ফসলের জাকাত: অবহেলিত একটি ফরজ বিধান
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০১:৪০ পিএম, ২৫ মে ২০১৯ শনিবার
ইসলামে জাকাতের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য অপরিসীম। কোরআনে কারীমের অসংখ্য আয়াত ও হাদীস শরীফের যেখানে নামাজের কথা বলা হয়েছে সেখানে জাকাতের কথাও সম গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে।
নামাজ কায়েম করা ব্যতীত যেমন কামিল মুমিন হওয়া সম্ভব নয়, তেমনি জাকাত প্রদান ব্যতীতও সফল মুমিন হওয়া অসম্ভব।
আল্লাহ তায়ালা সফল মুমিনের পরিচয় দিতে গিয়ে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় সফলকাম হয়েছে সেই মুমিনগণ যারা নিজেদের নামাজে বিনয়াবনত। যারা অনর্থক কথা-বার্তায় নির্লিপ্ত। যারা জাকাত আদায়ে সক্রিয়।’ (সূরা মুমিনূন: ১-৪) সহীহ বুখারীতে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি বিষয়ের ওপর আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই ও মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল মর্মে সাক্ষ্য দেয়া, নামাজ কায়েম করা, জাকাত প্রদান করা, হজ পালন করা ও রমজানের রোজা রাখা।’ (বুখারী: খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৬)
জাকাতযোগ্য সম্পদের শ্রেণীবিভাগ:
পবিত্র কোরআন ও হাদীসের নির্দেশনা অনুসারে আমরা দেখতে পাই যে, মোট পাঁচ প্রকার সম্পদের জাকাত প্রদান করতে হয়। (এক) স্বর্ণ-রৌপ্য ও নগদ টাকা পয়সা, (দুই) ব্যবসায়িক পণ্য, (তিন) পালিত পশু, (চার) ফল-ফসল এবং (পাঁচ) খনিজ সম্পদ ও মাটির নিচের গুপ্তধন। আমরা এখানে উপরোক্ত পাঁচ প্রকার হতে আমাদের দেশে সর্বাধিক উপেক্ষিত ও অবহেলিত; অথচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জাকাত সংগ্রহের একটি বৃহৎ উৎস ফল-ফসলের জাকাত নিয়ে আলোচনা করব।
ফসলের জাকাত:
বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলিম ধর্মপ্রাণ। ধর্মীয় বিধি-বিধান পুরোপুরি পালন না করতে পারলেও সকল বিধানের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অটল। কিন্তু ফসলের জাকাত প্রদানের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যার ফরজ হওয়ার বিষয়টি কোরআন হাদীসের সুস্পষ্ট আয়াত ও হাদীস দ্বারা সুপ্রমাণিত, তা আমাদের দেশের ধার্মিক মুসলমানগনও পালন করেন না। ভাবতে অবাক লাগে। যে মুসলিম পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রমজানের রোজা, হজ ও স্বর্ণ-রৌপ্যের জাকাত প্রদানসহ বিভিন্ন সুন্নত, নফল, জিকির-আযকার ও দান-সদকা করতে রীতিমত অভ্যস্ত তিনিও ফসলের জাকাত আদায় করেন না। বলতে গেলে বাংলাদেশের মুসলিমদের ফসলের জাকাতের ব্যাপারে ধারনাই নেই।
প্রশ্ন হলো, কেন এই অবাধ্যতা? কেন এই অবহেলা? এ প্রশ্নের জবাবে অনেক আলেম বলে থাকেন, ‘বাংলাদেশের খারাজী জমিতে উশর প্রদান জরুরি নয়।’ ‘খারাজী জমিতে উশর প্রদান জরুরি নয়’ কথাটি ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর মত, তা ঠিক। কিন্তু আমরা কী কখনো ভেবে দেখেছি যে, বাংলাদেশের জমি উশরী না খারাজী? খারাজী হলে আমরা কী খারাজ আদায় করছি? নাকি শুধু অনুমানের ঢিল ছুঁড়ছি? তাই এ পর্যায়ে আমরা যাচাই করব, বাংলাদেশের জমি কোন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত?
উশরী ও খারাজী জমির পরিচয়:
ইসলামী পরিভাষায় যে সকল জমির মালিক স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছে অথবা বলপ্রয়োগ করে যেসব এলাকা বিজিত হয়েছে এবং মুসলিম বাহিনীর মাঝে তা বন্টন করে দেয়া হয়েছে সেগুলোকে উশরী জমি বলে। পক্ষান্তরে যেসব এলাকা বলপ্রয়োগ অথবা সন্ধির মাধ্যমে বিজিত হয়েছে এবং ওই এলাকার ভূমিগুলোকে খারাজ প্রদানের শর্তে অমুসলিম মালিকদের হাতেই ন্যস্ত করা হয়েছে সেগুলোকে খারাজী জমি বলে।
বাংলাদেশের জমি উশরী না খারাজী?
বাংলাদেশের জমি উশরী না খারাজী তা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আমরা তিনটি পন্থার যে কোনো একটি অনুসরণ করতে পারি।
(এক) বৃটিশ ভারতকে দারুল হারব গণ্য করে স্বাধীনতা থেকে ভূমি বিন্যাস করা। এক্ষেত্রে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময় যে ভূমি-সম্পদ নাগরিকদের অধিকারভূক্ত ছিল, রাষ্ট্রীয় অধিকারভূক্ত ছিল ও পরিত্যাক্ত হয়েছিল তা সবই উশরী জমি বলে গণ্য হবে। এভাবে বাংলাদেশের প্রায় সকল ভূমি-সম্পদ বা ৯৫% ভূমি উশরী বলে গণ্য হবে।
(দুই) বৃটিশ ভারতকে দারুল ইসলাম গণ্য করে ভূমি-বিন্যাস। আমরা যদি বাংলাদেশের ভূমির প্রকৃতি নির্ণয়ে বৃটিশপূর্ব মূল মুসলিম বিজয়ের ওপর নির্ভর করি, তাহলে দেখতে পাব বাংলাদেশের প্রায় ৭০% ভূমি উশরী। বাকী আনুমানিক ৩০% ভূমি খারাজী।
(তিন) খারাজ ব্যবস্থার বিলুপ্তির ভিত্তিতে ভূমি-বিন্যাস। প্রখ্যাত হানাফী ফকীহ আল্লামা ইবনু আবেদীন শামী সহ অন্যান্য বিশিষ্ট হানাফী ফকীহগণ প্রায় দু শত বৎসর পূর্বেই উল্লেখ করেছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে খারাজ ব্যবস্থার বিলোপ ঘটেছিল। ভারতীয় অধিকাংশ হানাফী ফকীহগণও এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তাঁদের মতে, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় খারাজী ও উশরী ভূমি বলে কোনো শ্রেণীবিভাগ নেই। আর যে জমি উশরীও নয়, খারাজীও নয় সে জমির উৎপাদনে উশর দেয়া ফরজ। সুতরাং ভারত ও বাংলাদেশের সকল মুসলিম নাগরিকদের ওপর উশর প্রদান করা ফরজ। (বাংলাদেশে উশর বা ফসলের জাকাত: ১৬৩-১৬৫)
উশর বা ফসলের জাকাতের পরিমাণ:
মুসলিম উম্মাহর সকল ইমাম ও আলেমদের সর্বসম্মত মত হচ্ছে, অতিরিক্ত সেচ ব্যবস্থা ছাড়া মাটির স্বাভাবিক আদ্রতা, বৃষ্টি, ঝর্ণা বা নদীর প্রবাহমান পানির মাধ্যমে উৎপাদিত ফসলের উশর (এক দশমাংশ বা ১০%) জাকাত প্রদান করতে হবে। আর যদি মানবীয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে অথবা যন্ত্র বা জীবজন্তুর মাধ্যমে সেচের পানি সরবরাহ করা হয় তাহলে উৎপাদিত ফসলের নিসফু উশর ( এক দশমাংশের অর্ধেক বা ৫%) প্রদান করতে হবে।
কতটুকু পরিমাণ ফসলে জাকাত আসবে?
ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর মতে, জমিতে কমবেশি যাই উৎপাদিত হবে তার উশর বা নিসফু উশর জাকাত প্রদান করতে হবে। পক্ষান্তরে ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) এর মতানুসারে পাঁচ ওয়াসাকের (১৭মণ মতান্তরে ২৫মণ) কম ফসলে যাকাত ফরজ হবে না। তবে পরবর্তী হানাফী ফকীহগণ ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর মতকেই গ্রহণ করেছেন।
জাকাত প্রদানে অবহেলার পরিণতি:
জাকাত প্রদানে অবহেলার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘যে সম্পদে ওরা (জাকাত প্রদানে) কৃপণতা করেছিল কিয়ামতের দিন তা বেড়ি বানিয়ে ওদের (গলায়) পরানো হবে।’ (সূরা আলে ইমরান: ১৮০) বুখারীতে এসেছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘জাকাত অনাদায়কারীর সম্পদকে কেয়ামত দিবসে দু’চোখে কালো চিত্র বিশিষ্ঠ অজগরের রুপে তার গলায় পরিয়ে দেয়া হবে, যা তাকে দংশন করতে থাকবে।’ (বুখারী: খন্ড-১, পৃষ্ঠা-১৮৮) মুসলিমের এক বর্ণনায় এসেছে, ‘জাকাত অনাদায়কারীর স্বর্ণ-রৌপ্যকে জাহান্নামের আগুনে তপ্ত করে তার পার্শ্ব, ললাট ও পৃষ্ঠে দাগ দেয়া হবে।’ (মুসলিম: খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৩১৮)
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সুমতি দান করুন। টাকা-পয়সা ও স্বর্ণ-রৌপ্যের জাকাতের ন্যায় ফল-ফসলের জাকাতও পূর্ণ সতর্কতার সঙ্গে আদায় করার তাওফিক দান করুন।