ইতিহাসের নৃশংসতম এক হত্যাকাণ্ডের নাম ১৫ আগস্ট
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ১২:৩২ পিএম, ১৫ আগস্ট ২০১৯ বৃহস্পতিবার
মানব সভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম ঘৃণিত ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের একটি দিন ১৫ আগস্ট। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত ঘাতক চক্র সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এই দিনে সপরিবারে হত্যা করে।
হাজার বছরের নির্যাতিত-নিপীড়িত পরাধীন বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন হয়। পর্বতসম সাহস আর সাগরের মতো হৃদয়ের অধিকারী শেখ মুজিব জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঙালিকে ঔপনিবেশিক পাকিস্তানের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, শেখ মুজিব নিহত হবার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তার অনন্য সাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।
ব্রিটিশ লর্ড ফেন্যার ব্রোকওয়ে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব জর্জ ওয়াশিংটন, গান্ধী এবং দ্য ভ্যালেরার চেয়েও মহান নেতা।’
১৯৪৭ সালে ভ্রান্ত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। বৃটিশ শাসনের অবসান হলেও স্বাধীন সত্তা নিয়ে সেদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি বাঙালি জাতি। বাঙারির ওপর চেপে বসে পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্রের শাসন, শোষণ, অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়ন।
সেই নির্যাতিত বাঙালিকে সংগঠিত করে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে ধাবিত করেন শেখ মুজিব। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, ভূষিত হন বঙ্গবন্ধু উপাধিতে। আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অত্যাচার, নির্যাতন, জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়। বারবার তাকে হতে হয় মৃত্যুর মুখোমুখি।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এ দেশের মুক্তিকামী মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এদিন তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দিলে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালি অধিষ্ঠিত করে তাদের জাতির পিতার আসনে। বিশ্ববাসীর কাছেও বঙ্গবন্ধু পরিচিত হয়ে ওঠেন নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের নেতা হিসেবে।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে কিউবার কিংবদন্তি বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব, সাহসিকতা ও নির্ভীকতায় এই ব্যক্তি হিমালয়।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারালো তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।’
স্বাধীনতার পর দেশ পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী পদক্ষেপে বাংলাদেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর এই সফলতা ও উন্নতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার গতি বুঝতে পেরেই স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা ঠাণ্ডা মাথায় তাকে খুন করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে সেনাবাহিনীর বিপথগামী একটি দল হানা দেয়। এ সময় তারা বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সবাইকে একে একে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেলও সেদিন ঘাতকের হাত থেকে রেহাই পায়নি। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা এবং কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় তারা প্রাণে বেঁচে যান।
স্বাধীনতার পর জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তাকে হত্যার পর তার গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেশে হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়ে যায়। ষড়যন্ত্র, পাল্টা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একের পর এক সামরিক স্বৈরশাসনের পালা বদল হতে থাকে।
স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে ৪ বছরের মাথায় মহান এই নেতাকে হত্যা করা হয়। ১৫ আগস্ট ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এই হত্যাকাণ্ডের আরও শিকার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ দেশবরেণ্য সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও তার মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য কৃষক নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ শিশুপুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত আবদুলাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষায় এগিয়ে আসা বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ।
স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও জাতির পথপ্রদর্শক হিসেবেই আজ বঙ্গবন্ধু তাদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন।