ভাল আছি! ভাল থাকুন!
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৩:২৮ পিএম, ৬ আগস্ট ২০১৯ মঙ্গলবার
সফলতা হচ্ছে এক বিরামহীন সফর। সফলতা গন্তব্য নয়। সফলতা গন্তব্যে পৌঁছানোর একটি পথ। আর গন্তব্যে পৌঁছার জন্যে পথ পরিবর্তনেরও প্রয়োজন হতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থতাও পরিপূর্ণ সফল জীবনের জন্যে মাইলফলক হিসেবে কাজ করতে পারে। আত্ম-উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ডেনিস ওয়েটলি একটি চমৎকার ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটি ১৯৭৯ সালের। ডেনিস ওয়েটলি শিকাগো থেকে লস অ্যাঞ্জেলসে যাবেন। সেখানে তার বক্তৃতা দেওয়ার কথা। ব্যস্ততাকে সামাল দিয়ে শিকাগোর ওহারা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছে দেখেন দেরি হয়ে গেছে। দৌড়ে টার্মিনালে পৌঁছে দেখেন গেট বন্ধ হয়ে গেছে। বিমানে ওঠার সিঁড়ি সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। গেটকিপার নারীকে তিনি বিমানটি থামানোর জন্যে অনুনয়, অনুরোধ, তর্ক বিতর্ক করলেন। কোনও লাভ হলো না। চোখের সামনে বিমানটিকে রানওয়ে দিয়ে চলে যেতে দেখলেন।
রাগে ক্ষোভে ঝড়ের বেগে তিনি ফিরে এলেন টিকিট কাউন্টারে। আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানাবেন। তিনি লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। এ সময় বিকট বিস্ফোরণের শব্দ হলো। তিনি লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায়ই জানতে পারলেন, যে বিমানে তার যাওয়ার কথা ছিল, তা আকাশে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিধ্বস্ত হয়েছে। বিমানের একটি ইঞ্জিন ভেঙে রানওয়েতে পড়ে যায়। হাইড্রোলিক লাইন ও কন্ট্রোল কেবল ছিঁড়ে যায়। পাইলট বিমানটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। বিমানের আরোহী ও ক্রু সবাই নিহত হয়।
ডেনিস ওয়েটলি এই ঘটনার সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমি টিকিট লাইন ত্যাগ করে এয়ারপোর্ট হোটেলে একটা রুমে উঠলাম। বিছানার পাশে কারপেটের ওপর নতজানু হয়ে সেজদা করলাম। স্রষ্টার কাছে শুকরিয়া আদায় করে প্রার্থনা করলাম। এক যুগ পার হয়ে গেছে। এখনও ফ্লাইট ১৯১-এর টিকিটটি আমার কাছে রয়েছে। আমি কখনও টাকা ফেরত নেওয়ার জন্যে টিকিটটি ট্রাভেল এজেন্টের কাছে পাঠাইনি। আমি এই টিকিটটি আমার অফিস কক্ষে বুলেটিন বোর্ডে আটকে রেখেছি। এই টিকিটটি নীরবে স্মরণ করিয়ে দেয় প্রতিদিনই আমার জন্যে ক্রিসমাস। আমি বেঁচে আছি এটাই তো অনেক বড় রহমত।’
তাই পরিপূর্ণ জীবনের জন্যে মেনে চলুন ৬টি বষয়-
মানুষকে গুরুত্ব দিন
কোনটা প্রয়োজনীয় আর কি করা ভাল তা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বিবেচনা করুন। অনেকেই আছেন যারা মূলত নিঃসঙ্গ ও ক্লান্তিকর জীবন যাপন করেন। কারণ তারা ব্যক্তিগত সম্পর্কে অবহেলা করেছেন। অধিকাংশ সময়ই তারা কাজ বা পেশাকে এত বেশি গুরুত্ব দেন যে, বন্ধু ও পরিবার পুরোপুরি বঞ্চিত হয়। খ্যাতি বা অর্থের পেছনে এরা এতটা অন্ধের মত ছোটেন যে, স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মা কাউকেই কোনও সময় দিতে পারেন না। ফলে পরবর্তী সময়ে অর্থ ও খ্যাতির মাঝেও একেবারে নিঃসঙ্গ ও বঞ্চিত অবস্থায় পড়ে যান। তখন তিনি সন্তান বা স্ত্রীর সময় কামনা করেন। কিন্তু দেখা যায় যে, স্ত্রী বা সন্তানের তাকে দেওয়ার মত সময় নেই। তারা তাদের নিজস্ব জগৎ গড়ে তুলেছে। তাই পরিবারের জন্যে, বন্ধুদের জন্যে, আত্মীয়দের জন্যে, সামাজিক কাজের জন্যে আগে থেকেই সময় বের করে নিন। আন্তরিক বন্ধন গড়ে তুলতে সময় ব্যয় করুন। ক্লান্তিকর জীবন থেকে আপনি মুক্তি পাবেন।
সবার সঙ্গে সহানুভূতিপূর্ণ ও সম্মানজনক আচরণ করুন
অবজ্ঞা, অশ্রদ্ধা বা অবহেলাপূর্ণ আচরণ সবসময় জীবনকে মমতাহীন পাশবিকতার দিকে নিয়ে যায়। অপর পক্ষে বিনয়, সহানুভূতি ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণ জীবনকে মহিমান্বিত করে। মর্যাদাপূর্ণ ও শ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণ শুধু বন্ধুদের সঙ্গে নয়, শত্রুদের সঙ্গেও করা যেতে পারে। শত্রুর সঙ্গে সহানুভূতি ও মহানুভব আচরণ অনেক সময় শত্রুতা দূর করতেও সাহায্য করে। আমরা যদি বাংলার বীর ঈশা খাঁর জীবন দেখি, তবে এর জ্বলন্ত প্রমাণ পাই। বিশাল মোঘল বাহিনী যখন ঈশা খাঁর রাজধানী সোনার গাঁ আক্রমণ করল, তখন ঈশা খাঁ মোঘল সেনাপতি মানসিংহকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণের আহ্বান জানালেন। রাজা মানসিংহ আহ্বানে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মানসিংহের তরবারি ভেঙে গেল। ঈশা খাঁ অনায়াসে এই সুযোগ গ্রহণ করে মানসিংহকে বধ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে নতুন তরবারি এগিয়ে দিয়ে পুনরায় যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আহ্বান জানালেন। ঈশা খাঁর মহানুভবতা মানসিংহের হৃদয় জয় করল। দুই পক্ষের সন্ধি হল। মানসিংহ দিল্লী ফিরে গেলেন। মহানুভবতা প্রদর্শন না করে ঈশা খাঁ মানসিংহকে হত্যা করতে পারতেন। পরিণামে দিল্লী থেকে আরও বিশাল বাহিনী আসত। যার মোকাবিলা হয়তো ঈশা খাঁর পক্ষে করা সম্ভব হতো না। কিন্তু ঈশা খাঁর মহানুভবতা তাকে রক্তক্ষয় ও ভবিষ্যৎ পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছিল। আসলে সহানুভূতি ও মহানুভবতা এমন এক মানবীয় গুণ যা জীবনকে স্বর্গীয় করে তোলে।
সবসময় শোকরগুজার থাকুন
দুঃখ কষ্টের দিকে সহজেই আমাদের চোখ চলে যায়। অনেক সময় ব্যক্তিগতভাবে বা জাতিগতভাবে অনেকের মধ্যেই নাই নাই খাই খাই ভাব চলে আসে। আপনি যদি আপনার কোন প্রতিবেশী বা বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেন, ভাই কেমন আছেন! তিনি বলবেন, ‘এই কোন রকম আছি’ বা ‘এই কোন রকম কেটে যাচ্ছে’ বা ‘আর থাকা’ ইত্যাকার নানা রকম ক্লান্তিকর কথা। এমনকি একজন কোটিপতিকেও যদি জিজ্ঞেস করেন, কেমন আছেন? তাকেও বলতে শুনবেন এই একই রকম ক্লান্তিকর কথা। একটি ভাল লেখা সম্পর্কেও মন্তব্য জিজ্ঞেস করুন, খুব কম ব্যক্তিকেই বলতে শুনবেন লেখাটি ভাল হয়েছে। অধিকাংশকেই বলতে শুনবেন ‘এই চলে আরকি’ বা ‘মোটামুটি হয়েছে’। অর্থাৎ সবকিছুতেই নেতিবাচক চিন্তা ও না- শুকরিয়ার মনোভাব। আর এই মনোভাব সবসময় জীবনকে আরও হতাশা ও বিভ্রান্তির মধ্যে ঠেলে দেয়। কিন্তু আপনি যদি একবার প্রো-অ্যাকটিভ বা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারেন, তখন আপনি দেখবেন জীবনের সুন্দর দিকগুলো আপনার কাছে উদ্ভাসিত হচ্ছে, আপনার হৃদয়কে আনন্দে আপ্লুত করছে। প্রকৃতির নিয়মই হচ্ছে তেলে মাথায় তেল দেওয়া। আপনি যদি একজন ইউরোপীয়কে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কেমন আছেন? তার যত কষ্ট বা অসুবিধাই থাক না কেন তিনি প্রথম বলবেন, ‘ফাইন’ অর্থাৎ বেশ ভাল আছি। এই বলার মধ্য দিয়ে তিনি ভাল জিনিসকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করেন। দুনিয়াতে এখন তারা নিঃসন্দেহে বৈষয়িক দিক থেকে ভাল আছেন। এ প্রসঙ্গে আমরা হযরত মোহাম্মদ (স.)-এর একটি বাণী স্মরণ করতে পারি। তিনি বলেছেন সালাম বিনিময়ের পর কেউ তোমার কুশল জিজ্ঞেস করলে বোলো, ‘শোকর আলহামদুলিল্লাহ, আমি ভাল আছি।’ দৈনন্দিন জীবনে আপনিও এই ভাল আছি বলার অভ্যাস গড়ে তুলুন। আপনি শোকর গুজার হোন। প্রাকৃতিক নিয়মেই আপনার ভাল থাকার পরিমাণ বেড়ে যাবে।
দুঃখকে শক্তিতে রূপান্তরিত করুন
দুঃখ ছাড়া জীবন নেই। ব্যর্থতা ছাড়া সাফল্য আসে না। সফল মানুষরা সবসময় দুঃখ ও ব্যর্থতাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করেন।
দয়ালু হোন
আত্মকেন্দ্রিকতা ও ‘আমারটা আগে’ এই দৃষ্টিভঙ্গি জীবনকে এক ক্লান্তিকর বোঝায় রূপান্তরিত করে। পক্ষান্তরে দয়া ও সহানুভূতি জীবনকে আনন্দে রূপান্তরিত করে। দানবীর হাজী মোহাম্মদ মহসিন বলতেন, আমার তো জীবন একটাই। যে পথ দিয়ে এখন যাচ্ছি সে পথে তো আর নাও আসতে পারি। এই পথে কারো জন্যে যদি কোন কিছু করার সুযোগ থাকে তবে তা এখনই করা উচিত। দেরি করলে বা অবহেলা করলে কিছু করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে পারি। অন্যের উপকার যত ক্ষুদ্র আকারেই হোক আজ থেকেই শুরু করুন। দয়াশীল হোন। আলাদা আনন্দ পাবেন।
মেঘের আড়ালেই রংধনু রয়েছে
নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জীবনের আনন্দ সম্ভারকে কখনও উপভোগ করতে পারবেন না। হতাশা ও আনন্দ হচ্ছে এক পরস্পর বিরোধী অবস্থান। হতাশাবোধ আনন্দকে মাটি করে দেয়। আর হৃদয়ে আনন্দের অনুভূতি আনতে পারলে হতাশা পালিয়ে যায়। যারা জীবনের আনন্দকে উপভোগ করেছেন, তারা সবসময় কাঁটার আড়ালে গোলাপকেই দেখেছেন। হেলেন কেলার-এর জীবন দেখুন। শিশু বয়সে রোগ তার শ্রবণ ও দৃষ্টি শক্তি কেড়ে নেয়। তিনি কলেজ থেকে ডিগ্রি লাভ করেন। লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সফল বক্তা হিসেবে সারা দুনিয়ায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। তার এই অসাধারণ সাফল্যের পেছনে ছিল তার প্রো-অ্যাকটিভ দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি লিখেছেন ‘আমাকে এত কিছু দেয়া হয়েছে যে, কি দেয়া হয় নি তা নিয়ে ভাবার কোন সময় আমার নেই।’ শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তিহীন এক নারী যদি এত প্রো-অ্যাকটিভ ও প্রত্যয়ী হতে পারেন, শোকর গুজার হতে পারেন, তা হলে আপনি কেন পারবেন না। শোকর গুজার হোন! নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জীবনের আনন্দ সম্ভারকে উপভোগ করুন।