‘কোরবানি’ আত্মত্যাগের এক অনন্য ইবাদত
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৩:৩৫ পিএম, ৭ আগস্ট ২০১৯ বুধবার
কোরবানির আত্মত্যাগের পরীক্ষায় সফলকাম হয়েছিলেন মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম। আর তিনি ‘খলিলুল্লাহ’ বা আল্লাহর প্রিয়বন্ধু উপাধি লাভ করেছিলেন।
মনের আত্মত্যাগের অপরনাম ‘কোরবানি’। আল্লাহ তায়ালার কাছে ‘কোরবানি’র মর্যাদা অনেক বেশি। তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাকে কোরবানি বা আত্মত্যাগের মাধ্যমেই পরীক্ষা করেন। যারা আত্মত্যাগের এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়; তারাই আল্লাহর বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা লাভ করে।
এ কোরবানির বিধান সব নবী-রাসূলদের শরিয়তেই বিদ্যমান ছিল। পবিত্র কোরআনে পাকে কোরবানির বিধানের প্রমাণ পাওয়া যায়।
মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا وَبَشِّرِ الْمُخْبِتِينَ
‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কোরবানী নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ কারার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। অতএব তোমাদের আল্লাহ তো একমাত্র আল্লাহ সুতরাং তাঁরই আজ্ঞাধীন থাক এবং বিনয়ীগণকে সুসংবাদ দাও।’ (সূরা: হজ, আয়াত ৩৪)।
আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অর্জনের অন্যতম মাধ্যম কোরবানি। কুরবানি শব্দ থেকেই এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যায়। আরবি ‘করব বা কুরবান’ (قرب বা قربان) শব্দ দুটি মুসলমানদের মাঝে বেশি ব্যবহৃত ভাষা ফার্সি ও উর্দুতে (قربانى) কোরবানিতে রূপান্তরিত হয়। এর অর্থ হলো- নিকটবর্তী, নৈকট্য বা সান্নিধ্য।
আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকে যাচাই-বাচাইয়ে ‘কোরবানি’কেই মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। যেমনিভাবে তিনি হজরত আদম আলাইহিস সালামের সময় তার দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের মাঝে কোরবানির বিধান দিয়েছিলেন। যা ছিল মানব ইতিহাসের প্রথম কোরবানি। যেখানে আল্লাহ তায়ালা হাবিলের কোরবানিকে গ্রহণ করেছিলেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِن أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الآخَرِ قَالَ لَأَقْتُلَنَّكَ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ
لَئِن بَسَطتَ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِي مَا أَنَاْ بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لَأَقْتُلَكَ إِنِّي أَخَافُ اللّهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ
‘হে রাসূল! আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের বৃত্তান্ত যথাযথভাবে পাঠ করে শুনান। যখন তারা উভয়েই কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো এবং অন্যজনের কোরবানি কবুল হলো না।
সে (কাবিল) বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন (হাবিল) বলল, অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকিদের কোরবানি কবুল করেন।
সে (হাবিল) বলল, যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে আমার দিকে হাত বাড়াও, তবুও আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার দিকে হাত বাড়াবো না। কেননা আমি বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।’ (সূরা: মায়েদা, আয়াত ২৭-২৮)।
আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে তার একান্ত আপন করে নিতে কোরআনুল কারিমের অনেক স্থানে কোরবানির দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। বিভিন্ন শব্দের মাধ্যমে মানুষকে কোরবানির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। আর তাহলো-
>نحر শব্দ প্রয়োগ করে আল্লাহ বলেন, فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ‘সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের জন্য নামাজ এবং কোরবানি আদায় করুন। এ কারণে কোরবানির দিনকে ‘ইয়ামুন নহর’ (يوم النحر) বলা হয়।
> نسك অর্থে। আল্লাহ বলেন, قُلْ إِنَّ صَلاَتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ ‘আপনি বলুন, নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু; সবই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালার জন্য।’ (সূরা: আনআম, আয়াত ১৬২)।
> منسك অর্থে। আল্লাহ বলেন, ‘ لِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكاً ‘আমি প্রত্যেক উম্মাতের জন্য কোরবানির বিধান রেখেছি।’ (সূরা: হজ, আয়াত ৩৪)।
> الاضحى অর্থে। হাদিসের ভাষায় কোরবানির ঈদকে (عيد الاضحى) ‘ঈদ-উল-আজহা’ বলা হয়।
সর্বোপরি কথা হলো-
মানুষের মনের সর্বোচ্চ ত্যাগই হলো কোরবানি। কেননা কোরবানির পশুর রক্ত, পশম, হাড় কোনো কিছুই আল্লাহর কাছে পৌছে না। আল্লাহ তায়ালা মানুষের মনের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। যার দৃষ্টান্ত হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম। তিনি ‘কোরবানি’র নির্দেশকে হৃদয় দিয়ে উপলব্দি করেছিলেন বলেই তা বাস্তবে সম্পাদন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর আল্লাহ তায়ালা তাঁর কোরবানিকে কবুল করেছিলেন।
কোরআনুল কারিমে হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের কোরবানির সে ঘটনাও মুসলিম উম্মাহর শিক্ষার জন্য সুস্পষ্ট ভাষায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানিয়ে দিয়েছেন। যাতে মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে তার বিধান বাস্তবয়নে একনিষ্ঠ হয়।
পবিত্র কোরআনে মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা উল্লেখ করেন,
رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ
فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلَامٍ حَلِيمٍ
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِن شَاء اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ
فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ
وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ
قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ
إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلَاء الْمُبِينُ
‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে সৎকর্মপরায়ন সন্তান দান করেন। সুতরাং আমি তাকে এক ধৈর্যশীল সন্তানের সুসংবাদ দিলাম। অতঃপর সে যখন তার পিতার সঙ্গে চলা-ফেরার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইব্রাহিম (আলাইহিস সালাম) তাকে বলল, ‘হে বেটা! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে জবেহ করছি; এখন বলো, তোমার অভিমত কী?
সে বলল, আব্বা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তা পালন করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলরূপে পাবেন।
অতঃপর পিতা-পুত্র উভয়েই যখন আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহিম (আলাইহিস সালাম)
(আ.) তাকে জবেহ করার জন্য উপুড় করে শোয়ালেন।
তখন আমি ডেকে বললাম, হে ইব্রাহিম! তুমিতো স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে দেখালে। নিশ্চয়ই আমি এভাবে সৎকর্মশীলদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা।’ (সূরা: সাফফাত, আয়াত ১০০-১০৬)।
এ হলো কোরবানি কবুল হওয়া ব্যক্তির ভাবাবেগ ও মানসিকতা। কেননা কোরবানি যেমন তাকওয়াবান লোকদের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অনন্য নিদর্শন। আবার আত্মত্যাগের অনন্য নিদর্শনও এ কোরবানি।
যদিও যুগে যুগে প্রত্যেক নবীর শরিয়তেই কোরবানির বিধান ছিল কিন্তু তা ইবাদত হিসেবে হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের সময় থেকে পালিত হয়ে আসছে।
মুসলিম উম্মাহর কোরবানি মূলত: হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম কর্তৃক আল্লাহর সন্তুষ্টির পরীক্ষায় হজরত ইসমাইল আলাইহি সালামকে কোরবানির স্মৃতিময় ঘটনা ও শিক্ষাকে নিজেদের মধ্যে ঘটানো। নিজেদের মনের পশুত্বকে জবাইয়ের শিক্ষা গ্রহণ করা।
আল্লাহ তায়ালা স্বপ্নযোগে কোরবানির নির্দেশ দিয়ে হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে যে কঠিন অগ্নি পরীক্ষায় ফেলেছিলেন; তিনি তার সন্তুষ্টিতে হাসিমুখে পালন করে আল্লাহর প্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। আর বিনিময়ে তিনি মুসলিম জাতির নেতা হিসেবে সাব্যস্ত হলেন। আল্লাহ বলেন,
‘যখন ইব্রাহিম (আলাইহিস সালাম) কে তার পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তা পূর্ণ করলেন, তখন তিনি বললেন, আমি তোমাকে মাবনজাতির নেতা বানিয়ে দিলাম।’
হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম তার প্রাণপ্রিয় সন্তানকে আল্লাহর রাস্তায় কোবানির জন্য স্বপ্নে আদিষ্ট হন। আর নবিদের স্বপ্নও কোনো কল্পনা প্রসূত ঘটনা নয় বরং তা ‘ওহি’ বা আল্লাহর প্রত্যাদেশ।
৯৯ বছরের বৃদ্ধ হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম তার প্রাণপ্রিয় পুত্রকে কোরবানি করে সারা দুনিয়াকে এ সংবাদ দিয়ে গেলেন, যে আল্লাহ নির্দেশে আত্মত্যাগের বিকল্প নেই। আল্লাহর পক্ষ থেকে যে নির্দেশই আসুক তা পালনে একনিষ্ঠ হওয়াই প্রকৃত ইবাদত। তাইতো তিনি মিনা প্রান্তরে প্রাণাধিক সন্তানকে কোরবানি করে আল্লাহর নির্দেশ পালন করেছিলেন। আল্লাহ তায়ালা হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের আত্মত্যাগে খুশি হয়ে প্রাণপ্রিয় সন্তান হজরত ইসমাইলের পরিবর্তে জান্নাতি দুম্বায় কোরবানি কবুল করেছিলেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ
وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِينَ
سَلَامٌ عَلَى إِبْرَاهِيمَ
كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ
‘আর আমি তার (ইসমাইল আলাইহিস সালামের) পরিবর্তে জবেহযোগ্য এক মহান জন্তু দিয়ে তাকে মুক্ত করে নিলাম। আর এ বিষয়টি পরবর্তীদের জন্য স্মরণীয় করে রাখলাম। ইব্রাহিমের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। নিশ্চয় আমি এভাবে সৎকর্মপরায়নদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।’ (সূরা সাফফাত : আয়াত ১০৭-১১০)।
হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের আত্মত্যাগের সে নিদর্শন কোরবানি মুসলিম উম্মাহ প্রতিবছর জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখ এ ৩ দিনের যে কোনো একদিন পালন করে থাকেন। সুন্দর স্বাস্থ্যবান পশুকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানির মাধ্যমে নিজেদের মনের পশুত্বকে কোরবানিই হলো এ ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য।
হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের এ সুন্নাতকে কেয়ামত পর্যন্ত মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথ ও ঈদ-উল-আজহার সবচেয়ে পছন্দনীয় আমল হিসেবে স্বীকৃতি দেবে এবং বাস্তবজীবনে মেনে নেবে।
মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে লোক দেখানোর জন্য কোরবানি নয় বরং পশু জবাইয়ের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে মনের পশুত্ব ও আমিত্বকে জবাই করার তাওফিক দান করুন। কোরবানির মাধ্যমে নিজেকে তাকওয়াবান হিসেবে তৈরি করার তাওফিক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমিন।