খোলা শরবতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৭:৪৩ এএম, ১৭ মে ২০১৯ শুক্রবার
তীব্র দাবদাহে একটু প্রশান্তি পেতে রাজধানীর পথচারীদের পছন্দ ফুটপাত ও রাস্তার পাশে বানানো বিভিন্ন শরবত ও আখের রস। কেউ কেউ আবার ভরসা করেন ‘ঔষধি শরবত’ এর উপরও।
গ্রীষ্ম এলেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাত ও ভ্যানগাড়িতে করে শুরু হয় এসব ঠাণ্ডা পানীয় বিক্রির প্রতিযোগিতা। একটি পানির ফিল্টারের মধ্যে বরফ, কয়েক শ লেবু ও ‘ড্রিংক পাউডার’ নিয়েই চলে এই পানীয় তৈরির প্রক্রিয়া। শুধু লেবুর পানি এক গ্লাস ৫ টাকা এবং ড্রিংক পাউডার বা অন্যান্য বিভিন্ন উপাদান দিয়ে মেশানোর লেবুর পানি প্রতি গ্লাস ১০ টাকা থেকে ৩০ টাকা পর্যন্তও বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে প্রচন্ড গরম থেকে এসব শরবতে সাময়িক প্রশান্তি মিললেও অনেক সময় এটি স্বাস্থ্যঝুঁকিরও বড় কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞরাও এ বিষয়ে নানা মতামত দিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর ফুটপাতের এসব খোলা শরবত পানে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে পানিবাহিত রোগে আক্রান্তদের একটি বড় অংশ রাস্তার পাশের এসব খোলা পানীয় পান করে অসুস্থ হয়।
যে কোনো পরিবেশে তৈরি এসব শরবত পানে কিডনি বিকল, পানিবাহিত রোগ, গ্যাস্ট্রিক, হেপাটাইটিস বি-ভাইরাস, লিভারের জটিলতা, পাকস্থলীতে প্রদাহ, খাদ্যনালিতে সমস্যা, পেপটিক আলসারসহ মারাত্মক জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। আর ডায়রিয়ার মতো পানিবাহিত রোগের অন্যতম কারণ জীবানুযুক্ত পানি। বিশেষ করে বরফমিশ্রিত শরবত এ জন্য বিশেষভাবে দায়ী বলেও জানান তারা।
ফুটপাতের খোলা খাবারের বিষয়ে চিকিৎসকদের পরামর্শ হলো, বাইরের খোলা খাবার, অনিরাপদ পানি, রাস্তার দোকানের শরবত, আখের রস ইত্যাদি এড়িয়ে চলা। বাইরে বের হওয়ার সময় বাসা থেকে বিশুদ্ধ খাবার পানি, কাঁচের বোতলে বহন করা। খাবার পানি ভালো করে ফুটিয়ে তারপর ঠান্ডা করে পরিষ্কার পাত্রে সংরক্ষণ করা। ফুটানো পানি দুই দিনের মধ্যে পান না করলে তা ফেলে দিয়ে আবার নতুন করে পানি ফোটাতে হবে।
রাজধানীর ফুটপাতের বিভিন্ন প্রকার খোলা শরবত কতটুকু স্বাস্থ্যকর জানতে চাইলে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাঃ আ.স.ম. সেলিম রেজা বলেন, রাজধানীতে ফুটপাত বা রাস্তার ধারে ভ্যানে খোলা অবস্থায় যেসব পানীয় বিক্রি করা হচ্ছে এগুলো মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
তিনি বলেন, এগুলো পান করলে পেটের ব্যাথা, সর্দি-জ্বর, ডায়রিয়া এমনকি কিডনির সমস্যা পর্যন্ত হতে পারে। এই সব শরবত দিয়ে মানুষের হয়তো প্রাথমিক পিপাসা নিবারণ করে। কিন্তু তার দেহের মধ্যে নানা ধরনের রোগের জীবাণু প্রবেশ করার সুযোগ করে দেয়। তাই এসব পানি পান না করাই ভালো।
ফুটপাতের পানীয় কতটুকু স্বাস্থসম্মত জানতে চাইলে পুষ্টি বিজ্ঞানী ড. খুরশিদ জাহান বলেন, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও নোংরা হাতে তৈরি এসব পানীয় দীর্ঘদিন ধরে পান করলে পানিবাহিত নানা রোগের পাশাপাশি মারাত্মক ক্যান্সারও হতে পারে।
তিনি বলেন, যে গ্লাসগুলোতে শরবত বা এ ধরনের পানীয় পরিবেশন করা হয়, ব্যবহারের পর সেগুলো ধোয়া হয় অপরিষ্কার পানিতেই। বালতিতে থাকা বহু ব্যবহৃত পানিতে গ্লাসটি চুবিয়ে তাতে আবার পরিবেশন করা হয় শরবত। এর ফলে পানিবাহিত ও সংক্রামক নানা রোগ এক শরীর থেকে অন্য শরীরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
ফুটপাত বা রাস্তার পাশে ভ্যানের এসব পানীয় স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, এ বিষয়টা জানা আছে প্রায় অধিকাংশ নগরবাসীরই। কিন্তু চলার পথে তৃষ্ণা মেটাতে বিকল্প না থাকায় বাধ্য হয়ে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নেন পথচারীরা। অস্বাস্থ্যকর এসব পানীয় পানকারীদের দলে আছে স্কুল-কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আছে পেশাজীবী ও শ্রমজীবীরাও।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ঘুরে দেখা গেছে, ফুটপাত ও রাস্তার পাশে ভ্যানে বিভিন্ন প্রকারের পানীয় বিক্রি হচ্ছে দেদারছে। গরমের তীব্রতা বাড়া-কমার সঙ্গে ওঠা-নামা করে ক্রেতাদের চাহিদাও।
রাজধানীর কচুক্ষেত বাজারের স্বাধীনতা চত্বরের মূল রাস্তার পাশে লেবুর শরবত বিক্রি করেন লোকমান আলি। লেবুর সঙ্গে পানি, চিনি, একটি প্রতিষ্ঠানের পাউডার ড্রিঙ্ক মিশিয়ে বানানো হয় লেবুর শরবত। দাম প্রতি গ্লাস ১০ টাকা। ক্রেতা সমাগম বাড়ে, যখন এসব পানীয়তে বরফের পরিমাণ থাকে বেশি।
তিনি বলেন, গরম বেশি হলে কাস্টমারও বেশি হয়, আর গরম কম থাকলে বেচাকেনাও কম হয়।
তার বিক্রি করা পানীয়তে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমন কিছু মেশানো হয় না দাবি করে লোকমান জানান, এলাকার একটি বরফকল থেকে ৬৫ টাকা দামে বরফের চাঁই কিনে আনেন। এই শরবতে সেই বরফ দেয়া হয়।
লোকমান আলির সঙ্গে কথা বলার সময়ই একজন ক্রেতা আসেন, তার নাম ইদ্রিস মিয়া। পেশায় রিকশাচালক। তিনি লোকমানকে শরবত দিতে বললেন। লেবুর রসের সঙ্গে প্যাকেটের ‘ড্রিংক পাউডার’ মিশিয়ে বানানো শরবত পানের সময় কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। ইদ্রিস বলেন, এটা প্রায় প্রতিদিনই খাই। গরমে শুধু পানি না খেয়ে একটু লেবুর পানি খাওয়া শরীরের জন্য ভালো। যদিও বাইরের খোলা পানীয় এভাবে খাওয়া উচিত নয়। কিন্তু কি করবো, এত গরমে ঠান্ডা লেবুর শরবত না খেলে ভালো লাগে না।
তার পাশেই প্রায় দশ কদম দূরে আব্দুল হামিদ নামের একজন আখের রস বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, আখের রসের সঙ্গে বরফের চির না দিলে কাস্টমাররা খেতে চায় না। যেদিন রসের সঙ্গে বরফ না দেই সেদিন বেচাকেনা হয় না বল্লেই চলে। কিন্তু আখের রসের সঙ্গে বরফের চির দিলে বেচাবিক্রি ভালো হয়। তাই খুব ভোরে এসব বরফের চির কিনে আনি। এতে খরচ একটু বেশি হয়। তবে বেচাকেনাও বেশি হয়।