ইসলামের দৃষ্টিতে পিতা-মাতার অধিকার (পর্ব- ১)
নিউজ ডেস্ক
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৩:১৮ পিএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ বৃহস্পতিবার
আধুনিক সভ্যতায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও স্ত্রী-সন্তানকেন্দ্রিক জীবনে পিতা-মাতার প্রতি মানুষের অবহেলা সীমাহীন। অথচ এ পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ মহান স্রষ্টার পরে তার অস্তিত্বের জন্য তার পিতা-মাতার কাছে সে চিরঋণী। এই ঋণ অপরিশোধ্য। কুরআন ও হাদীসের আলোকে পিতা-মাতার আনুগত্য ও সেবা করা অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফরজ আইন। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বারংবার তাঁর নিজের ইবাদত করার নির্দেশ দেওয়ার পরই পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন, “এবং তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া আর কারও ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। পিতা-মাতা উভয়ে বা তাদের একজন যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হন, তাহলে তাদেরকে “উফ” বলবে না। (তাদের প্রতি সামান্যতম বিরক্তি প্রকাশ করবে না।) তাদেরকে ধমক দিবে না এবং তাদের সাথে সম্মানজনকভাবে বিনম্র হয়ে কথা বলবে। মমতাবশে তাদের জন্য নম্রতা অবনত করে রাখবে এবং বলবে, হে আমার প্রভূ আপনি তাদেরকে দয়া করুন যেমন ভাবে তারা শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছেন। তোমাদের অন্তরে কি আছে তা তোমাদের রব ভালো জানেন। তোমরা যদি সৎকর্মশীল হও তবে তিনি আল্লাহ বিমুখীদের ক্ষমাকারী। (সূরা বাণী ইসরাঈল- ২৩-২৪)
আল্লাহ তাআলা অন্যত্রে বলেন, আর আমি মানুষকে তাঁর পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। মাতা সন্তানকে কষ্টের উপর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করেন এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বৎসরে। অতএব আমার প্রতি এবং তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই কাছে। যদি তোমার পিতা-মাতা তোমাকে পীড়াপীড়ি করে যে, আমার সাথে শিরক করবে, যে বিষয়ে তোমার জ্ঞন নেই। তাহলে তুমি তাদের কথা মানবে না, তবে পৃথিবীতে তাদের সাথে সদাচরণের সাথে জীবন কাটাবে। (সূরা লুকমান- ১৪)
পিতা-মাতার আনুগত্য ও সেবা করার অর্থ হলো আল্লাহর নির্দেশের বিরোধী নয় এমন সকল নির্দেশ মান্য করা এবং সাধ্যমত তাদের সেবা যত্ন করা। বার্ধকক্যজনিত কারণে মানবীয় দুর্বলতায় বা কারো প্ররোচনায় পিতা-মাতা সন্তানের সাথে দুর্ব্যবহার করতে পারেন। এক্ষেত্রে সন্তানের উপর ফরজ হলো ধৈর্য ধরা এবং বিনয় ও আদবের সাথে ভুল ধরিয়ে দেওয়া। তারা যতই দুর্ব্যবহার করুন না কেন, তাদের সাথে সাধ্যমত বিনম্র প্রকাশ করতে হবে, ভালো ব্যবহার করতে হবে। কেননা মুমিনের অন্তরে কী আছে আল্লাহ তা ভালো করে জানেন। মুমিন যদি সাধ্যমত চেষ্টা করেন তবে অনিচ্ছাকৃত ভুল আল্লাহ ক্ষমা করবেন। কেননা পিতা-মাতার খেদমত/সেবা করা ফরজে আইন বা সার্বজনীন ইবাদত।
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস রাঃ বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে জিহাদে অংশগ্রহণের অনুমতি প্রর্থণা করে। তিনি বলেন, তোমার পিতা-মাতা কি জীবিত আছেন? সে বলল হ্যাঁ। তখন তিনি বলেন, তোমার পিতা-মাতাকে নিয়ে তুমি জিহাদ করো। (সহীহ বুখারী- ৩/১০৯৪, সহীহ মুসলিম- ৪/১৯৭৫)
এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে বলল, আমি হিজরতের বাইআ’ত করতে আপনার কাছে এসেছি এবং আসার সময় আমার পিতা-মাতা কাঁদছিলেন। তাঁর পরও আমি এসেছি। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যেমন পিতা-মাতাকে কাঁদিয়ে এসেছ, এবার তাদের কাছে ফিরে গিয়ে তাদেরকে হাসাও। (সুনানে আবু দাউদ- ৩/১৭)
পিতা-মাতার সন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লহর সন্তুষ্টি এবং তাদের অসন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহর অসন্তুষ্টি। (সুনানে তিরমিযী- ৪/৩১০)
পিতা-মাতার পায়ের নিচে জান্নাত। (আল মু’জামুল কাবীর- ২/২৮৯, সহীহ আত-তারগীব- ২/৩২৭)
পিতা-মাতা আমাদের ইহকালীন জীবনের উৎস। আবার তারাই পরকালের জীবনের উৎস। এ জীবনের জন্য আমরা তাদের কাছে চিরঋণী।
তাদের যত্ন সেবাই জান্নাতের সূনিশ্চিত পথ। কেননা- নবী (সা.) বলেছেন, হতভাগা সে, হতভাগা সে, হতভাগা সে, যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতা উভয়কে বা একজনকে বৃদ্ধ অবস্থায় পেল, এরপরও তাদের যত্ন সেবার মাধ্যমে জান্নাতে যেতে পারল না। (সহীহ মুসলিম- ৪/১৯৭৮)
রাসূল (সা.) বলেন, কঠিনতম কবীরা গুনাহ আল্লাহর সাথে শিরক করা, এরপর পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া। (সহীহ বুখারী- ৫/২২২৯ - ৫/২৫৩৫)
পিতা-মাতার যত্নসেবা ও তাদের সাথে সর্বোত্তম আচরণ করা যেমন আল্লাহর সন্তুষ্টি, রহমত ও জান্নাত লাভের অন্যতম উপায়, তেমনি তাদের সাথে দূর্ব্যবহার করা, কোনভাবে তাদেরকে কষ্ট দেওয়া, বা তাদের যত্ন সেবায় অবহেলা করা আল্লাহর অসন্তুষ্টি, গজব, লা’নত ও জাহান্নাম লাভের উপায়। পিতামাতার অবাধ্যতা বা কোনোভাবে কষ্ট দেওয়া হারাম ও জঘন্যতম কবীরাহ গুনাহ। পিতামাতার যত্ন সেবার একটি দিক হল তাদের জন্য অর্থ ব্যয় করা।
মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, তারা আপনাকে প্রশ্ন করছে সে বিষয়ে কি ব্যয় করবে? আপনি বলুন, তোমরা কল্যাণকর যা ব্যয় করবে তা পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন, পিতৃহীন, অনাথ, দরিদ্রগণ ও মুসাফিরের জন্য (সূরা বাকারা- ২১৫)
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, নিজের উপার্জন থেকে আহার করাই সর্বোত্তম ও পবিত্রতম আহার। আর মানুষের উপার্জন তার নিজের সন্তান। কাজেই তোমরা তোমাদের সন্তানদের উপার্জন থেকে আহার কর। (সুনানে নাসায়ী- ৭/২৪০-২৪১)
পিতামাতার মৃত্যুর পরও তাদের অধিকার থেকে যায়। এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতামাতার ইন্তেকালের পরে তাদের খেদমতের ব্যয় আর কিছু বাকি আছে কি যা করে আমি তাদের সেবা করতে পারি? তিনি বললেন, হ্যাঁ, চারটি কাজ আছে।
১- তাদের উভয়ের জন্য দু’আ করা ও ক্ষমা চওয়া।
২- তাদের ওয়াদা ও চুক্তিগুলো কার্যকর করা।
৩- তাদের বন্ধুদেরকে সম্মান করা।
৪- তাদের মাধ্যমে যে রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় স্বজনদেরকে পেয়েছো, তাদের সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখা।
তাদের মৃত্যুর পরে তাদের যত্ন সেবার এই কাজগুলোই তোমার দায়িত্বে অবশিষ্ট রয়েছে। (সুনানে ইবনে মাজাহ- ২/১২০৮)
মহান আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিকটি জানার, বুঝার ও আমল করার তাওফিক দান করুন।