শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১   ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জন্ডিস হলে কী করবেন, ডাক্তারের কাছে কখন যাবেন?

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০২:৩০ পিএম, ১৭ জুন ২০১৯ সোমবার

সত্যিই এই পৃথিবীতে জানার কোন শেষ নেই। একটু খানি বেশী জানলে হয়ত আপনি আপনার নিজেকে বাঁচাতে পারবেন আর অপরকেও সুস্থ রাখতে সক্ষম হবেন। আমি আজ আপনাদের জানাতে চায়, জন্ডিস সম্পর্কে। যেটি জানলে হয়ত একটি বড় ধরণের সমস্যা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবেন। জন্ডিস আসলে কোন রোগ নয়, এটি একটি রোগের লক্ষণ মাত্র। জন্ডিস হলে রক্তে বিলরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায় ফলে ত্বক বা চোখের সাদা অংশ ও অন্যান্য মিউকাস ঝিল্লি হলুদ হয়ে যায়। আর রক্তে বিলিরুবিনের ঘনত্ব ১.২ mg/dL এর নিচে থাকে। আর ৩ mg/dL এর বেশি হলে জন্ডিস হয়। 

মূলত রক্তস্রোতে অস্বাভাবিক উপায়ে বাইল পিগমেন্ট (Bile Pigment), বিলিরুবিন (Bilirubin) ইত্যাদি বেড়ে যাওয়ার ফলে শরীরের ত্বক এবং চোখের সাদা অংশ (Sclera) হলদে বর্ণ ধারণ করলে তাকে জন্ডিস বলে।

প্রাথমিক সতর্কতার জন্য প্রথমে জানতে হবে, জন্ডিস কিভাবে হয়? মানুষের শরীরে রক্তের প্রধান উপাদান হয়ত আমরা অনেকেই জানি আবার অনেকের অজানা। আমাদের শরীরে রক্তের প্রধান উপদান হচ্ছে, শ্বেত কণিকা, লোহিত কণিকা, অনুচক্রিকা এবং প্লাজমা রস। লোহিত কণিকা প্রাথমিকভাবে লিভার ও স্প্লীন (Spleen) থেকে এবং পরবর্তীতে হাড়ের মজ্জা থেকে উৎপন্ন হয়ে বেঁচে থাকে প্রায় ৩ মাস।

 

একজন স্বাভাবিক মানুষের ক্ষেত্রে রক্তে গড়ে ৫৫,০০,০০০ টি এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ৪৫,০০,০০০ টি লোহিত কণিকা থাকে এবং প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২৪,০০,০০০ টি লোহিত কণিকা উৎপন্ন হয়। রক্ত স্রোতের মধ্যে বয়স্ক, ভেঙে যাওয়া, অস্বাভাবিক বা মরে যাওয়া লোহিত কণিকা অপসারিত হয়ে স্প্লীন, লিভার ও হাড়ের মজ্জার ভিতর জমা হয়। বিশেষ প্রক্রিয়ায় এই লোহিত কণিকার মূল উপাদান হিমোগ্লোবিন ভেঙে আয়রন বহনকারী প্রোটিন হেমাটিন অস্বাভাবিক বা গঠনগত ত্রুটির কারণে বাইল নিঃসরণের পথ অবরুদ্ধ হয়ে যায় তখন ইউরোবিলিনোজেন রক্তস্রোতের সঙ্গে মিশে প্রস্রাবের সাথে নির্গত হয়। তখন প্রস্রাব হলদে দেখায়। 

আমাদের শরীরে রক্তে স্বাভাবিক পরিমাণ বিলিরুবিন থাকে যার মাত্রা ০.২-০.৮ মিলিগ্রাম। যদি রক্তে অতিরিক্ত বিলিরুবিন জমা হয় তখন আমরা তাকে জন্ডিস বলে থাকি। সেটা ৩.০ থেকে তার উপরে। লিভারের অস্বাভাবিক আচরণের কারণে পিত্ত নির্গমনে বাধা প্রাপ্ত হয়ে শরীরে রক্তে চলে আসে। অপরপক্ষে লিভারের বাইরে গলস্টোন বা টিউমারের কারণে হেপাটিক ডাক্ট বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বিলিরুবিন রক্তে চলে আসে।

 

শিশুদের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিমাণ লোহিত কণিকা ভেঙে গিয়ে প্রচুর বিলিরুবিন তৈরী হয় এবং রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ বেড়ে যায় এটা অন্যান্যদের ক্ষেত্রে তেমন দেখা যায় না। গিলবার্ট সিন্ড্রোমের ক্ষেত্রে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা সামান্য বেড়ে যায় কিন্তু তা জন্ডিস হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত নয়। আবার লিভার ফাংশন টেস্টে বিলিরুবিন বেশি দেখায় কিন্তু এক্ষেত্রে কোন লক্ষণও থাকে না সমস্যাও থাকে না।

কারো জন্ডিস হয়েছে, সেটা কীভাবে বুঝবেন?

জন্ডিস হলে চামড়া এবং চোখের সাদা অংশ হলুদ হয়ে যায়।
প্রস্রাব গাঢ় হলুদ বর্ণের হয়।
লিভার প্রদাহের কারণে ক্ষুধামন্দা, অরুচি, গা বমি বমি ভাব এবং জ্বর থাকতে পারে।
দুর্বলতা ও বিরক্তি ভাব দেখা দিতে পারে।
জন্ডিসের কারণে শরীরের অন্যান্য লক্ষণসমূহ দেখা যেতে পারে।

স্বাভাবিকভাবে এই রোগ নির্ণয়ঃ

১. স্ক্লেরার ওপরের অংশ
২. জিহ্বার নিচের অংশ
৩. নখের গোড়ায়
৪. আভ্যন্তরীণ মিউকাস মেমব্রেন এবং
৫. গুরুতর অবস্থায় - মুখমন্ডল, চর্ম, বাম হাতের তালু প্রভৃতি জায়গায় হলদে ভাব আছে কিনা পরীক্ষা করতে হবে ।

পরীক্ষাগারে জন্ডিসের রোগ নির্ণয়ঃ

সেরাম বিলিরুবিন- রক্তে সেরাম বিলিরুবিনের মাত্রা ৩ এর বেশি হলে ক্লিনিকাল জন্ডিস বলে এর কম হলে সুপ্ত জন্ডিস বলে।

আল্ট্রাসনোগ্রাম-এর মাধ্যমে লিভার, গলব্লাডার এবং বিলিয়ারী ট্রাক্টের মধ্যে গঠনগত কোন অস্বাভাবিকতা যেমন- টিউমার, ফোড়া, টিস্যু বিকৃতি, যেমন- সিরোসিস, গলব্লাডার, পাথরের উপস্থিতি বা বাইল ডাক্ট অবরুদ্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া।
সিটি স্ক্যানিং (CT Scanning)- এর মাধ্যমে চমৎকার প্রতিবিম্ব পাওয়া যায় এবং লিভারে টিউমার, ফেটি লিভার, লিভারে অন্যান্য পদার্থের উপস্থিতি ইত্যাদি সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা পাওয়া যায়।
এম. আর. আই (MRI)- এর মাধ্যমেও লিভারের পরিস্কার ছবি পাওয়া যায় এবং রোগ নির্ণয় সহজতর হয়ে যায়।
এক্সরে- সাধারণ এক্সরে দিয়ে গলব্লাডারে পাথর আছে কিনা তা সহজেই নির্ণয় করা যায়।

জন্ডিসের চিকিৎসাঃ

১. আরোগ্য হওয়ার পূর্বপর্যন্ত পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে।
২. প্রচুর পরিমাণে অনুত্তেজক তরল খাদ্য ও পানীয় পান করতে হবে।
৩. জন্ডিস আক্রান্ত এলাকায় পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে।
৪. অতিরিক্ত মসল্লা, তৈলাক্ত খাদ্য এবং ভাজাভুজি পরিহার করতে হবে।
৫. এ সময়ে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি প্রোটিন জাতীয় খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৬. আখের রস, নিমপাতার রস, অড়হরের পাতার রস, করলা ইত্যাদি জন্ডিসের জন্য খুবই উপকারী।

সংক্ষেপে জন্ডিস কি?
জন্ডিস বলতে বুঝায় ত্বক-চোখ-মিউকাস মেমব্রেনে হলুদভাব রঙ দেখা যাওয়া।

 

জন্ডিস কি কোন রোগ?
জন্ডিস কোন রোগ নয় বরং এটি হলো রোগের লক্ষণ।

বিলিরুবিন কি?
আমাদের শরীরের লোহিত রক্ত কনিকা প্রতি তিন মাস পরপর ভেঙ্গে যায় এবং নতুন রক্তকনিকা তৈরী হয়। লোহিত রক্ত কনিকার ভিতরই থাকে হিমোগ্লোবিন। যা ভেঙ্গেই বিলুরুবিন তৈরী হয় এবং লিভারের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত হয়ে অন্ত্রে পৌছায়। অন্ত্র থেকে এটি মলের সাহায্যে শরীরের বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়। কিছুটা আবার অন্ত্র থেকে রক্তে যায় যা কিডনীর সাহায্যে মূত্রের মাধ্যমে শরীরের বাইরে বের হয়ে যায়।

জন্ডিসের লক্ষণ সমূহঃ
হালকা জ্বর
দুর্বলতা
হলুদাভ ত্বক ও চোখ
অরুচি
বমি বমি ভাব থাকা 
মাংসপেশী বা জয়েন্ট এ ব্যথা
কালচে মুত্র
কাদার মত মল
চুলকানি

 

জন্ডিস হলে কী করবেন- আপনি অবশ্যই ডাক্তার দেখাবেন। কারণ-
জন্ডিস নির্মূল এর জন্য ওষুধের প্রয়োজন না থাকলেও ডাক্তার আপনাকে জন্ডিসের অন্যান্য উপসর্গ যেমন বমি ভাব, চুলকানি ইত্যাদি কমানোর ওষুধ দিয়ে আপনার আরাম নিশ্চিত করতে পারবে।
কারো কারো ক্ষেত্রে (বৃদ্ধ বা শিশু) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দূর্বল থাকতে পারে, যা ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট নয়। ডাক্তার সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিবে।

যদিও জন্ডিস বলতে সাধারণ অর্থে ভাইরাল হেপাটাইটিস বোঝানো হয় এবং এই লেখার মূল ফোকাস সেখানেই, কিন্তু প্রথমেই তো বলে নিয়েছি যে অন্যান্য অনেক কারণে জন্ডিস হতে পারে। সেইসব কারণের জন্য কিন্তু ওষুধ খেতে হবেই, আর যা একমাত্র ডাক্তারই পারে নিশ্চিত করতে।

কেন জন্ডিসে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খেতে মানা করা হয়?
কারণ, অনেক ওষুধই আমাদের শরীরে প্রবেশ করার পর তার প্রকৃয়াজাতকরণের কাজটি করে লিভার। জন্ডিসে যেহেতু লিভার খুবই নাজুক অবস্থায় থাকে, এই সময় আবার কোনো ওষুধ প্রকৃয়াজাতকরণের কাজটা লিভারের ওপর অতিরিক্ত চাপ ফেলে দেয়। তাই এ সময় যত কম ওষুধ খাওয়া যায়, ততই ভালো। এমনকি জন্মনিয়ন্ত্রন পিল বা হার্বাল ওষুধও বর্জন করুন।

জন্ডিসে কেন পানীয় খেতে বলা হয়?
যেহেতু জন্ডিসে বমি হয়, এর ফলে শরীর থেকে পানি বের হয়ে যায়। ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা এড়ানোর জন্য পানীয় খেতে বলা হয়। তাছাড়া, পর্যাপ্ত পানি খেলে মুত্রের সাহায্যে রক্তের অতিরিক্ত বিলিরুবিন বের হয়ে যায়।

অতিরিক্ত পানি খেয়ে ফেললে কি কোন সমস্যা আছে?
জন্ডিস হলে অতিরিক্ত নয়, পর্যাপ্ত পানি গ্রহণ করুন। দিনে তিন লিটার বা ১২ গ্লাস এর মত পানি খেতে চেষ্টা করুন।

জন্ডিসে স্যালাইন খাওয়ার প্রয়োজন আছে কি?
যদি পর্যাপ্ত পানি খাওয়া হয়, তবে প্রয়োজন নেই। কিন্তু যদি পানি না খেয়ে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা দেখা দেয় সে ক্ষেত্রে স্যালাইনের প্রয়োজন আছে।

 

জন্ডিসে কেন মদ্যাপান করতে মানা করা হয়?
মদ প্রকৃয়াজাত হয় লিভারে। জন্ডিসে যেহেতু লিভার খুবই নাজুক অবস্থায় থাকে তাই এ সময় মদ্যাপান করতে একেবারেই নিষেধ করা হয়।

জন্ডিসে কেন কম তেল খেতে বলা হয়?
তেল কম খেতে বলা হয়, কারণ তেল হজম করার জন্য বাইল নামক একটি পদার্থের প্রয়োজন হয় যা লিভার হতে তৈরী হয়। জন্ডিসে যেহেতু লিভার নাজুক অবস্থায় থাকে তাই একে অতিরিক্ত চাপ না দেয়ার জন্য তেলকে এড়িয়ে চলতে বলা হয়।

জন্ডিসে মাছ-মাংস খাওয়া যাবে কি?
অনেকে এ সময় মাছ-মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকে যা একেবারেই অনুচিত। এতে শরীরে প্রোটিন এর অভাব ঘটে যা আরো নানা ধরণের জটিলতা বয়ে আনতে পারে।

জন্ডিসে কোন ভিটামিন খাওয়ার প্রয়োজন আছে কি?
গবেষনায় ভিটামিন সেবনে জন্ডিস দ্রুত আরোগ্যের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই ভিটামিন নেওয়াটাও অত্যাবশ্যক না।

জন্ডিসে বিশ্রাম নেওয়া কেন জরুরী?
সমস্ত শরীরের মেটাবলিসমের অনেকটাই নির্ভর করে লিভারের উপর। এসময় বিশ্রাম নিলে মেটাবলিসমের হার কম থাকে এবং লিভারের উপর চাপ কম পরে।

বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কি ঘুমের ওষুধ খাওয়া যেতে পারে?
না। লিভারের নাজুক অবস্থায় এই জাতীয় ওষুধ ব্রেনের উপর কাজ করে অনেক সময় আপনাকে এমনকি কোমাতেও নিয়ে যেতে পারে।

জন্ডিসে কখন হাসাপাতালে ভর্তি হবেন?
যদি রোগীর আচার-আচরণ, বুদ্ধিমত্তার পরিবর্তন হয় 
যদি রোগীর শরীরে কাপুনি থাকে।
যদি কারো জাগা ও ঘুমের রুটিনে পরিবর্তন দেখা দেয়।
যদি কারো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আগে থেকেই দূর্বল বলে জানেন অথবা রোগী যদি ৫০ বছরের বেশী বয়স্ক লোক বা শিশু (এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দূর্বল) হয়, তবে হাসপাতালে ভর্তি করুন।

 

ফাইনালি জন্ডিস হলে কি করবেন?
জন্ডিসের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত বিশ্রাম, পানীয়, নিয়মিত টেস্ট করানো এবং মোস্ট ইম্পরট্যান্টলি কুসংস্কার থেকে মুক্ত থাকা।