চলচ্চিত্রে মিঠুনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, মান-অভিমান
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ১০:৩৫ এএম, ১৮ জুন ২০১৯ মঙ্গলবার
মিঠুন চক্রবর্তী। তিনি একাধারে ভারতের একজন খ্যাতিমান চলচ্চিত্র অভিনেতা, সমাজ সংগঠক এবং উদ্যোক্তাও বটে। শৈশবে ‘গৌরাঙ্গ চক্রবর্তী’ নামে বাংলাদেশের বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার নাম তুললে প্রথমে মনে পড়ে যায়, ‘শালা মারবো এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে!’এক যুগ আগে এই সংলাপটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। এমনকি এটি আরো স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের হিরো আলম। যিনি সংলাপটির কথায় সামান্য পরিবর্তন এনেছেন ঠিকই, কিন্তু এখান থেকেই কপি মেরেছিলেন।
মিঠুন চক্রবর্তীর চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে ‘মৃগয়া’ (১৯৭৬) চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এ ছবির মাধ্যমেই তিনি সেরা অভিনেতা হিসেবে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও লাভ করেন। মূলত প্রথম ছবি দিয়ে তিনি তার জাত চিনিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি এ পর্যন্ত ৩০০ টিরও অধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলা, পাঞ্জাবী, তেলেগু, ওড়িয়া, ভোজপুরী চলচ্চিত্রে মিঠুন অংশ নিয়েছেন। তিনি মনার্ক গ্রুপের স্বত্ত্বাধিকারী, যা অতিথি সেবায় নিয়োজিত রয়েছে। এছাড়াও বর্তমানে তিনি পরশ টিভি’র প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন।
একসময় মিঠুন চক্রবর্তী ২০০৯ সালে এসে রিয়েলিটি টিভি সিরিজ ডান্স ইন্ডিয়া ডান্সে প্রধান বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন৷ এদিকে, বেশ কিছু বাংলা সিনেমা রয়েছে মিঠুনের ঝুলিতে। তবে তার মধ্যে মিঠুনকে একজন পরিনত অভিনেতা বানানো সিনেমার নাম বললে প্রথমেই আসে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘তাহাদের কথা’ ছবিটি। এই ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য ১৯৯২ সালে জাতীয় পুরস্কারও অর্জন করেন তিনি। এছাড়া ‘ত্রয়ী’, ‘কালপুরুষ’, ‘তিতলি’, ‘শুকনো লংকা’, ‘আমি সুভাষ বলছি’, ‘নোবেল চোর’, ‘এক নদীর গল্প’, ‘নকশাল’ ছবিগুলোর সৌজন্যতায় তিনি হয়েছেন বাংলা সিনেমার এক প্রখ্যাত অভিনেতা। তবে মিঠুন উত্তম কুমারের সঙ্গেও কাজ করেছেন ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’ ছবিতে। মনমোহিনী শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে রোমান্স করে গেয়েছেন ‘আধো আলো’ ছায়াতে!
মিঠুনের গল্প শুনলে জানা যাবে চলচ্চিত্রে আসার আগের করুণ কাহিনী। একবার কোথায় যেন পড়েছিলাম, তিনি অতটা সুদর্শন ছিলেন না বলে পরিচালকরা তাকে ফিরিয়ে দেন। পরবর্তীতে বরিশালের ছেলে মিঠুন কাজ করেছেন বাংলাদেশে। শক্তি সামন্তের যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘অবিচার’ এ অভিনয় করে ওই সময় বেশ আলোচিত হয়েছেন তিনি। এই ছবিতে চিত্রনায়িকা রোজিনা তার হাত ছাড়তে চাননি, কিংবা আবেদনময়ী নায়িকা নূতন তার কাঁচা যৌবন পাকতে দেননি। এই ছবির প্রায় দুই যুগ পর আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন বিলেতে’ ছবিতে অভিনয় করেন মিঠুন।
এরপর হিন্দি ছবিতেও তিনি বেশ অন্যভাবে পরিচিত হয়েছেন। সেখানে তিনি ‘ডিসকো ড্যান্সার’ ছবি দিয়ে বলিউডের নাচের জগতে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেন, হয়ে যান মুম্বাইয়ের সেই দশকের অন্যতম জনপ্রিয় নায়ক। তবে মিঠুনের শুরুটা মসৃন ছিল না, নকশাল আন্দোলনের কারণে কলকাতা ছেড়ে পাড়ি জমান মুম্বাইয়ে। সেইখানে অর্থকষ্টে পড়ে অভাবে দিন কাটিয়েছেন, থেকেছেন মানুষের বাড়িতে। পরে একদিন কৌতুহলে ভর্তি হন পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে। সেখানেই তিনি নজরে পড়েন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মৃনাল সেনের। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের সংগ্রামী জীবন নিয়ে নির্মিত মৃনাল সেনের হিন্দি ছবিতে ‘মৃগয়া’ (১৯৭৬) তে নায়ক চরিত্রে প্রথম অভিনয় করেন মিঠুন। প্রথম ছবিতেই বাজিমাৎ করেন এই নায়ক আর অর্জন করেন জাতীয় পুরস্কার।
তবে মিঠুনের এই প্রাপ্তি ভারতীয় সিনেমা জগতের ইতিহাসে বিরল। তিনিই মনে হয় প্রথম সিনেমায় এত বড় পুরস্কার জিতেছেন। মিঠুনের শুরুর আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, তিনি জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তির পর এক বিনোদন সাংবাদিক তার সাক্ষাৎকার নিতে চাইলে, মিঠুন বলেন, ভরপেট খাওয়ালে তিনি সাক্ষাৎকার দিবেন, কারণ তার পেটে অনেক ক্ষুধা। সেদিনের ক্ষুধার্ত হয়ত এই অভিনেতাকে নিজের একাগ্রতা, পরিশ্রম ও আত্ববিশ্বাসের বলে পরবর্তীতে জীতেন্দ্র, অমিতাভদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার সুযোগ করে দেন। বহু পুরুষ যাকে হৃদয় দিয়ে বসেছিল, সেই সুপারস্টার শ্রীদেবী মিঠুনের কাছে নিজের হৃদয় সর্মপিত করেছিলেন, যদিও সেটার সুন্দর সমাপ্তি ঘটেনি। সল্প সময়ে ভেঙে যায় তাদের ভালোবাসা।
মিঠুন শুধু নায়ক নয় খলনায়কের চরিত্রেও দারুণ ছিলেন। নব্বই দশকে এসে খল চরিত্রে ও তিনি অনবদ্য ভূমিকা রাখেন। সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ ছবি দিয়ে সেরা সহ অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পান। ‘অগ্নিপথ’ ও ‘জল্লাদ’র জন্য পান সেরা পার্শ্ব ও খল অভিনেতার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। তবে কাজের ক্ষেত্রে তিনি অতটা সুনির্বাচন করতে পারতেন না, তাই ক্যারিয়ারে বেশ দুর্বল ছবিও আছে তার। সুপারহিট ছবি যেমন আছে, তেমন বহু সুপারফ্লপ কিংবা বস্তাপচা ছবিও মিঠুনের ঝুলিতে রয়েছে।
মিঠুন ১৯৫০ সালের ১৬ জুন বাংলাদেশের বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম গৌরাঙ্গ চক্রবর্তী। সিনেমার প্রয়োজনে তিনি নাম পাল্টান। শুনতে ভুতুড়ে শোনালেও সত্যি যে, অসংখ্যবার তার মৃত্যুর গুজব উঠেছে। তিনি ফিরে এসেছেন প্রতাপের সঙ্গে। তবে দুঃখের বিষয় হলো, কিংবদন্তীতুল্য এই অভিনেতা আজো রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত হননি। বিষয়টা খুবই হতাশাজনক। তবে একসময় মিঠুন রাজনীতিতে জড়িয়েছিলেন, আবার ছেড়েও দিয়েছেন। মনের কোন এক অভিমানে বাংলা ছেড়ে এখন তিনি স্ত্রী সাবেক নায়িকা যোগিতা বালী ও সন্তানদের নিয়ে ভারতের বাইরে বসবাস করছেন। তার সন্তানরাও চলচ্চিত্রে থিতু হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সফল হননি। তবে মিঠুন দাদাগিরির উপস্থাপনায় সাড়া জাগাতে না পারলেও, সেখানে নিজের জীবনের পরিশ্রম একাগ্রতার বহু বর্ণনা করেছেন নির্দ্বিধায়, এতে উঠে এসেছিল অনেক অজানা কাহিনী।