দারিদ্র বিমোচনে জাকাতের ভূমিকা
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ১০:২৮ এএম, ১৮ মে ২০১৯ শনিবার
ইসলামে আল্লাহ তায়ালার প্রতি বিশ্বাস ও নামাজ কায়েমের পরেই জাকাতের মর্যাদা।
পবিত্র কোরআনে বিরাশি জায়গায় যেখানে নামাজ কায়েমের কথা বলা হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে বলা হয়েছে জাকাত প্রদানের কথা। তাই ইসলামে জাকাতের গুরুত্ব কতটুকু বলে বুঝাবার প্রয়োজন নেই।
রাসূল (সা.) এর ইন্তেকালের পর, তাঁর অনুপস্থিতির কারণে বাহ্যিকভাবে মনে হচ্ছিল মুসলমানরা দুর্বল। তখন কিছু লোক বাইতুল মালে জাকাত দিতে অস্বীকার করে। সাহাবায়ে কেরাম রাসূল (সা.) এর ইন্তেকালের পরপরই নিজেদের মাঝে কোনো যুদ্ধে লিপ্ত হতে চাচ্ছিলেন না। তাই বাইতুল মালে জাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে সকলেই অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু খলিফা আবু বকর (রা.) বলেন, আমি আবু বকর জীবিত থাকবো আর রাসূল (সা.) এর দ্বীনে কোন ত্রুটি হবে তা হতে পারে না। তিনি নিজেই জাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলেন। তখন অন্য সাহাবিরাও তার সঙ্গে শরীক হলেন। এর দ্বারাও প্রতীয়মাণ হয় যে, ইসলামে জাকাতের গুরুত্ব কতটুকু।
জাকাতের পরিচয় ও ইতিহাস:
জাকাত শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি, বরকত ও প্রশংসা। (ফিকহুক যাকাত-৪৫) পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে কোনো বিনিময় ছাড়া, গরিব-মিসকিনকে নির্দিষ্ট পরিমাণ মালের মালিক বানিয়ে দেয়া, তবে ওই সকল গরিব-মিসকিন রাসূল (সা.) এর বংশ বনু হাশিম বা তাদের গোলাম হতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে ফিকহের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ফতোয়ায়ে শামীতে বলা হয়েছে, ‘ জাকাত হচ্ছে আংশিক মালের মালিক বানানো, যা শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত, কোনো মুসলমান ফকিরকে, যে ফকির বনু হাশেমের নয় কিংবা বনু হাশেমের গোলামও নয়, যাকে দেয়া হচ্ছে তার থেকে কোনো উপকার লাভের চিন্তা ব্যতিরেকে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার রেজামন্দি হাসিলের নিয়তে দেয়ার নাম হচ্ছে জাকাত।’ ফতোয়ায়ে শামী, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-২০৫)
বনু হাশেমকে জাকাতের মাল দেয়া নিষিদ্ধের কারণে, যারা খাঁটি সৈয়দ বংশের লোক তারা জাকাতের অনুপযুক্ত বিষয়টি প্রমাণিত হয়। তেমনিভাবে জাকাত দেয়া যাবে না ওই ব্যক্তিকে যার সঙ্গে দাতার ফায়দার বিষয় রয়েছে। এ কথা দ্বারা মূলত দাতার মাতা-পিতাকে জাকাত দেয়া যাবে না বিষয়টি প্রমাণিত হয়। কারণ দাতা, পিতা-মাতাকে জাকাত দিলে তা সেও ভোগ করবে।
জাকাতের বিধান কখন নাযিল হয়েছে বিষয়টি নিয়ে কিছুটা মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। কারো কারো মত হচ্ছে, জাকাতের বিধান রাসূল (সা.) মক্কায় থাকতেই নাযিল হয়। কিন্তু অধিকাংশের মত হচ্ছে, মদীনায় হিজরতের পর জাকাত ফরজ হয়। অবশ্য গবেষক আলেমদের মত হচ্ছে, মৌলিকভাবে জাকাতের বিধান মক্কায় থাকতেই নাযিল হয়েছিলো। কিন্তু জাকাতের নেসাবের পরিমাণ, ফরজের শর্তসমূহ ইত্যাদি তখনও নাযিল হয়নি। বরং এ সকল বিষয় দ্বিতীয় হিজরি থেকে পঞ্চম হিজরির মাঝে বিস্তারিত নাযিল হয়। তাই দেখা যাচ্ছে মূলত দুটি মতের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।
ইসলামের জাকাত ও অন্যান্য ধর্মের দান-সদকার মাঝে পার্থক্য:
প্রাচীন ধর্মসমূহে গরিব-মিসকিনদের প্রতি ধনীদের ইহসানের কথা বলা হলেও ইসলামের জাকাত তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। নিম্নে ইসলামের জাকাত ও অন্যান্য ধর্মসমূহের দান-সদকার মাঝে পার্থক্যগুলো তুলে ধরা হচ্ছে-
(এক) ইসলামে জাকাত কখনোই শুধু একটি ভালো কাজ বা অভ্যাস হিসেবে বিবেচ্য হয়নি। বরং ঈমান ও ইসলামে অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে। হজরত ইবনে ওমর (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে, রাসূল (সা.) বলেন, ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি খুঁটির ওপর। (১) আল্লাহ ছাড়া কনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহ তায়ালার প্রেরিত রাসূল এ কথার সাক্ষ্য দেয়া। (২) নামাজ কায়েম করা। (৩) জাকাত আদায় করা। (৪) হজ ফরজ হলে, হজ করা। (৫) রমজানে রোজা রাখা। যার ওপর জাকাত ফরজ, সে জাকাত না দিলে গোনাহগার হবে। কেউ জাকাতকে অস্বীকার করলে কাফের হয়ে যাবে। কিন্তু অন্যান্য ধর্মের দান-সদকা নিছক ব্যক্তির ভালো অভ্যাস বা নেক কাজ হিসেবে বিবেচ্য। এর ওপর ধর্মের ভিত্তি, ইসলাম ছাড়া অন্য কনো ধর্ম এত গুরুত্ব ও মর্যাদা দেয়নি।
(দুই) জাকাত ধনীর মালে গরিবের হক। এই হক সুনির্দিষ্ট। কখন কতটুকু কাকে দিবে সব ইসলাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। ব্যক্তির এখতিয়ারের ওপর ছেড়ে দেয়নি যে, যখন-তখন যাকে-তাকে যতটুকু মন চায় দিবে। এতে মূলত গরিবদের হককে মজবুত করা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য ধর্মে দান-সদকা এভাবে সুনির্দিষ্ট করা হয়নি।
(তিন) জাকাত দেয়ার দায়িত্ব দাতার ওপর ন্যস্ত করা হয়নি। বরং এই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্র দাতার কাছ থেকে গ্রহণ করবে। তারপর প্রাপকদের কাছে পৌঁছে দিবে। কনো ব্যক্তি যদি জাকাত দিতে অস্বীকার করে তাহলে প্রয়োজনে রাষ্ট্র তার সঙ্গে যুদ্ধ করে তার থেকে গরিবের হক আদায় করবে।
(চার) রাষ্ট্র বা সরকার যদি জাকাত উসুলের জন্য কনো পদক্ষেপ গ্রহণ নাও করে তাহলেও দ্বীনদারী হিসেবে প্রত্যেকের দায়িত্ব হচ্ছে তা আদায় করা। কারণ জাকাত শুধু গরিবকে মাল দেয়া নয় বরং এটা একটা ইবাদতও। এর দ্বারা বান্দা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে। আর আদায় না করলে ভোগ করবে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি।
ইসলামের জাকাত ও রাষ্ট্রের ট্যাক্সের মাঝে পার্থক্য:
ইসলামের জাকাত ও অন্যান্য ধর্মের দান-সদকার মাঝে যেমন পার্থক্য আছে তেমনি জাকাত ও রাষ্ট্রীয় ট্যাক্সের মাঝেও পার্থক্য আছে। নিম্নে এমন কিছু পার্থক্য তুলে ধরা হলো-
(১) জাকাত ওয়াজিব হওয়ার মানদন্ড ও ট্যাক্স ধার্যের মানদন্ড এক নয়। যেমন সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের কম সম্পদের যদি কেউ মালিক হয় তাহলে তার ওপর জাকাত আসবে না। কিন্তু ট্যাক্স সকলকেই দিতে হয়, সরাসরি না হলে, পরোক্ষ তো অবশ্যই।
(২) জাকাতের ব্যয় খাত নির্ধারিত। পক্ষান্তরে ট্যাক্সের ব্যয় খাত নির্ধারিত নয়। বরং ট্যাক্সের টাকা অনেক সময় সরকারি কর্তা ব্যক্তিদের ভোগ-বিলাস, প্রমোদ ভ্রমণ ও অনর্থক বিনোদনে ব্যয় হয়। বর্তমানে তো জনগণের ট্যাক্সের টাকা দুর্নীতিবাজদের পেটে চলে যায়।
(৩) সরকারি ট্যাক্সের পরিমাণ খাত ভিত্তিক কমবেশি হতে পারে। কিন্তু জাকাতের পরিমাণ সব খাতে সমান। শতকরা আড়াই পার্সেন্ট জাকাত আদায় করতে হয়।
(৪) ট্যাক্স বৈধ, অবৈধ সব ধরনের মালে ধার্য করা যায়। কিন্তু জাকাত শুধু হালাল মালেই আসে। হারাম মালে জাকাত আসে না।
দারিদ্র বিমোচনে যাকাতের ভূমিকা:
অর্থনৈতিকভাবে জাকাত মানুষকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পথপ্রদর্শন করে। কারণ জাকাত দ্বারা সমাজের ওপর থেকে নিচের দিকে একটা অর্থের প্রবাহ বিদ্যমান থাকে। এতে পুঁজির অংক যত বড় হবে নিচের দিকে অর্থের প্রবাহ তত বাড়বে। এতে বাজারে প্রভাব পড়বে। কোম্পানিগুলোর উৎপাদন বেড়ে যাবে। এর জন্য নতুনভাবে শ্রমিক নিয়োগ দিতে হবে। দেখা যাবে এক জাকাতকে কেন্দ্র করে পুরো অর্থ ব্যবস্থায় একটা সুভাব পরিলক্ষিত হবে। অন্য দিকে মানুষ অর্থ অলস ফেলে না রেখে উৎপাদনে লাগাবে। কারণ যখন দেখবে যে, কনো খাতে অর্থ বিনিয়োগ না করে অলস ফেলে রাখা হলে জাকাত দিতে দিতে এক সময় অর্থই শেষ হয়ে যাবে। তখন সে তৎপর হবে কীভাবে মাল বাড়ানো যায়।
পুঁজিকে অলস ফেলে না রেখে বিনিয়োগ করা, দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই উপকারী। এর প্রভাব পড়বে শ্রমবাজারসহ সবখানে। গবেষকদের দাবি হচ্ছে, বাংলাদেশের জাকাতের অর্থের পরিমাণ হচ্ছে, প্রায় ত্রিশ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে শরয়ী বিধান হচ্ছে, উৎপাদিত ফসল যদি বৃষ্টির পানি দ্বারা ফলে তাহলে দশ ভাগের একভাগ আর যদি সেচ দিতে হয় তাহলে বিশ ভাগের একভাগ জাকাত হিসেবে দিতে হবে। আমাদের দেশে ধান, পাট, বিভিন্ন রকমের ডালসহ নানান রবি শস্য উৎপাদন হয়। আমাদের দেশে আম, লিচু, কাঁঠাল, বড়ইসহ বহু ধরনের ফল উৎপাদন হয়। তো জাকাতের এ বিপুল অর্থ ও ফসলের বিশ বা দশ ভাগের এক ভাগ জাকাত আদায় করা হলে গরিবদের অবস্থা আস্তে আস্তে উন্নত হতো।
জাকাত সম্পর্কে বর্ণিত বিভিন্ন হাদীস ও কোরআনের আয়াতও মানুষকে দারিদ্রের অভিশাপ থেকে বের হয়ে আসতে উৎসাহ যোগায়। যেমন এক হাদীসে এসেছে নবী করীম (সা.) বলেন, ‘দাতার হাত, গ্রহীতার হাতের চেয়ে উত্তম।’ যখন কনো ব্যক্তি চিন্তা করবে নবী করীম (সা.) এর বাণী অনুযায়ী কে উত্তম আর কে অনুত্তম? সে বুঝবে যে, দাতা, গ্রহীতার চেয়ে উত্তম। তাহলে আমাকে দাতা হতে হবে, গ্রহীতা হলে চলবে না। এই উৎসাহ ও প্রেরণাই তাকে দারিদ্রতার অভিশাপ থেকে বের করে নিয়ে আসবে।
অন্যদিকে যারা পুঁজি অলস ফেলে রাখে, তারা চিন্তা করবে, পুঁজি বিনিয়োগ না করলে একদিন আমি চলে যাবো গ্রহীতার কাতারে, যা রাসূল (সা.) এর হাদীস অনুযায়ী সমাজের নিচু শ্রেণীদের। তখন এই কারণেও পুঁজিপতি নিজের পুঁজি বিনিয়োগ করে সম্পদ বৃদ্ধির জন্য তৎপর হবে। তাছাড়া কোরআন ও হাদীসে বর্ণিত জাকাত না দেয়ায় দুনিয়া ও আখেরাতের শাস্তির বিষয়গুলোও যুগের পর যুগ মানুষকে গরিবের পাশে দাঁড়াতে উৎসাহ দিয়ে আসছে। এ জন্য ইসলামী ইতিহাসের এমন স্বর্ণ যুগও অতিবাহিত হয়েছে, যখন জাকাতদাতা জাকাতের মাল নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছে, কিন্তু জাকাত নেয়ার মতো কাউকে পায়নি।
আজকের দুনিয়ায় ধনী-গরীবের মাঝে সংঘাত বৈষম্যের কারণে। অন্য কনো কারণে নয়। যার দরুণ বিভিন্ন উগ্র চিন্তার সমাজে বিস্তার ঘটছে। ইসলামের জাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন হলে সেই বৈষম্য কমে আসবে। ধনী-গরিবের মাঝে সুসর্ম্পক কায়েম হবে। অশান্ত এই পৃথিবীতে শান্তির বাতাস বইবে ইনশাআল্লাহ!