হোলি আর্টিজান হামলা: বিভীষিকাময় ঘটনার ৩ বছর
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৮:২৭ এএম, ১ জুলাই ২০১৯ সোমবার
গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলার বিভীষিকাময় তিন বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ সোমবার। ২০১৬ সালের ১ জুলাই হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলা চালিয়ে দুই পুলিশসহ দেশি-বিদেশি ২২ জনকে হত্যা করে জঙ্গিরা। এসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযান ‘অপারেশন থান্ডারবোল্টে’ পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়। অভিযানে এক জাপানি ও দু’জন শ্রীলংকানসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার পর করা মামলাটি ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন আছে। এরই মধ্যে ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে মামলার বাদীসহ ৬০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। আগামীকাল মঙ্গলবারও সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ আশা করছে আগামী নভেম্বরের মধ্যেই এ মামলার রায় হয়ে যাবে।
সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, চাঞ্চল্যকর এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সব সদস্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে এ মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ হবে বলে আশা করছেন তিনি। আগামী অক্টোবর-নভেম্বর মাসের মধ্যে এ মামলার রায় হবে বলে তিনি প্রত্যাশা করেন। তিনি বলেন, এ মামলায় ৬ আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আর যেসব সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাদের সাক্ষ্যগ্রহণ পরবর্তী সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণে সহায়তা করবে। এখন পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেট ও চিকিৎসকদের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। তাদের সাক্ষ্যগ্রহণ হলে পরিপূর্ণ সাক্ষ্যগ্রহণ হবে। সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তির লক্ষ্যে আমরা অগ্রসর হচ্ছি।
পাবলিক প্রসিকিউটর আরো বলেন, ন্যক্কারজনক এ ঘটনার মাধ্যমে সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণতায় ওই অগ্রযাত্রা থামাতে পারেনি সন্ত্রাসীরা। হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলার ঘটনায় ২০১৬ সালের ৪ জুলাই এসআই রিপন কুমার দাস বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। তদন্ত শেষে গত বছরের ১ জুলাই পুলিশ পরিদর্শক মো. হুমায়ুন কবির ৮ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। চার্জশিটে ২১১ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। চার্জশিট দাখিলের পর মামলাটির বিচারের জন্য সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে আসে। পলাতক দু’জন আসামির বিরুদ্ধে পত্রিকায় গ্যাজেট প্রকাশ হয়। এরপর আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ (অভিযোগ) গঠন করেন। চার্জ গঠনের পর থেকে দ্রুত সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য হয়। ২০ থেকে ২২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেয়ার পর পলাতক দু’জন আসামিকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। পলাতক দু’জনের পক্ষে সরকার থেকে লিগ্যাল এইডের আইনজীবীও নিয়োগ করা হয়। যদিও গ্রেফতারের পর আসামীরা তাদের নিজস্ব আইনজীবী নিয়োগ দেন। সর্বশেষ গত ২৫ জুন পাঁচজন সাক্ষীকে আদালতে উপস্থাপন করা হয়। এ পাঁচজনসহ আদালতে মোট ৬০ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। প্রতিটি সাক্ষীকে আসামিপক্ষ জেরা করেছেন।
ভয়াবহ জঙ্গি হামলার তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আজ তিন ঘণ্টা খুলে দেয়া হবে গুলশানের সাবেক হোলি আর্টিজান বেকারি ভবন। সোমবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত এটি খোলা থাকবে। দেশি-বিদেশি নাগরিকরা হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় নিহতদের স্মরণে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে পারবেন। পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, হলি আর্টিজান বেকারি এলাকায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আগতদের তল্লাশি করে সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হবে।
হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার সেই রাতটি ছিল বিভীষিকাময়। জঙ্গিরা ২২ জনকে হত্যার পর রাতভর অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রেখেছিল ২৫ জনকে। এর মধ্যে রেস্তোরাঁর স্টাফ ছিলেন ১৪ জন। এদের মধ্যে হোলি আর্টিজান বেকারির পাস্তা শেফ হিসেবে কর্মরত ছিলেন শিশির সরকার। হামলার দিন তিনি কোল্ড রুমে এক জাপানি নাগরিকের সঙ্গে তিনঘণ্টা পালিয়ে ছিলেন। রাত ১২টার দিকে জঙ্গিরা জাপানি নাগরিককে নিয়ে গিয়ে খুন করে জঙ্গিরা। রাতে জঙ্গিরা যে খাবার খেয়েছিল, তা শিশিরকে দিয়েই তৈরি করিয়েছিল।
বিভীষিকাময় ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শিশির সরকার বলেন, রাত পৌনে ৯ টার দিকে হঠাৎ গেস্টদের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে উঁকি দিয়ে অস্ত্রধারী জঙ্গিদের দেখতে পাই। এরপর জাপানি নাগরিকসহ কোল্ড রুমে ঢুকে পড়ি। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো ডাকাত বা বড় সন্ত্রাসী ঢুকেছে, তারা টাকা পয়সা নিয়ে চলে যাবে। আমরা দুজনই চিলে কোঠা বা কোল্ড রুমের দরজার রাবারের অংশটা ধরে রাখছিলাম। যেন বাইরে থেকে টেনে খুলতে না পারে। আমি কান পেতে ফায়ারিংয়ের শব্দ শুনেছি। রাত ১২ টার দিকে কোল্ড রুমের বাইরে থেকে দরজা টানে জঙ্গিরা, বলে খোলার জন্য। কিন্তু ভেতর থেকে দরজা টেনে ধরে ছিলাম আমরা। কোল্ড রুমে ঠান্ডায় আমরা কাঁপছিলাম। হঠাৎ দরজাটা খুলে যায়। এরপর আমি জঙ্গি রোহানকে দেখতে পাই। পরে পত্রিকায় দেখে ওকে চিনেছি। এরপর আমাকে নিচে যেতে বললে, আমি সামনে গিয়ে বসি। গেস্টদের লাশ ও রক্ত ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছিল না।
তিনি বলেন, অনেকক্ষণ পর একজন জঙ্গি (লম্বা মতো) তার নাম মনে হয় নিবরাস, ও আইসা জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের মধ্যে ওয়াইফাইয়ের পাসওয়ার্ড কে জানে? যে জানো তাড়াতাড়ি বলো। পরে ভয়ে শাহরিয়ার (অপর একজন কর্মী) বলল যে আমি জানি। জঙ্গি নিবরাস বলল যে এই মোবাইলে পাসওয়ার্ড দাও। ওরে একটা মোবাইল দিলো। ওরা (জঙ্গিরা) এর পরে মোবাইল দিয়ে লাশের ছবি তুলছে, কোথায় কোথায় যেন কথা বলল।
শিশির আরো বলেন, রাত দুইটা কি আড়াইটার দিকে জঙ্গিরা বলে তোমাদের মধ্যে বাবুর্চি কে? তখন অন্যরা আমাকে দেখিয়ে দেয়। জঙ্গিরা আমাকে কিচেন রুমের মধ্যে নিয়ে জানতে চাইলো, কী কী মাছ আছে? আমি বললাম সব ধরনের মাছ আছে। আমারে জিজ্ঞাসা করল কোরাল মাছ আছে? আমি বললাম আছে। বলে যে বের কর। সেটা বের করলাম। বলল যে আর কী আছে? চিংড়ি আছে? বললাম, আছে। আমি ওগুলো বের করে দিলাম। ওরা বলে এগুলো মশলা দিয়ে ভালো করে ফ্রাই কর। ওদের কথা মতো মাছগুলো আমি তেলে ফ্রাই করলাম। পরে তা প্লেটে করে তাদের দিলাম। জঙ্গিরা খাবারগুলো গেস্টদের দিলো আর আমাদের বলল যে, তোরা মিলে সেহরি কর। কিন্তু আমাদের কারো পেটে খাবার যায় না।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। এতে নিহত হয় তিন বাংলাদেশি নাগরিকসহ ২০ জন। এর মধ্যে ৯ জন ইতালির, ৭ জন জাপানের এবং একজন ভারতীয়। এছাড়া জঙ্গিদের হামলার শুরুতেই দুই পুলিশ কর্মকর্তাও নিহত হন। রেঁস্তোরার ভেতরে রাতভর জিম্মি ছিলেন অন্তত ২৪ জন, যাদের প্রায় ১১ ঘণ্টা পর পরদিন সকালে সেনা কমান্ডো পরিচালিত অপারেশন থান্ডারবোল্টের সময় উদ্ধার করা হয়। এছাড়া রাতের বিভিন্ন সময় উদ্ধার করা হয় আরো অন্তত ৭ জনকে। অপারেশন থান্ডারবোল্টের পর রেঁস্তোরা থেকে ৫ জঙ্গিসহ ৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া পালাতে গিয়ে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরেক রেস্তোরাঁকর্মী।