ঈদকে ঘিরে জামদানি পল্লীতে কারিগরদের ব্যস্ততা
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ১০:১৭ এএম, ৩১ মে ২০১৯ শুক্রবার
কথায় বলে শাড়িতেই নারীকে মানায় ভাল। আর জামদানির শাড়িতো প্রতিটি নারীরই কাঙ্খিত। তাই ঈদকে সামনে রেখে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার তারাব পৌরসভা নোয়াপাড়া পল্লীতে জামদানি তাঁতীদের কর্মব্যস্ততা বেড়ে গেছে। বিশ্ব দরবারে স্বতন্ত্র মহিমায় সমুজ্জল অভিজাত তাঁতবস্ত্র এ জামদানি। এ শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে এ দেশের সংস্কৃতি ও কৃষ্টি।
বিশ্ব বিশ্রুত অনন্য মসলিন শাড়ির সংস্করণ অধুনা জামদানি শাড়ি। নারীর সৌন্দর্য সুধাকে বিমোহিত করে তুলতে জামদানির অপরিহার্যতা বিশেষ স্মরণীয়। বছরজুড়েই চাহিদা থাকলেও ঈদকে সামনে রেখে জামদানি পল্লীতে চলছে কর্মব্যস্ততা। নাওয়া-খাওয়া ভুলে জামদানি শিল্পীরা এখন কাপড় বুনে যাচ্ছে। এবারের ঈদে তাদের চাহিদা অনেক। এবারের ঈদে প্রায় ৩৫ কোটি টাকার জামদানি দেশের বিভিন্ন বিপণি বিতান ও বিদেশ যাবে বলে জামদানি তাঁতীরা জানান।
ত্রিশ বছর ধরে জামদানির কাজ করা রূপগঞ্জের দক্ষিণ রূপসী এলাকার মো. নাসির উদ্দিন বলেন, জামদানির তৈরির প্রথমে লুম তৈরি করতে হয়। লুম তৈরির জন্য হাত ও পায়ের ব্যবহার করা যন্ত্র রয়েছে। রেশমি গুটি থেকে প্রস্তুত সূতা মূল শাড়ি প্রস্তুতের জন্য তাতে সাজানো হয়।
রঙ করা সুতা বোনার জন্য প্রস্তুত করতে হয়। সুতাকে শক্ত করে কয়েক ধাপের ভাতের মাড় দিয়ে শুকানো হয়। রোদে শুকানো তাতে নেয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয়। সাধারণ হাত তাতে মূল শাড়ি রেখে তাতে রঙিন সুতা দিয়ে নকশা করা হয়। নকশা করার পর আরো একবার ভাতের মাড় দেয়া হয়। তারপর শাড়িতে নকশা তোলা হয়। রকমারি রঙের সুতা আর নকশায় শাড়ি সাজানো হয়।
পনের বছর ধরে জামদানির কাজ করা রূপগঞ্জ গন্ধবপুর মোসা.মাজেদা জানান, অনেক রকম জামদানি বোনা হয়। এর মধ্যে ফুলতেরছি, ছিটার তেরছি, ছিটার জাল, সুই জাল, হাটু ভাঙা, তেরছি, ডালম তেরছি, পাটিব্রজাল, পান তেরছি, গোলাপ ফুল, জুঁই ফুল, পোনা ফুল, শাপলা ফুল, গুটি ফুল, মদন পাইরসহ প্রায় শতাধিক নামের জামদানি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ছিটার জাল, সুই জাল ও পার্টিও জাল জামদানির মূল্যে সবচেয়ে বেশি। এসব জামদানি শাড়ির দাম পড়ে ৩০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত। আর শাড়ি বুনতে সময় লাগে প্রায় এক সপ্তাহ থেকে শুরু করে ৬ মাস পর্যন্ত।
জামদানির কারিগর আড়াইহাজার উপজেলার রামচন্দ্রি মানিকপুর এলাকার মো.রুবেল বলেন, জামদানির চাহিদা সারা বছর জুড়েই থাকে। শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারত পাকিস্তানসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই জামদানির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ঈদে নারীদের শাড়ি না হলে চলেই না। আর তা যদি হয় জামদানি তাহলেতো কথাই নেই। কারিগর কমে যাওয়ায় দম ফেলার ফুসরত নেই।
ত্রিশ বছর ধরে জামদানির কাজ করা রূপগঞ্জের নোয়াপাড়া এলাকার মো. মোস্তফা জানান, জামদানি শাড়ি বিক্রিকে ঘিরে শীতলক্ষ্যার পাশে ডেমরায় ও নোয়াপাড়া জামদানি পল্লীতে গড়ে উঠেছে জামদানির আড়ৎ। এ আড়ৎ প্রতি বৃহস্পতিবার প্রথম এবং শেষ রাতে জামদানির হাট বসে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসেন জামদানি শাড়ি কিনতে। প্রায় দুই শতাধিক পাইকার বিভিন্ন প্রকার জামদানি ক্রয় করে দেশ-বিদেশে বিক্রি করে আসছে। দুটি হাটে প্রতি মাসে প্রায় ২০ কোটি টাকার জামদানি শাড়ি বেচা-কেনা হয়। ঈদকে ঘিরে এবার প্রায় ৩৫ কোটি টাকার চেয়েও বেশি জামদানি বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে।
ফাহিম জামদানি হাউজের মালিক ফাহিম মিয়া বলেন, জামদানি এমনভাবে তৈরি হয় যাতে শীত-গ্রীষ্ম সব সময়ই পরা যায়। তাই সারা বছরই বিক্রয় হয় ভালই। আমরা পাইকারি খুচরা উভয়ই বিক্রি করি। তবে বিভিন্ন উৎসবে জামদানির চাহিদা আরো বেড়ে যায়। ঈদের আগে থেকেই জামদানির অর্ডার করা থাকে।
ভালো জামদানি তৈরিতে সময় লাগে। তাই চাইলেই ভালো জামদানি তৎনগদ তৈরি করে দেয়া যায়না। ঈদকে সামনে রেখে জামদানি কেনার আগ্রহ সবার। ভালো জামদানি কিনতে দাম একটু বেশি পড়বেই।
উপজেলার খামার পাড়া এলাকার গৃহিণী মনি ইসলাম। তিনি বলেন, ঈদেও পোশাকতো অনেকই পাওয়া যায়। তবু ঈদে একটা জামদানি শাড়ি না হলে চলে না। আর বাঙালি নারীর সৌন্দর্য তো শাড়িতেই। তাই প্রতি ঈদে একটা জামদানি শাড়ি চাই-ই।
শখ বুঝি এমনই। নতুবা আজ থেকে ২০০বছর আগে জেমস টেলর কেন রাজধানী ছেড়ে ছুটে আসবেন প্রাচীন নগরী রূপগঞ্জে। হাতির পিঠে চড়ে বৈশাখের উত্তপ্ত মধ্যাহ্ন সূর্যকে মাথায় করে জেমস টেলরকে কোন মায়াবী টেনে এনেছিল রূপগঞ্জ।
বাদশাই আমলে পরতেন রাজা-বাদশাহরা কিংবা জমিদার পরিবারের নারীরা। আর এখন পরেন ধনী ও অভিজাত রমণীরা। অনেকেই জানেন না নারীদের পরিধেয় জামদানি শাড়ির ভাঁজে-ভাঁজে রয়েছে কত দুঃখ, বেদনা আর বঞ্চনার ইতিহাস।
ইংরেজ আমলে আঙুল কেটে দেয়া থেকে শুরু হাল আমলে লুন্ঠনের পরও ঢাকাই এ জামদানি শিল্প বহু কষ্টে টিকে আছে। এক একটা শাড়ির পেছনে লুকিয়ে রয়েছে এক একজন তাঁতীর জীবন্ত ইতিহাস।
ত্রিশ বছর জামদানির কাজ করার অভিজ্ঞতা কারিগর দক্ষিণ রূপসী এলাকার মোসা.রেহানা। তিনি বলেন, আমরা যে খাটুনি করে জামদানি তৈরি করি সেই তুলনায় সঠিক মূল্যটা আমাদের কাছে ঠিকভাবে পৌছায়না। ঈদের অনেক আগেই পাইকাররা বাড়ি বাড়ি ঘুরে জামদানি শাড়ি সংগ্রহ করে।
বারোমাস অভাব থাকায় কমদামেই ছাড়তে হয় জামদানি। আমরা সবসময়ই অভাবে থাকি। তাই অনেক কারিগর কমে গেছে। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা ও কারিগররা সহায়তা পেলে জামদানি তৈরিতে কারিগররা উৎসাহ পেত।