বিয়েবাড়ির খাবারের একাল-সেকাল
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ১১:০৬ এএম, ১১ জুন ২০১৯ মঙ্গলবার
ভোজনরসিকদের কাছে বিয়ে মানেই খাবারের নানা পদ ও ভরপেট আয়োজন। যত পারো, তত খাও—নেই কোনো মানা। তাইতো অনেকেই দেশীয় বিয়ের নিমন্ত্রণ পায়ে ঠেলেন না। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য-এর এই পদ্যটি মনে আছে? ‘আসুন-বসুন সবাই, আজকে হলাম ধন্য, যৎসামান্য এই আয়োজন আপনাদেরই জন্য।/মাংস, পোলাও, চপ-কাটলেট, লুচি এবং মিষ্টি।/খাবার সময় এদের প্রতি দেবেন একটু দৃষ্টি’।
বাঙালি চিরকালই জীবনরসিক, সেই সঙ্গে ভোজনরসিকও। বাঙালির বিয়ে হোক বা বউভাত, কব্জি ডুবিয়ে উদরপূর্তি করা এ এক বড় পুরনো প্রথা। আজকের আলোচনা বিয়ে বাড়ির হাঁড়ি নিয়েই। বাঙালির বিয়েতে সেকালে খাবার পাতে কী থাকতো এবং আজকাল কী থাকে, সেটা জানবো এই আয়োজনে।
বর্তমান সময়ে বিয়ের খাবারের মেনুতে সাধারণত পোলাও, বিরিয়ানি, মুরগির রোস্ট, কোরমা, কাবাব, রেজালা, বোরহানি থাকে। মূল খাবারের শেষে মিষ্টান্ন হিসেবে দই, পায়েস, জর্দা, মিষ্টি পরিবেশন করা হয়। কোথাও কোথাও খাওয়া শেষে পানের আয়োজন থাকে। আবার বরযাত্রীদের আগমণের সময় নানা ধরণের পিঠা ও মিষ্টিমুখ করিয়ে বরণ করে নেয়া হয়। তবে একসময় এই আয়োজনে খানিকটা ভিন্ন ছিল।
লেখক শরৎকুমারী চৌধুরানী সেকালের বিয়ে বাড়ির খাবার নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছেন। সেখান থেকে জানা যায়, পোলাও, কালিয়া, চিংড়ির মালাইকারি, মাছ দিয়া ছোলার ডাল, রুইয়ের মুড়া দিয়ে মুগের ডাল, আলুর দম ও ছক্কা সেকালের বিয়েতে খুবই পরিচিত পদ ছিল। কেউ কেউ মাছের চপ, চিংড়ির কাটলেট। ইলিশ ভাজা, বেগুনভাজা, শাকভাজা, পটলভাজা, দই, মাছ, চাটনি, লুচি, কচুরি ও পাঁপড়ভাজার আয়োজন করতো। মিষ্টান্নের একখানি সরায় আম, কামরাঙা, তালশাঁস ও বরফি সন্দেশ। ক্ষীর, দই, রাবড়ি ও ছানার পায়েস রাখা হতো বনেদি পরিবারগুলোতে।
বিরিয়ানি
এখনকার বিয়েতে বেশ কিছু দৃশ্য হারহামেশা চোখে পড়ে। অনেকের মতে, এসব না থাকলে ঠিক বিয়ে বাড়ি মনে হয় না! গলির মুখে লাল, সাদাসহ ৬/৭ রঙের কাপড়ের গেট। চনমনে রোদের মধ্যে বাড়ির ভেতরে বিরিয়ানির হাঁড়ি চড়েছে ইটের চুলার ওপর, লাকড়ির ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার। উঠান বা ছাদে টানানো হয় সামিয়ানা। তার নিচে ভাঁজ খুলে বসানো হয় এক রঙের চেয়ার, টেবিল। চেয়ারগুলোকে ঘিরে মানুষের ব্যস্ত ছোটাছুটি থাকেই! কিছু মানুষ দুপুরের রোদে উদোরপূর্তি শেষে কাপড়ে ঝোলের দাগ মেখে বের হয়। স্থান ভেদে আরো কিছু বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে।
একাল কিংবা সেকালের বিয়ে, কিছু মানুষের জন্য কয়েকটি স্পেশাল পদ থাকেই। জামাই যখন গেট দিয়ে প্রবেশ করেন, তখন তাকে মিষ্টি মুখ করানো হয়। কোথাও শরবত, কোথাও রসগোল্লা, আবার অনেক জায়গায় দুধও পরিবেশন করা হয়। এছাড়া খাবারের পাতে বরের জন্য স্পেশাল আস্ত খাসি থাকেই। বর/কনের মা-বাবা ও নিকটাত্মীয়দের জন্যও থাকে নানা বিশেষ পদ।
ঊনিশ শতকের মাঝামাঝিতে মধ্যবিত্ত গৃহস্থ বাঙালি বিয়ের ভোজের বর্ণনা পাওয়া যায় মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখায়, ‘কলাপাতায় বড় বড় লুচি আর কুমড়োর ছক্কা। কলাপাতার এক কোণে একটু নুন। মাসকলাই ডালের পুরে আদা মৌরি দিয়ে কচুরি, নিমকি, খাজা, চৌকো গজা, মতিচুর এইসব সরায় থাকিত। আর চার রকম সন্দেশ থাকিত। গিন্নিরা নিজেরাই রাঁধিতেন। একদল লোক খুঁত ধরে ভোজ পণ্ড করে দিতো বলে মেয়েরা আর রাঁধিতেন না।’
সময়ের সঙ্গে মানুষের জীবনে পরিবর্তন এসেছে। বাঙালি জীবনও তার ব্যতিক্রম নয়। একালের বিয়ে-বউভাতের ভোজেও তার ছায়া পড়েছে। এখন বাঙালির বিয়েতে ভাড়া বাড়িই ভরসা। আর খাওয়া দাওয়ার দায়িত্ব পড়ে কেটারিং এর ওপর। অর্থ-ক্ষমতার গৌরব সেকালের মতো একালেও আছে। নামি কেটারিংয়ের বিরিয়ানি, মোগলাই, চাইনিজ, কন্টিনেন্টাল খানা পরিবেশন করে তাক লাগিয়ে দেয়া হয় অতিথিদের।