নানা ধর্মে রোজা
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০১:০০ পিএম, ২২ মে ২০১৯ বুধবার
মুসলিম বিশ্বে চলছে সিয়াম সাধনার রমজান মাস। রমজান মাসের প্রধান ও প্রথম আমল হলো রোজা। মুসলমানদের রোজার পদ্ধতি ও পরিচিতি বেশ প্রসিদ্ধ।
ইসলাম ধর্ম ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মে রোজার পালন করা হয়। তবে সেগুলোর পদ্ধতি ও পরিচিত অনেকেরই জানা নেই। অপরাপর ধর্মগুলোতে কীভাবে রোজা রাখে আজকে তাই জানবো।
বৌদ্ধ ধর্ম:
দুপুরের খাবারের পর পানাহার নিষিদ্ধ। এমনটাই বৌদ্ধধর্মের রোজা। বৌদ্ধধর্মে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বিনয় নীতি অনুসরণ করে দুপুরের পর আর রাত পর্যন্ত খাবারদাবার গ্রহণ করে না। যদিও এটাকে উপবাস বলা চলে না। তবুও শৃঙ্খলিত আহার বিধি ধ্যান এবং সুস্বাস্থ অর্জনে সাহায্য করে। বৌদ্ধধর্মের রোজা সম্পর্কে জানা যায়- গৌতম বুদ্ধ প্রথম জীবনে অর্থ্যাৎ রাজপুত্র সিদ্ধার্থ দুজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে শিক্ষাগ্রহণ করেন। এসময়ে তিনি খুবই কম খাদ্য গ্রহন করতেন। পরবর্তীতে তার উপদেশ মালায় তিনি কম খাদ্য গ্রহনের কথা উল্লেখ করেন। বৌদ্ধ ধর্মানুসারীদের সপ্তাহের একটি দিনে অষ্টবিধান অনুসরণ করতে বলা হয়েছে যাতে দুপুর থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত উপবাসের বিধান রয়েছে। বজ্রযান অনুসারীরা নুয়াং নে অনুসরণ করে যা তান্ত্রিক অনুশাসন চেনরেজিগের মত।
খ্রিস্টান ধর্ম:
পৃথিবীর বৃহৎ ধর্ম খ্রিস্টান। এমন কোনো রাষ্ট্র নেই যেখানে এই ধর্মের লোক নেই। তবে খ্রিস্টানদের মধ্যে নানা শাখা বিভক্তি আছে। খ্রিস্ট ধর্মের বাইবেলিকার বইয়ের মধ্যে ইসাইয়াহ (৫৮:৬-৭), জাকারিয়াহ (৭:৫-১০), বুক অফ দানিয়েলে উপবাসে কথা বলা হয়েছে। তবে এখানে উপবাসে খাদ্য পানীয় পরিহারের বদলে সৃষ্টিকর্তার আদেশ পূর্ণরুপে প্রতিপালন করতে গরীব এবং দুর্দশাগ্রস্থকে সাহায্যের কথা বলা হয়েছে। বুক অফ দানিয়েলে আংশিক উপবাসের কথা বলা হয়েছে।
খ্রিস্টান ধর্মের ক্যাথলিক চার্চ এবং ইস্টার্ন অর্থোডক্স চল্লিশ দিনের আংশিক উপবাস পালন করে থাকে। ইথিওপিয়ান অর্থোডক্স চার্চ বছরে কয়েকবার সপ্তাহব্যাপী আংশিক উপবাস পালন করে। উক্ত সময়ে তারা গোশত এবং দুগ্ধ আহার থেকে বিরত থাকে। বাইবেলের লেভিক্টাস ২৩:২৭-৩১ এতে বলা হয়েছে, সবার উচিত সপ্তম মাসের নবম দিনের সন্ধ্যা থেকে দশম দিনের সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনোরুপ খাদ্য গ্রহন না করা।
ইহুদি ধর্ম:
ইহুদিদের রোজার বছর ছয়দিন। তাদের রোজা মানে সকল ধরণের খাবার ও পানি গ্রহণ থেকে বিরত থাকা। ইয়াম কিপ্পুর হচ্ছে ইহুদি বর্ষপঞ্জিকার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন সকল পূর্ণবয়স্ক নারী পুরুষ রোজা পালন করে থাকে। এই পবিত্র দিনে তারা উপসনার চেয়ে রোজাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। যদি কেউ উপবাস পালন করে বিছানায় শুয়ে থাকে তবুও সে পূর্ণ ধর্মীয় বিধান পালনের পূণ্য লাভ করবে।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ রোজার দিন তিশা বাব। তার কল্পকথা আছে- আনুমানিক ২৫০০ বছর আগে এই দিনে ব্যবলনিয়া জেরুজালেমের প্রথম পবিত্র মন্দির ধ্বংস করে দেয় এবং প্রায় ২০০০ বছর আগে রোমানরা জেরুজালেমের দ্বিতীয় পবিত্র মন্দির ধ্বংস করে দেয়। তিশা বাব এ ইহুদিরা বিভিন্ন ট্রাজেডিতে পতিত হয়েছে। সেই উপলক্ষ্যে তারা এই দিনটিকে পালন করে। এমনকি দ্বিতীয় যুদ্ধে সংঘটিত হলোকাস্টও এই তিশা বাবের সময়ে সংঘটিত হয়।
বাহাই ধর্ম:
বাহাই খুব অপরিচিত একটি একটি ধর্ম বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের অনুসারিরা নিজেদেরকে মুসলমান বলেই দাবি করে। বাহাই ধর্ম ইরানের বিভিন্ন এলাকে রয়েছে। এছাড়া আমাদের এই অঞ্চলে তথা ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্থানে একেবারেই হাতে গোনা কয়েকটি এলাকা রয়েছে। এই ধর্মেও রোজার বিধান রয়েছে। তাদের ধর্মগ্রন্থ- আকদাসে বাহাই এতে উল্লেখ আছে ২ মার্চ থেকে ২০ মার্চ মোট ১৯ দিন রোজা রাখা জরুরি। বাহাই রোজার নিয়ম হলো সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোনোরুপ পানাহার এমনকি ধূমপান পর্যন্ত নিষিদ্ধ। ১৫ থেকে ৭০ বয়সী সকল বাহাইকে এই রোজা বা উপবাস পালন করতে হবে। অসুস্থ, গর্ভবতী, ঋতুবতী, পর্যটক, কঠোর পরিশ্রমকারীদের জন্য রোজার বিধান শিথিল করা হয়েছে। তবে যারা কঠোর পরিশ্রম করেন তাদেরকে নির্জনে স্বাভাবিকের তুলনায় কম আহার করতে বলা হয়েছে।
হিন্দুধর্ম:
হিন্দুধর্মে রোজা; ধর্মের একটি আনুষাঙ্গিক অংশ। হিন্দু ধর্মের রোজার মধ্যে ব্যক্তিগত ও আঞ্চলিকতার প্রভাব রয়েছে। অঞ্চলভেদে তাদের রোজার পদ্ধতিও ভিন্ন হয়। যেমন- ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে কার্তিক মাসের শুরুর দিনে অনেক হিন্দু বিশেষ করে রমণীরা উপবাস পালন করে থাকে। এ মাসের সোমবার তারা শিবের জন্য, পূর্ণ চন্দ্রের দিন কার্তিকের জন্য উপবাস পালন করে থাকে।
মঙ্গলবারে দক্ষিণ ভারত এবং উত্তর পশ্চিম ভারতে উপবাস পালন করা হয়। দক্ষিণের হিন্দু জনগোষ্ঠী বিশ্বাস করে মঙ্গলবার শক্তির দেবী মারিয়াম্মানের জন্য উৎসর্গ করা হয়েছে।
উত্তর ভারতে মঙ্গলবার দেবতা হনুমানের জন্য নির্দিষ্ট। এই রোজার পদ্ধতি মুসমানদের মতো সেহরির টাইমে খাওয়া আর সূর্যাস্তের সময় রোজা ভঙ্গ করা। তবে মজার বিষয় হলো তাদের রোজায় খাওয়া যায়। উপবাসকালীন সময়ে তারা পানীয় জল পান করে থাকে। উপবাসকারীরা এইদিনে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তকালীন সময় পর্যন্ত শুধুমাত্র দুধ এবং ফল খেয়ে থাকেন।
উত্তর ভারতের হিন্দুরা বৃহস্পতিবার উপবাস পালন করে থাকে। উপবাসকারী একটি গল্প বা শ্রুতি শ্রবণের মাধ্যমে উপবাস শুরু করে। বৃহস্পতিবারের উপবাসকারীরা বৃহস্পতি মহাদেবের পূজা করে। তারা হলুদ কাপড় পরে এবং হলুদ রঙের খাবার খেতে পছন্দ করে। এদিন মহিলারা কলা গাছের পূজা করে এবং জল ঢালে। হলুদাভ বর্ণের ঘি দিয়ে খাবার প্রস্তুত করা হয়।
অনেক হিন্দু মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিন যেমন একাদশী, প্রদোষ অথবা পূর্ণিমাতে উপবাস পালন করেন।
সপ্তাহের কয়েকটি দিন নির্দিষ্ট দেবতার জন্য উপবাস পালন করার বিধান আছে অনেক অঞ্চলে। যেমন সোমবার শিবের জন্য, বৃহস্পতিবার বিষ্ণুর জন্য এবং শনিবার আয়াপ্পার জন্য উপবাস পালন করা হয়।
বৃহস্পতিবার গুরুর জন্য উৎসর্গ করা হয়। যে সকল হিন্দুরা গুরু মন্ত্র গ্রহণ করে তাদের অনেকেই বৃহস্পতিবার উপবাস পালন করে থাকে।
ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষ্যেও উপবাস পালন করা হয়। যেমন মহাশিব রাত্রীতে অধিকাংশ হিন্দু উপবাস পালন করে এবং তারা একবিন্দু পানিও পান করে না। নভরাত্রিতে উপবাস পালন করে।
ভারতের অনেক অঞ্চলের বিবাহিত হিন্দু রমনীরা স্বামীর সুস্বাস্থ্য, আয় উন্নতি, দীর্ঘায়ূ কামনা করে উপবাস পালন করে থাকে। একটি ঝালরের মাধ্যমে চাঁদ দেখার মধ্য দিয়ে তারা এই উপবাস ভঙ্গ করে। শ্রাবণ মাসে অনেকে শ্রাবন উদযাপন করে। এই সময়ে অনেকেই সপ্তাহের একটি দিন তারা তাদের পছন্দের দেবতার জন্য উপবাস করে। আবার অনেকেই পুরো শ্রাবণ মাস উপবাস পালন করেন।
হিন্দুদের বিভিন্ন শাখায় রোজা নিষিদ্ধ যেমন শ্রীবিদ্যা। শ্রীবিদ্যায় উপবাস করতে নিষেধ করা হয়েছে। এই তান্ত্রিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে দেবী মানুষের মধ্যে বাস করেন। তাই কেউ যদি ক্ষুধার্ত থাকে তবে দেবীও ক্ষুধার্ত থাকে। শ্রীবিদ্যায় শুধু মাত্র পিতা-মাতার মৃত্যু বার্ষিকীতে উপবাসে কথা বলা হয়েছে।
মহাভারতের অনুশাসন পর্বে একাধিকবার উপবাসের কথা বলা হয়েছে। ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দিয়ে বলেন, ‘উচ্চজ্ঞানের উপবাস প্রথা পালন করো যার কথা সবাই জানে না।’
জৈন ধর্ম:
জৈনধর্মেও ধর্মীয় অনুশাসনে রোজার কথা আছে। জৈনধর্মেও রোজার বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। এর একটি হচ্ছে চৌবিহার উপবাস যাতে পরবর্তী দিনের সূর্যোদয় পর্যন্ত কোনো প্রকার খাবার বা পানি গ্রহণ করা যায় না। আরেকটি উপবাস ব্রত হচ্ছে ত্রিবিহার উপবাস যেখানে কোনো খাবার খাওয়া যায় না কিন্তু ফুটানো পানি পান করা যায়।
জৈন ধর্মমতে রোজার দীর্ঘসূত্রতার ওপন নির্ভর করে নামকরণও করা হয়। কোনো ব্যক্তি যদি পাজ্জ্যশনে আটদিন উপবাস পালন করে তবে তাকে বলা হলো আত্থাই এবং দশদিন উপবাস করলে বলা হয় দশ লক্ষণ। আর মাসব্যাপী উপবাস পালন করলে বলা হয় মশখমন। তবে জৈনদের মধ্যে উপবাস পালন না করে খুবই কম খাবার আহার করার রীতি অতি সাধারণ দৃশ্য। যে সকল ব্যক্তিরা মসুরের ডাল এবং স্বাদহীন খাবার শুধুমাত্র লবন ও মরিচ দিয়ে খেয়ে থাকেন তাদের বলা হয় আয়ামবলি। জৈনরা দিনে একবার মাত্র খাবার গ্রহন করে একাসসন নামে উপবাস পালন করে। দিনে দুই বার খাবার খেয়ে বিয়াসন উপবাস পালন করে।
শিখ ধর্ম:
সকল ধর্মে রোজা থাকলেও শিখধর্মে রোজার প্রথাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। গুরু গ্রন্থ সাহিবে বলা হয়েছে উপবাস কোনো আত্মিক সুবিধা বয়ে আনে না। তাই শরীরকে কষ্ট দিয়ে কোনো লাভ নেই। তবে শুধু মাত্র স্বাস্থ্যজনিত কারণে উপবাস করার অনুমোদন দেয়া হয়েছে।