ক্লান্তির পেছনে রয়েছে যে আশ্চর্য কারণ
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৩:৪০ পিএম, ৩ জুলাই ২০১৯ বুধবার
সকালে ঘুম থেকে উঠেই ধরুন আপনি ব্যায়াম করা শুরু করলেন! প্রথমেই ২ কেজি ওজনের ডাম্বেল তুললেন, দ্বিতীয়বারও তুললেন অনায়াসে। এভাবে দশবার তোলার পর আপনার মাংসপেশি আর সাড়া দেবে না, ১৫ বারের পর আপনি হয়তো আর তুলতেই পারবেন না। খুব যদি শক্তিমান হয়েও থাকেন, একটা সময় গিয়ে আপনি হাল ছাড়তে বাধ্য হবেনই। কিন্তু কেন এমন ঘটে? নির্দিষ্ট পরিমাণ কাজ করার পর কেন আমাদের মাংসপেশিগুলো ক্লান্ত হয়ে যায়?
এর কারণ হিসেবে আমরা ল্যাকটিক এসিডের ক্ষরণ, শক্তির স্বল্পতা ইত্যাদিকে দায়ী করে থাকি। তবে এই কারণগুলোর কোনোটাই আমাদের পেশির ক্লান্তির পেছনে প্রধান কারণ নয়। প্রধান কারণটি হলো- একটা নির্দিষ্ট সময় পরে আমাদের পেশিগুলোর মস্তিষ্ক থেকে সংকেত গ্রহণের অপারগতা। পরিশ্রম করার সময় শরীরের কোনো এক বা একাধিক পেশি আমরা যখন ব্যবহার করি, তখন মস্তিষ্ক থেকে অনবরত সেসব পেশি কোষে সিগনাল বা সংকেত পৌঁছায়। একটি নির্দিষ্ট সময় পরে আমাদের পেশি আর সেই সংকেত গ্রহণ করতে পারে না।
আসল ব্যাপারটি জানতে হলে বুঝতে হবে, কীভাবে মস্তিষ্ক থেকে প্রাপ্ত সংকেতগুলোর প্রতি দেহের মাংসপেশি প্রতিক্রিয়া জানায়। মস্তিষ্ক থেকে মোটর নিউরন নামক লম্বা-পাতলা কোষের সহযোগিতায় সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশ সময়ে একেকটি সংকেত আমাদের পেশিতে পৌঁছায়। মোটর নিউরন ও আমাদের পেশিকোষের মধ্যে থাকে খুবই ক্ষুদ্র পরিমাণ ফাঁকা জায়গা। এসব জায়গার মধ্য দিয়েই মস্তিষ্কের কোষ ও পেশি কোষের মধ্যে নানা ধরণের কণিকার আদান-প্রদান হয়।
মোটর নিউরনগুলো অ্যাসিটাইলকোলিন নামক একধরণের নিউরোট্রান্সমিটার আমাদের পেশিতে পরিবহণ করে থাকে। অন্যদিকে, পেশিকোষের পর্দায় থাকে ধাতব আয়ন, ভেতরে পটাশিয়াম ও বাইরের পর্দায় সোডিয়াম। মস্তিষ্ক থেকে সংকেত পেশিতে পৌঁছে দেয়ার সময় মোটর নিউরন কোষগুলো পেশি কোষে অ্যাসিটাইলকোলিন প্রবেশ করায়। এর ফলে পেশি কোষে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্রগুলো খুলে যায়।
পেশি কোষের পর্দার ছিদ্র উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় পর্দার বাইরের প্রান্তে থাকা সোডিয়াম ভেতরে প্রবেশ করে ও ভেতরে থাকা পটাশিয়াম বাইরে চলে যায়। পেশি কোষের মেমব্রেন বা পর্দার এপাশ-ওপাশে এই সোডিয়াম-পটাশিয়ামের অদল-বদলই হলো আমাদের পেশি সংকুচিত হওয়ার পেছনের কারণ। আমরা নিশ্চয়ই জানি, পেশি যদি অতিরিক্ত কাজ করে তবে তা সংকুচিত হয়। এর কারণ পেশির ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়লে মস্তিষ্ক থেকে পেশির কোষগুলোতে প্রচুর সিগনাল বা সংকেত যেতে থাকে।
যাই হোক, আয়নের এই অদলবদলে এক ধরণের বৈদ্যুতিক সংকেত তৈরি হয়, যেটাকে বলে অ্যাকশন পটেনশিয়াল। এই বৈদ্যুতিক সংকেত সম্পূর্ণ পেশিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং পেশির অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা ক্যালসিয়ামকে বাইরে নিয়ে আসে। ক্যালসিয়ামের এই হঠাত ক্ষরণে পেশির ভেতরে লুকিয়ে থাকা মাসল ফাইবারগুলো একে অপরের সাথে আঁটসাঁটভাবে লেগে যায় ও পেশিকে সংকুচিত করে ফেলে।
এখন কথা হলো, পেশির সংকোচনে যে পরিমাণ শক্তি দরকার হয়, তা কোথা থেকে আসে? এর পেছনে আছে এটিপি (অ্যাডিনোসিন ট্রাই ফসফেট) নামের এক ধরণের অণু। এই এটিপির কারণেই পেশির ওপর থেকে চাপ সরে গেলে পটাশিয়াম ও সোডিয়াম আয়নগুলো পুনরায় নিজের জায়গায় ফিরে আসে। এতক্ষণ যে প্রক্রিয়া বর্ণিত হলো, প্রতিবার পেশির সংকোচনে সেই প্রক্রিয়ারই পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। বারবার এটিপির ব্যবহার হওয়ায় এক সময় আর প্রয়োজনীয় শক্তি পাওয়া যায় না, ল্যাকটিক এসিডের মতো বর্জ্যের পরিমাণ যায় বেড়ে। এর ফলে আয়নগুলো আর যথাস্থানে ফিরতে পারেনা। তাই মস্তিষ্ক থেকে সিগনাল আসতে থাকলেও আমাদের পেশি আর পেরে ওঠে না।
তবে আমাদের শরীরে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম ও এটিপির কমতি নেই। তাই খানিক বিশ্রামের পরেই দেহের অন্য প্রান্ত থেকে এসব অণু পরিশ্রান্ত পেশিতে জমা হয় এবং আমরা পুনরায় শক্তি পেয়ে থাকি।