‘বন্ড’ ও ‘০০৭’ নেপথ্যে কি?
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৭:৪২ এএম, ৩০ জুন ২০১৯ রোববার
বরগুনায় রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের ৪৭ সেকেন্ডের ভিডিওটি এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে অবার ফেসবুকের হোম পেজে। দেশ জুড়ে আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের তিন দিন পেরিয়ে গেলেও মূল আসামিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে হত্যাকাণ্ড পরবর্তী বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা গেছে, কিভাবে গড়ে ওঠে ‘০০৭ গ্রুপ’, কিলিং মিশন শেষে কোথায় গিয়েছিলো খুনিরা।
ফেসবুকের মেসেঞ্জারে ০০৭ গ্রুপের সদস্যদের কথোপকথনের বেশ কিছু স্ক্রিনশট থেকে জানা গেছে, পুর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রুপের সবাই ঘটনার দিন সকাল ৯টায় বরগুনার কলেজ সড়কে অবস্থান নেয়। আলাদা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে রিফাত শরীফের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে তারা। ১০.২০ মিনিটে শুরু হয় তাদের মূল মিশন।
কলেজ গেট পার হওয়ার পর রিফাত শরীফকে ঘিরে ধরে ০০৭ গ্রুপের সদস্যরা। একের পর এক কিল-ঘুষি-লাথি দিতে দিতে নয়ন বন্ড ও সেকেন্ড ইন কমান্ড রিফাত ফরায়েজীর কাছে নিয়ে আসে। শুরুটা করে রিফাতই। হাতে থাকা ধারালো দা দিয়ে কোপাতে থাকে নয়নও। তাদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে বারবার রিফাত শরীফকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন স্ত্রী আয়েশা আক্তার মিন্নি।
কিলিং মিশন শেষে কলেজ রোড ধরে পশ্চিম দিকে চলে যায় হত্যাকারীরা। উপজেলার দিঘির পাড়ের পশ্চিম দিকের সড়কে অবস্থান নেয় নয়ন ও রিফাত। বাকিরা নিজেদের মত সটকে পড়ে।
চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা নয়ন বন্ডের মা সাহিদা বেগম জানান, ওইদিন সকাল ১১টায় নয়ন তাকে ফোন করে। ফোন রিসিভ করেই তিনি বলেন, ‘এ নয়ন তুই নাকি কারে কোপাইছো। আহারে কার মায়ের কোল খালি করছো।’ ওই সময় নয়ন বলে, ‘কোপাইছি ঠিক করছি, তুমি আমার জামা কাপড় দাও আর টাকা জোগার কর।’ এ কথা বলেই বাসার কাছকাছি একটি দোকানের পেছনে আসে। সেখান থেকে একটি ছেলেকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। নয়নের মা ওই ছেলের কাছে একটি টি-শার্ট ও প্যান্ট পাঠিয়ে দেয়। পরে আবারো নয়ন তাকে টাকা পাঠাতে বলে। এবার নয়নের মা নিজে গিয়ে ২০ হাজার টাকা দিয়ে আসেন।
নয়ন টাকা নিয়ে কেজি স্কুল সড়কে রিয়াজুলের বাড়িতে যায়। পরে রিয়াজুল, আল-আমিন, নয়ন, রিফাত একসঙ্গে হয়। এ সময় নয়ন একটি মোবাইল ভেঙে ফেলতে চাইলে রিয়াজুল ও আল- আমিন ফোনটি রেখে টাকা দিয়ে দেয়। এরপর নয়ন ও রিফাত তাদের আরেক বন্ধু সাইফুলের সঙ্গে দেখা করে। সেই থেকে তাদের হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না।
কে এই নয়ন বন্ড?
নয়নের ভালো নাম সাব্বির। বাবা আবু বক্কর সিদ্দিকী কয়েক বছর আগে মারা যান। বড় ভাই সিঙ্গাপুরপ্রবাসী। ভাইয়ের আয়েই চলে সংসার। ২০১১ সালে বরগুনা জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পাসের পর শহরের আইডিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে নয়ন বন্ড। এরপর বরগুনা সরকারি কলেজের অনার্সের ছাত্র পরিচয়ে নিয়মিত কলেজে যেতেন। তবে পড়াশোনার ধারেকাছেও তাকে দেখেনি কলেজের ছাত্র-শিক্ষকরা।
নয়নের ব্যক্তিগত রুমেই চলে ‘০০৭ গ্রুপে’র আড্ডা, মাদক সেবন ও বিক্রি। সাহিদা বেগম এসব করতে বারবার নিষেধ করতেন। বিনিময়ে খেতেন ছেলের হাতের মার। নয়নের রুম থেকেই ২০১৭ সালে বিপুল পরিমান মাদক ও দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ।
বরগুনা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ বলেন, ২০১৫ সালে কেজি স্কুল এলাকায় বকেয়া না দেয়ায় এক দোকানদারকে মারধর করে আলোচনায় আসে নয়ন। এরপর থেকে নিজেকে ‘নয়ন বন্ড’ নামে পরিচয় দেয়া শুরু করে সে। বন্ধু মহল থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপরাধীর তালিকাতেও তিনি ‘নয়ন বন্ড’ নামে পরিচিত। তিনিই গড়ে তোলেন জনপ্রিয় হলিউড চরিত্র জেমস বন্ডের এজেন্ট নাম্বার ধরে ‘০০৭’ ফেসবুক গ্রুপ। এ গ্রুপের বাকি সদস্যরাও এলাকায় বখাটে হিসেবেই পরিচিত।
অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ আরো জানান, মাদকের টাকার জন্য চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি করতো ০০৭ গ্রুপের সদস্যরা। তাদের সন্ত্রাসীপনায় সবাই অতিষ্ঠ। বিভিন্ন মামলায় একাধিকবার খেটেছে নয়ন। তার সব কর্মকাণ্ড ছিল কলেজকেন্দ্রিক। কলেজের ছাত্রদের মারধর করে মোবাইল কেড়ে নিয়ে টাকা আদায় করাই ছিল তার কাজ। পরবর্তীতে গ্রুপ তৈরি করে মাদক বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ে সে। আর সেকেন্ড ইন কমান্ড রিফাত ফরায়েজীর নেতৃত্বে চলে ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবে মারধর, মোটরসাইকেল ছিনতাইসহ বাকি সব কাজ।
বরগুনার এসপি মারুফ হোসেন বলেন, আমরা বসে নেই, জালের ফাঁস ছোটো হয়ে আসছে, আইনের ফাঁক গলে কেউ বাঁচতে পারবে না। আসামিদের পালানোর সব পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। দুই-তিন দিনের মধ্যে সব অপরাধীকে গ্রেফতার করা হবে।