রোববার   ১১ মে ২০২৫   বৈশাখ ২৮ ১৪৩২   ১৩ জ্বিলকদ ১৪৪৬

২ হাজারের বেশি প্রত্ন-সামগ্রীর চবি জাদুঘর

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৮:৪৯ পিএম, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮ বৃহস্পতিবার

সবুজ চাদর মোড়ানো এক নান্দনিক সৌন্দর্যের নাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার উত্তরে হাটহাজারী উপজেলার ফতেয়াবাদ গ্রামে কোলাহলমুক্ত পরিবেশে প্রায় ২১০০ একরের পাহাড়ি ও সমতল ভূমি নিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। সুবিশাল আয়তন, পাহাড়, আকাশের সাথে মিতালী গড়া বৃক্ষরাজি, পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা স্বচ্ছ পানির ঝর্ণা, লেক, উদ্যান, হরেক রকমের পাখি, বিলুপ্তপ্রায় নানা জীবজন্তু মিলে জ্ঞানপিপাসুদের জন্য এ ক্যাম্পাস আদর্শ এক তীর্থস্হান। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত জাদুঘর এতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। চট্টগ্রামের একমাত্র শিল্প জাদুঘর এটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এ জাদুঘরের খ্যাতি দেশজোড়া। একুজিশন রেজিস্টারের তালিকা অনুযায়ী জাদুঘরে দু্ই হাজারের বেশি প্রত্ন-সামগ্রী রয়েছে।

পথচলা যেভাবে শুরু :

ইতিহাস বিভাগের বিশেষায়িত জাদুঘর হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর প্র্রাতিষ্ঠানিকভাবে উন্মুক্ত হয় ১৪ জুন ১৯৭৩ সালে। কিন্তু এর কার্যক্রম আরম্ভ হয় যেদিন চবি তার আনুষ্ঠানিক কর্মকান্ড শুরু করে অর্থাৎ ১৮ নভেম্বর ১৯৬৬। চবির উদ্বোধনের এ ক্ষণকে স্মরণীয় করে রাখতে কর্তৃপক্ষ ২৪টি প্রত্ন-সামগ্রী নিয়ে একটি প্রদর্শনির আয়োজন করে। মূলত: এ প্রদর্শনীর মাধ্যমেই একটি জাদুঘরের স্বপ্ন ডালপালা মেলতে শুরু করে। মিউজিয়াম এসোসিয়েশন অব পাকিস্তানের তৎকালীন সভাপতি ও ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ব্যবস্হাপনা পরিচালক মমতাজ হাসান প্রদর্শনকৃত ঐ সব প্রত্ন-সামগ্রী বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেন।

চবির প্রথম উপাচার্য, প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রফেসর আজিজুর রহমান মল্লিক এবং বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও ইতিহাস বিভাগের প্রধান এবং পরবর্তীকালীন উপাচার্য প্রফেসর ড. আবদুল করিম জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ধারণাকে লালন করে সক্রিয়ভাবে প্রত্ন-সামগ্রী সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে আজিজুর রহমান মল্লিকের পৃষ্ঠপোষকতা এবং ড. আবদুল করিমের তত্ত্বাবধানে ইতিহাস বিভাগের প্রথম ব্যাচের ফিল্ডসার্ভে পরিচালিত হয়। সমন্বিত প্রচেষ্টার এ যৌথ জরিপের মাধ্যমে পুরাকীর্তি ও অন্যান্য প্রত্ন-নিদর্শন সংগ্রহ করা হয়। এই জরিপ কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রত্ন-সামগ্রীগুলো ইতিহাস বিভাগের একটি কক্ষে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়।

পাহাড়ের কোলঘেঁষে চবি কেন্দ্রীয় গ্রণ্থাগারের পাশে ছোট্ট টিলার উপর দ্বিতল একটি ভবনে জাদুঘরের বর্তমান অবস্থান। জাদুঘরের সামনে একটি মুক্তমঞ্চ ও “একুশে চত্ত্বর” নামক বাগানটি জাদুঘরের সৌন্দর্যকে বাড়িয়েছে বহুগুণ।

 

ভবনটির নিচতলায় রয়েছে গবেষণা কেন্দ্র, আলোকচিত্র স্টুডিও, কনজারভেশন ল্যাবরেটরী, একটি অস্হায়ী প্রদর্শনী ও সেমিনার কক্ষ, একটি ডকুমেন্টেশন ও গবেষণা কেন্দ্র, জাদুঘরের স্টোর ‍রুম, অফিস কক্ষসমূহ এবং আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ কোষ গ্রণ্থাগার। এ গ্রণ্থাগারে রয়েছে তালপাতা ও তুলট কাগজে লেখা দূর্লভ পুঁথিসমগ্র। জাদুঘর ভবনটির দ্বিতীয় তলা পাঁচটি গ্যালারিতে বিভক্ত্।

প্রাগৈতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ব গ্যালারি :

চবি জাদুঘর শুরুর দিক থেকেই প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহের বিষয়ে সচেতন ভূমিকা রাখে। চট্টগ্রাম মহানগরীর নাসিরাবাদ পাহাড় হতে প্রাপ্ত টার্সিয়ারি যুগের একটি মাছের ফসিল উপহার হিসেবে পায় বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর। আর এটিই সংগ্রহশালার সর্বপ্রাচীন নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত। এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক ইতিহাস অধ্যয়ন ও গবেষণায় এটির রয়েছে অসামান্য অবদান। এই গ্যালারিতে আরো রয়েছে প্রায় ২০ হাজার বছরের পুরনো কাঠের ফসিল, কুমিল্লার কোটবাড়ি থেকে পাওয়া সপ্তম শতাব্দীর ল্যাম্পস্ট্যাণ্ড, সোমপুর বিহার ও কোটবাড়ির পোড়া মাটির ফলক, ধাতুচিত্র, অলংকৃত ইট, কাদা মাটির মূর্তি ইত্যাদি।

 

 

ভাস্কর্য গ্যালারিতে সংরক্ষিত বিভিন্ন ভাস্কর্যসমূহ গৌরবময় অতীতের কথা মনে করিয়ে দেয় দর্শনার্থীদের।ব্রাক্ষ্ণণ্য ও বৌদ্ধ প্রতিকৃতিগুলো থেকে সহজেই তৎকালীন সময়ের বিশ্বাস, রীতিনীতি, সংস্কৃতি এবং অলংকার সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। এ সংগ্রহশালার সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু হিসেবে বিবেচিত হয় দুষ্প্রাপ্য ৫২টি কষ্ঠিপাথরের মূর্তি। রয়েছে ২৮টি ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য এবং ধাতু নির্মিত কিছু ভাস্কর্য যার অধিকাংশই পাল আমলের (৮০০-১২০০খ্রিষ্টাব্দ)। গুপ্ত সাম্রাজ্যের (৩২০-৫৫০খ্রিষ্টাব্দ) একটি সূর্য মূর্তি রয়েছে এ জাদুঘরে। আরো রয়েছে বৈষ্ণব, শিব, সুরিয়া, শাক্ত এবং গাণপত্য পৌরাণিক চরিত্রসমূহের মূর্তি এবং ভাস্কর্য। এছাড়া রয়েছে চট্টগ্রামের মিরশরাই থেকে প্রাপ্ত ৯ম শতকের সেণ্ড পাথরের ভাস্কর্যের গরুড় রাধা বিষ্ণুর একটি প্রাচীনতম নিদর্শন।

ইসলামিক শিল্প গ্যালারি :

এ গ্যালারিতে সংরক্ষিত সামগ্রীগুলো মুসলিম সভ্যতার তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অবস্থার একটি চিত্র ফুটিয়ে তোলে দর্শনার্থীদের সামনে। এ গ্যালারিতে রয়েছে হাতে লেখা কুরআন শরিফ, শিলালিপি, কারুকাজ মসজিদের দেয়ালের খণ্ডিত অংশ, নকশে সুলেমানি, ১২০৯ সালের আলমগীর নামা, ফার্সী ভাষার গুলিস্তা, ১২২৯-৩৬ সালের হাতে লেখা ফার্সি কাবিননামা, ১০৬১ হিজরীতে লেখা মেপতাহুস সালাত। সম্রাট শাহজাহানের কামান, মুঘল আমলের ঢাল-তলোয়ার, উমাইয়া এবং সুলতানি আমলের স্বর্ণ ও রুপ্য মুদ্রা এ সংগ্রহশালাকে দান করেছে অনন্য উচ্চতা।

 

 

আবহমান বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক অনন্য সংগ্রহশালার নাম চবি জাদুঘর। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া পালকি, গ্রামোফোন, শীতল পাটি, হাতে তৈরি চরকা, তাঁত ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যাবে এ গ্যালারিতে। তবে বাঘের মাথা, প্রথম যুগের সিরামিক সামগ্রী, রাজকীয় লাঠির মাথা, হাজার বছর আগেকার মানুষের ব্যবহৃত অলংকার দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে বেশি।

 

একি ছাদের নিচে বাংলাদেশের খ্যাতিমান প্রায় সব শিল্পীর চিত্রকর্ম যারা অবলোকন করতে চান তাদের জন্যই এ গ্যালারী আদর্শ একটি মাধ্যম। এ গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, এস এম সুলতান, মর্তুজা বশীর, রশীদ চৌধুরী, নিতুন কুণ্ডু ও হাশেম খানের মতো শিল্পীদের নানা চিত্রকর্ম এবং সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের ভাস্কর্য।

 

জাদুঘরের সংরক্ষণাগারে রয়েছে প্রাচীন ও দূর্লভ আরবী, সংস্কৃত, ফার্সী, পালি ও বাংলা পাণ্ডুলিপি-নথি এবং দুষ্প্রাপ্য ছাপানো বই, পুস্তিকা, পোস্টার,পত্রিকা, সাময়িকী, পত্রিকার কর্তনী । মরিচ পাতায় ও পুরনো কাগজে লিখিত প্রাচীন সংস্কৃত ও পালি পাণ্ডুলিপির ৯৮টি টুকরো, যা উক্ত বিষয়ে দক্ষ অনুবাদক না থাকায় এখনো অনূদিত হয়নি। সংরক্ষণাগারে সংরক্ষিত অনন্য একটি বস্তু হলো জেমস রেনেলের “হিন্দুস্থান বা মুঘল সাম্রাজ্য এবং তার বেঙ্গল মানচিত্র”। সংরক্ষণাগারের মুক্তিযু্দ্ধ কর্ণারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ের দূর্লভ চিঠি, দলিলপত্র, স্মারকগ্রণ্থ, নথিপত্র এবং মুক্তিযুদ্ধে আত্নদানকারী চবি ছাত্রদের নিয়ে প্রকাশিত বিভিন্ন লেখা সংরক্ষিত আছে।

 

 

 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর যেন লেখকও গবেষকদের জন্য এক নির্ভরতার নাম। ইতিহাস চর্চা, ইতিহাসগ্রণ্থ রচনা ও গবেষণার জন্য এ জাদুঘরে সংরক্ষিত পাণ্ডুলিপি, নথিপত্র ও প্রত্ন-সামগ্রীগুলো ব্যবহৃত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।

ব্যতিক্রমী এক জাদুঘর :

সাধারণত প্রায় সব জাদুঘরেই নির্দিষ্ট একটা ফি দিয়েই দর্শনার্থীদের প্রবেশ করতে হয়। কিন্তু চবি জাদুঘর এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এখানে কোন প্রবেশমূল্য নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মদিবসগুলোতে জাদুঘরের দুয়ার সব শ্রেণীর মানুষের জন্য খোলা থাকে।

 

 

সাধারণ মানুষের কৌতুহলী মনকে জাগিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের গুরুত্ব অনুধাবন করতে সহায়তা করছে চবি জাদুঘর। মূল উপাদান ও গবেষণাধর্মী তথ্য উপাত্ত যোগানের মাধ্যমে একাডেমিক জাদুঘর হিসেবে উন্নত শিক্ষা ও গবেষণার পথকে সুগম করেছে এ জাদুঘর।