মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১   ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

একই মাসে দুই নবীর জন্মদিন নিয়ে কিছু কথা

নিউজ ডেস্ক

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৫:৪৫ এএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ বুধবার

আজকাল হিজরি মাস রবিউল আউয়াল ও ঈসায়ি মাস ডিসেম্বর প্রায় একইসঙ্গে অতিবাহিত হয়। কিছু কারণে এ দুই মাস যথাক্রমে মুসলমান ও খ্রিস্টান উভয় জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সিরাত লেখকদের প্রায় ঐকমত্য সিদ্ধান্ত হলো, আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই রবিউল আউয়াল মাসে জন্গ্রহণ করে জগতটাকে আলোকিত করেছিলেন। এই মাসে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর ওপর ওহি অবতরণের সূচনা হয়েছিল। সর্বশেষ তিনি এই মাসে আপন মাওলার সান্নিধ্যে পাড়ি জমান। অন্যদিকে খ্রিস্টান ঐতিহাসিকদের অনুমান নির্ভর মন্তব্য হলো, হজরত ঈসা আলাইহিস সালাম এই ডিসেম্বর মাসে দুনিয়ায় শুভাগমন করেছিলেন।

এবার পরবর্তী আলোচনায় যাওয়ার আগে বলে রাখি যে বিশেষ কোনো সময়, বিশেষ কোনো ঘটনা বা বিশেষ কারো কোনো কিছু স্মরণীয় করে রাখার ক্ষেত্রে ইসলামের পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম কর্তৃক স্বীয় ছেলে হজরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে জবাই করার ঘটনাকে ইসলাম ধর্মে স্মরণীয় করে রাখা হয়েছে পশু কোরবানির বিধানের মাধ্যমে। হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম কর্তৃক কাবা ঘরের পুনঃনির্মাণ, শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ ইত্যাকার বিষয়গুলো স্মরণীয় রাখা হয়েছে হজের বিভিন্ন হুকুমের মাধ্যমে। শিশু ইসমাঈলের জন্য পানির অনুসন্ধানে সাফা ও মারওয়ার মধ্যে বিবি হাজেরার দৌঁড়ানোকে স্মরণীয় করে রাখা হয়েছে সাফা ও মারওয়ার মধ্যে 'সাঈ' করার বিধানের মাধ্যমে। হজরত মুসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর জাতি সাগর পাড়ি দিয়ে অভিশপ্ত ফেরাউন থেকে মুক্তি পাওয়ার দিনকে স্মরণীয় রাখা হয়েছে ওই দিন রোজা রাখার মাধ্যমে। তবে এ ক্ষেত্রেও যেন মুসলমানরা বিজাতীয় সংস্কৃতি অনুসরণের ধাঁধায় না পড়ে, সেজন্য আশুরা বা মহররম মাসের ১০ তারিখের সঙ্গে ৯ কিংবা ১১ তারিখেও রোজা রাখার কথা বলা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, 'তোমরা আশুরা দিবসে রোজা রাখো। তবে ইহুদিদের বিরুদ্ধাচরণ করে এর আগের দিন অথবা পরের দিনও রোজা রাখবে।' (মুসনাদে আহমাদ : ১/৬৩৯, হাদিস, হাদিস : ২১৫৪)

যা-ইহোক, এসব দৃষ্টান্ত থেকে প্রতিভাত হয়, ইসলাম বিশেষ কাউকে অথবা বিশেষ কোনো মুহূর্ত স্মরণ করার জন্যে নিছক আনুষ্ঠানিকতা পছন্দ করে না। বরং বিশিষ্ট ব্যক্তি কিংবা বিশেষ ওই সময় থেকে শিক্ষার উপকরণ সংগ্রহের মাধ্যমে তা স্মরণ করার পথ দেখিয়েছে। যাতে এর আলোকে মানুষ নিজ প্রতিপালকের আরো বেশি নৈকট্য লাভ করতে পারে, নিজের ভেতরে থাকা শয়তানি প্রবৃত্তি ধ্বংস করতে পারে। নতুবা স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা, আমোদ-প্রমোদ ও ফুর্তি-আড্ডা স্মরণীয় ব্যক্তি বা ঘটনার শিক্ষা থেকেই শুধু দূর করবে না, বরং নিজেকে আরো অন্ধকারে ঠেলে দিবে।

এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষ করার মতো, ইসলামে খুশি ও আনন্দের জন্য যে দুই ঈদ মুসলমানদের প্রদান করা হয়েছে, তাও নিছক আনন্দের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের ব্যবস্থাস্বরূপ প্রত্যেক ঈদে দুই রাকআত বিশেষ নামাজের বিধান রয়েছে।

ইসলামি শরিয়তের এই পবিত্র দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নিজের জন্মদিন ও আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওহি প্রাপ্তির সূচনাদিন_এই মোবারক দুই দিনের স্মরণে ও শুকরিয়াস্বরূপ প্রতি সোমবার রোজা রাখতেন। হজরত আবু কাতাদা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সোমবার রোজা রাখার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়। জবাবে তিনি বলেন, 'ওই দিন আমি জন্মগ্রহণ করেছিলাম এবং ওই দিন আমার ওপর সর্বপ্রথম ওহি অবতীর্ণ হয়েছিল।' (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১২৬)

উল্লিখিত বর্ণনার আলোকে জানা যায়, মহানবী (সা.)-এর জন্ম সোমবার হয়েছিল। কিন্তু রবিউল আউয়ালের কয় তারিখ? তা অনিশ্চিত। সহিহ বুখারির ব্যাখ্যাতা আল্লামা কুতবুদ্দিন কাসতালানি (রহ.) বলেন, অধিকাংশ হাদিসবিদের মতে মহানবী (সা.)-এর জন্ম তারিখ আট রবিউল আউয়াল। (আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া : ১/১৪০) আরো অনেকে বহু মন্তব্য করেছেন। অবশ্য ১২ তারিখের মতটা অত্যধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। পক্ষান্তরে একই মাসের ১২ তারিখ যে মহানবী (সা.) ইন্তিকাল করেছেন, এ বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই।

এই গুরুত্বপূর্ণ মাসে মহানবী (সা.)-এর স্নেহ ও সাহচর্যধন্য সাহাবায়ে কেরাম জন্মদিবস কিংবা মৃত্যদিবস উপলক্ষ পালন করতেন না। তা ছাড়া মহানবী (সা.) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্নভাবে উম্মতকে বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুসরণ থেকে বারণ করেছেন। বিশেষ করে খ্রিস্টানরা হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের ভালোবাসা প্রকাশে বাড়াবাড়ি করেছে, প্রিয় নবী তাঁর উম্মতকে এ বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, 'তোমরা আমাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি কোরো না, যেমন খ্রিস্টানরা ঈসা ইবনে মারিয়ামকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে।' (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৪৪৫)

তাহলে এবার দেখুন, খ্রিস্টানরা তাদের নবীর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনে যত বাড়াবাড়ি করেছে তন্মধ্যে একটা হলো ক্রিসমাস ডে। এ দিন তারা হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মদিবস পালন করে। এই প্রথা কিন্তু হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের যুগে ছিল না। তাঁর সাহাবিগণের যুগে ছিল না। এরপরও ছিল না। এটি আবিষ্কৃত হয়েছে কয়েক শতাব্দী পর,  চতুর্থ শতাব্দী খ্রিস্টাব্দে। (দি এ্যলমানাক ফর প্যাসটোরাল লিটারজি, পৃ. ২৯, উইকিপিডিয়া)

যখন এই ক্রিসমাস ডে পালন করা শুরু হয়েছিল, তখন শুধু নিয়ম এই ছিল যে গির্জায় পাদ্রীরা হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম ও জীবনী সম্পর্কে আলোচনা করতেন। পরে দেখা গেল, এতে জনসাধারণের তেমন আগ্রহ নেই। ফলে এর সঙ্গে মিউজিক যুক্ত করা হলো। তারপর এটাকে আরো উপভোগ্য করে গড়ে তুলার স্বার্থে এতে নারীদের ড্যান্স সংযুক্ত করা হলো। এভাবে ধীরে ধীরে এটা নিছক একটা আনন্দ-উন্মাদনার দিনে রূপান্তরিত হয়। নবী ঈসা আলাইহিস সালামের জীবনালোচনার স্থলে নাচ-গান, মদ-জুয়া, অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা ইত্যাদির বাজার গরম হয়। ফলে নবআবিষ্কৃত এই কাজেরও যে মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল, তা ব্যাহত হয়।

সুতরাং উৎসব পালন ও আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে রবিউল আউয়াল বরণ শুধু যে অনর্থক তা-ই নয়, এটি আমাদের নবীর সুন্নাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ারও কারণ। 

পরিশেষে বলতে চাই, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সিরাত তথা তাঁর শিক্ষা ও আদর্শের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও ভালোবাসা, বাস্তব জীবনে তাঁর অনুসরণ ও অনুশীলনের মাধ্যমেই আলোর সন্ধান পাওয়া সম্ভব। আল্লাহ তাআলা আমাদের সঠিকভাবে উপলব্ধি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : আলোচক, ইকরা টিভি, লন্ডন