজা রেখে এনজিওগ্রাম করানোর বিধান:
হার্টের রক্তনালী ব্লক হয়ে গেলে উরুর গোড়ার দিকে কেটে একটি বিশেষ ধমণীর ভেতর দিয়ে ক্যাথেটার ঢুকিয়ে পরীক্ষা করাকে ‘এনজিওগ্রাম’ বলা হয়। উক্ত ক্যাথেটারে কনো মেডিসিন লাগানো থাকলেও যেহেতু ক্যাথেটারটি রোজা ভঙ্গের কোনো গ্রহণযোগ্য খালি জায়গায় ঢুকে না এবং রোজা ভাঙ্গার জন্য কোনো গ্রহণযোগ্য রাস্তা দিয়েও প্রবেশ করানো হয় না তাই এনজিওগ্রাম করার দ্বারা রোজা ভঙ্গ হবে না।
(বার) কপারটি:
কপারটি বলা হয় যোনিদ্বারে প্লাষ্টিক ফিট করা যেন সহবাসের সময় বীর্য জরায়ুতে পৌছতে না পারে। এমন করলে রোযা ভঙ্গ হবে না। কারণ যোনিদ্বার রোযা ভঙ্গ হওয়ার গ্রহণযোগ্য রাস্তা নয়। তবে কপারটি লাগিয়ে রমজান মাসে সহবাস করলে রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা ও কাফফারা উভয়টি ওয়াজিব হবে। (ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা-৩২৯)
(তের) সাপজিটরি- ভোল্টালিন ব্যবহারের বিধান:
সাপজিটরি- ভোল্টালিন ব্যবহারের বিধান হচ্ছে, এটা ব্যবহার দ্বারা রোজা ভেঙ্গে যাবে। খুব বেশি জ্বর বা অতিরিক্ত ব্যথা দেখা দিলে এটাকে মলদ্বারে ব্যবহার করা হয়। এটা ব্যবহার দ্বারা রোজা ভঙ্গের কারণ হচ্ছে, যে সকল রাস্তা দিয়ে কোনো কিছু ভেতরে প্রবেশ করালে রোজা ভেঙ্গে যায় এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মলদ্বার।
(চৌদ্দ) গর্ভপাত:
এম আর করালে রোজা ভেঙ্গে যায়। গর্ভপাতের ক্ষেত্রে এম আর হচ্ছে, গর্ভ ধারণের পাঁচ থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে যোনিদ্বার দিয়ে জরায়ুতে ‘এম আর’ সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে জীবিত কিংবা মৃত ভ্রুণ বের করে নিয়ে আসাকে ‘এম আর’ বলে।
উল্লেখ্য, যদিও ‘এম আর’ ডাক্তারদের পরিভাষায় গর্ভপাত কিন্তু শরীয়তের পরিভাষায় এটা গর্ভপাত নয়। কেননা, এম আর আট সপ্তাহের ভেতরে হয়। আর এ সময়ের ভেতরে সাধারণত বাচ্চার কোনো অঙ্গ, নখ চুল ইত্যাদি প্রকাশ পায় না। আর কোনো অঙ্গ প্রকাশের আগে বাচ্চা বের হয়ে এলে, একে শরয়ী পরিভাষায় গর্ভপাত বলা যায় না। এবং এম আর এর পরে যে স্রাব বের হয় তাকে নেফাসও বলা যায় না। নেফাস হচ্ছে ওই রক্ত যা বাচ্চা জন্ম দেয়ার পর বের হয়। তথাপি এম আর করার দ্বারা রোজা ভেঙ্গে যাবে। কেননা এম আর করার পর যে স্রাব বের হয় তাকে মাসিক ধরা হবে। আর রোজা অবস্থায় মাসিক হলে রোজা ভেঙ্গে যায়। (ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা-৩২৮)
কোনো কোনো সময় ৪২ দিন মতান্তরে ৫২ দিনেও বাচ্চার অঙ্গ প্রকাশ পেয়ে যায়। যদি কারো ক্ষেত্রে এমন দেখা যায় তাহলে ওই মহিলার ক্ষেত্রে এম আর গর্ভপাত হিসেবে ধরা হবে। তখন এক্ষেত্রে গর্ভপাতের কারণে রোজা ভেঙ্গে যাবে এবং পরবর্তী স্রাব নিফাস হিসেবে গণ্য হবে।
(পনের) নাইট্রোগ্লিসারিন ব্যবহারের বিধান:
নাইট্রোগ্লিসারিন ব্যবহার করলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। এ্যারোসল জাতীয় এক প্রকারের ওষুধ যা হার্টের রোগীদের এভাবে ব্যবহার করানো হয় যে, ২/৩ ফোটা ওষুধ জিহ্বার নিচে দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখা হয়। এতে ওই ওষুধ যদিও শিরার সঙ্গে মিশে যায় তারপরও কিছু ওষুধ গলায় পৌছে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে এতে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। এবং এর মধ্যেই সতর্কতা। তবে ওষুধটি ব্যবহারের পর যদি না গিলে থুথু দিয়ে ফেলে দেয়া হয় তাহলে রোজা ভঙ্গ হবে না। (ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা-৩২৫)