শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১   ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রোগের সঙ্গে যুদ্ধ

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ১২:২০ পিএম, ২ জুলাই ২০১৯ মঙ্গলবার

কুকুরকে খেয়াল করেছেন? পোষা কুকুরগুলো যে বাড়িতে থাকে, সেই বাড়ির মানুষগুলোকে সে কিন্তু  ঠিকভাবে চেনে। অথচ, হঠাৎ কোনো সন্দেহভাজন আগন্তুককে দেখলে ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করে।

আপনার বাসা পাহারায় কোনো কুকুর থাকুক বা না থাক, একদিক থেকে আপনার ও আপনার চারপাশের সব প্রাণির মতো আপনার শরীরেও কিছু একটা আছে, যা অহেতুক উৎপাত থেকে রক্ষা করে। সেটা হলো আপনার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, মানে ইমিউন সিস্টেম।

আপনার বাড়ির কুকুর যদি আপনাকেই তাড়া করত, তাহলে কী হতো- ভাববার বিষয়। কিন্তু কখনোই তা হবে না। তেমনি আপনার ইমিউন সিস্টেমও কখনোই আপনার দেহকে আক্রমণ করে না, আক্রমণ করে ইনভেডার বা আগন্তকদের। কথা হলো দেহ কীভাবে নিজের আর পরের জিনিস আলাদা করে। সেই রহস্যময় কাজকারবার নিয়েই এই লেখা।

ফরাসি বিজ্ঞানী জুল হফম্যান, মাছি (বৈজ্ঞানিক নাম- Drosophila melanogestar) নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেন সহজাত ইমিউনিটির বিষয়ে জানতে পারেন। তিনি ও তার সহযোগীরা মাছির একটি বিশেষ জিন পরিবর্তন করে দেখালেন, তাদের সংক্রমণ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। তখন নিশ্চিত হলো যে, জাতিজনিক(জেনেটিক) উপায়ে প্রাণিকুলের মধ্যে ইমিউনিটি বিকশিত হয়েছে। তবে মেরুদণ্ডী প্রাণীদের দেহে সহজাত ইমিউনিটির ভূমিকা তেমন থাকে না। নতুন রোগের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার জন্য অভিযোজিত ইমিউন সিস্টেম গড়ে উঠেছে, নতুন কোনো জীবাণু দেখলেই এরা দমন করতে পারে। দমনের কাজটা হয় তিনস্তরে: দুটো নন-স্পেসিফিক, আর একটা স্পেসিফিক।

মানবদেহের সবচেয়ে বড় অঙ্গ হলো ত্বক। জীবাণুকে ত্বক ভেদ করেই তারপর দেহে ঢুকতে হবে। ত্বককে সুরক্ষা দিতে তার চারপাশে লিপিডের একটা স্তর থাকে। সেই সঙ্গে থাকে আমাদের ত্বকে বসবাসকারী কিছু ভালো বা উপকারী ব্যাকটেরিয়া, যারা রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুগুলোকে ত্বকের ওপর সংলগ্ন হতে বাধা দেয়। কিন্তু ত্বক তো অবিচ্ছিন্ন নয়। ত্বকের মধ্যে মুখছিদ্র আছে, নাসারন্ধ্র আছে, চোখ আছে এগুলো দিয়ে জীবাণু প্রবেশ করতে চায়। কিন্তু মজার ব্যাপার, প্রতিটা ছিদ্রেরই একটা করে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকে। 

মুখের স্যালাইভা বা লালা আর নাসাগহ্বরের মিউকাস,চোখের লাইসোজাইম এনজাইম সেটার বিরুদ্ধে  সক্রিয় থাকবে। ধরুন, আপনি জীবাণু গিলে ফেললেন, আসলে এরকম শত শত জীবাণু আপনার খাবারের সঙ্গে পরিপাকতন্ত্রে ঢোকে। সেগুলোকে মারে পাকস্থলীর গায়ের প্যারাইটাল কোষ থেকে নিঃসৃত হাইড্রোক্লোরিক এসিড। কিন্তু অনেক ব্যাকটেরিয়া এসিড-লাভিং তারা সেখানে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকে। কিন্তু পাকস্থলী পার হলেই অন্ত্রে এসে পিত্তরসের ক্ষারধর্মী পরিবেশে তাদের জীবন চলে যায়।

কিছু জীবাণু যেভাবে হোক আপনার দেহের ওপর এসে পড়ল। এবার শরীর কি করবে? তার দুটি প্রধান হাতিয়ার হলো জ্বর আর প্রদাহ। পাইরোজেনের (ফ্যাগোসাইট নামের এক ধরনের সঙ্গে শ্বেত রক্ত কণিকা থেকে ক্ষরিত প্রোটিন) ক্ষরণ অতিরিক্ত হলে রক্ত বাহিকা সংকুচিত হয় ফলে দেহের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। তখন জীবাণুর কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আর প্রদাহ হলে ছুটে যায় দেহের সশস্ত্র বাহিনী-শ্বেত রক্তকণিকা। এর শতকরা সত্তর ভাগই হচ্ছে নিউট্রোফিল। এরা সারা দেহে চষে বেড়ায় আর ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় জীবাণু ভক্ষণ করে। একই রকম কাজ করে মনোসাইট।

অবশ্য সে রূপ বদলে হয়ে যায় ম্যাক্রোফেজ। এরা ক্ষণপদ সৃষ্টির মাধ্যমে জীবাণুকে আটকে ফেলে, তারপর লাইসোজোমাল এনজাইমের ক্রিয়ায় জীবাণুর অন্তঃকোষীয় পরিপাক ঘটায়। ইওসিনোফিল আর বেসোফিল এলার্জিক এন্টিবডি আর পরজীবীর প্রতি ক্রিয়া প্রদর্শন করে।
ধরুন এত কিছু পেরিয়েও কিছু প্যাথোজেন আপনার দেহে ঢুকলো। প্যাথোজেন হলো রোগ সৃষ্টিকারী উপাদান। আর সে জানি স্মরণ করে তার নাম এন্টিজেন।

এবার জীবাণুকে থামাতে আপনার দেহের নন-স্পেসিফিক ইমিউন সিস্টেম ব্যর্থ। তাই এবার আপনার দেহকে অন্য রাস্তা খুঁজতে হবে। এবার আপনার দেহকে ইমিউনিটি অর্জন করতে হবে, সেটাই হলো তৃতীয় স্তরের প্রতিরক্ষা, প্রতিটি প্যাথোজেনের এন্টিজেন যেমন আলাদা, তেমনি তার প্রতিকার ও আলাদা। সেটা করা হয় ইমিউনোগ্লোবিউলিন-জাতীয় পাঁচ ধরনের প্রোটিন IgA, IgB, IgM, IgG আর IgD-এর সমন্বয়ে। 

এদের বলা হয় এন্টিবডি। প্রতিটি এন্টিবডির ভেরিয়েবল প্রান্ত থাকে অনন্য। যেটা সুনির্দিষ্টভাবে একটা এন্টিজেনের জন্য সুনির্দিষ্ট। টি লিম্ফোসাইটের নির্দেশনা লিম্ফ নোডে থাকা প্লাজমা কোষে এন্টিবডি সংশ্লেষিত হয়। আর একবার এন্টিবডি তৈরি হয়ে গেলে সেটার বর্ণনা দেহে লিপিবদ্ধ থাকে। এ কাজটা করে প্লাজমা কোষের মতোই আরেক প্রকারের দীর্ঘজীবী বি লিম্ফোসাইট, যাদের আমরা স্মৃতিকোষ বলি। 

তাই সংক্রামক রোগ একবার হলে পরে হওয়ার সম্ভাব্যতা কম থাকে। আর মেরুদণ্ডীদের রোগ প্রতিরোধের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য কাজে লাগিয়ে তৈরি হয় ভ্যাকসিন। ব্রিটিশ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার এক বসন্ত রোগের ওপর কাজ করে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেন। এ পদ্ধতিতে মূলত জীবাণুকে মেরে ফেলে বা দুর্বল করে ফেলে দেহে প্রবেশ করানো হয়, যাতে দেহ তার বিরুদ্ধে এন্টিবডি সংশ্লেষণ করে স্মৃতিকোষে সংরক্ষণ করে রাখে।

তিনস্তরে কুকুর আপনার বাড়ি পাহারা দেয়, তারপরও আপনি অসুস্থ হন। এগুলো কোনো কাজেরই না, তাই মনে হচ্ছে? ভেবে দেখেছেন, মরার কতক্ষণ পরেই এই জীবাণুগুলো দেহকে পচানো শুরু করে, অথচ আপনি বছরের পর বছর দিব্যি বেঁচে আছেন, এই জীবাণুগুলো নিয়েই।

ভাবতে থাকুন, আপনার কুকুর যদি আপনাকে দেখলে ঘেউ ঘেউ করে, মানে আপনার ইমিউন সিস্টেম যদি আপনার সুস্থ-সবল কোষকে ক্রমাগত  মারা শুরু করে, তাহলে কী হবে? উত্তরটা নাহয় না-ই দেয়া হলো, ভাবুন, তারপর নাহয় নেট ঘেঁটে রেফারেন্স মিলিয়ে নিবেন! 

আমরা আশা করছি, নিকট ভবিষ্যতে বিজ্ঞানীরা প্রাণিকুলের ইমিউনিটি সিস্টেম বা সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে আরো ভালো করে জানতে পারবেন, আর সেই সূত্রে আমরা আমাদের ইমিউনিটি সিস্টেমকে আরো কার্যকরভাবে সংক্রমণের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পারব। সেই সঙ্গে বাঁচতে পারব অনেক রোগের হাত থেকে!