মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১   ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সুলায়মান (আ.) এর মুকুট বেঁকে যাওয়ার রহস্য

নিউজ ডেস্ক

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৫:৩২ পিএম, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮ শনিবার

আল্লাহর নবী দুনিয়ার বাদশাহ সুলায়মান (আ.) এর রাজত্ব ছিল মানুষ, জিন, পশুপাখির ওপর। বাতাসও তার হুকুম মেনে চলত। সকাল-সন্ধ্যা তার বিশাল সিংহাসন পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে বহন করে নিত বাতাস। বর্তমানে বিমান আর ভূউপগ্রহের যুগে এ রহস্য এখন মানুষের যুক্তিগ্রাহ্য।
একদিনের ঘটনা। এতদিনকার অনুগত বাতাস বইতে লাগল উল্টাভাবে। কেমন বাঁকাতেড়া তার গতিপথ। সুলায়মান (আ.) লক্ষ করলেন, বাতাসের তোড়ে তার মাথার মুকুট বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। বাতাসকে বললেন, হে বাতাস! তোমার অবস্থা আজ এমন বেতাল কেন? সোজা হয়ে প্রবাহিত হও। আমি তো মুকুটটিও ঠিকভাবে রাখতে পারছি না মাথায়। বাতাস সুলায়মান (আ.) এর সঙ্গে কথা বলল, হে আল্লাহর নবী! আপনি নিজেই যে বাঁকাতেড়া চলছেন। আপনি যদি বাঁকা পথে চলেন আমার চলার গতিও বাঁকা হতে হবে। এটিই সৃষ্টির বিধান। এখানে আমার ওপর রাগ করার কিছু নেই।
মওলানা রুমি বলেন, তুমি আল্লাহর পথে ঠিকভাবে চল, তাহলে আল্লাহর বান্দারূপে প্রকৃতির সবকিছু তোমার সঙ্গে সঠিক আচরণ করবে। তুমি বাঁকা হলে তিনিও বাঁকা। সোজা হলে তিনিও সোজা। সৃষ্টিরহস্যের দিকে তাকাও, সঠিক মানদ-ের নিরিখে সৎ, সত্য ও সুন্দর জীবনযাপনের জন্যই আল্লাহ তায়ালা দাঁড়িপাল্লা সৃষ্টি করেছেন। যাতে একে অপরকে না ঠকায়। দাঁড়িপাল্লা সৃষ্টি না করলে বিশ্বব্যবস্থায় শৃঙ্খলা থাকত না। ন্যায়-অন্যায়ের চেতনা থাকত না।
‘আল্লাহ তায়ালা আকাশকে করেছেন সমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন মানদ-। যাতে তোমরা মানদ-ে সীমালঙ্ঘন না করো।’ (সূরা রহমান : ৭-৮)।
এটিই সৃষ্টিজগতের শাশ্বত ব্যবস্থাপনার বিধান, তুমি যদি পাল্লায় কম দাও, আমি তোমার মুনাফা কম করে দেব। তুমি সোজা হলে আমি সোজা, তুমি বাঁকা চললে আমিও বাঁকা।
এরই মধ্যে সুলায়মান (আ.) আটবারের মতো নিজ হাতে মাথার মুকুট ঠিক করলেন। কিন্তু প্রতিবারে মুকুট বাঁকা হয়ে যায়। তিনি বুঝতে পারলেন, কোথাও গোড়ায় গলদ আছে নিশ্চয়ই। মুকুট বাঁকা হওয়ার আসল কারণ তার মনের গহিনে লুকায়িত। তখনই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নিলেন। মনের গহিনে কামনা-বাসনার সবটুকু রেশ মন থেকে ঝেড়ে ফেললেন। দুনিয়ার প্রতি লোভের সব সুতা বিচ্ছিন্ন করলেন। লক্ষ করলেন, মাথার মুকুটটি আপনা-আপনি সোজা হয়ে গেছে। বাতাস তখন বলল, বাদশাহ নামদার! আপনার সঙ্গে দুটি কথা বলার অনুমতি ছিল আমার। আর বেশি কথা বলার, কোনো রহস্য ফাঁস করার অনুমতি নেই। এ সময় মাথার মুকুটের জবান খুলে গেল। বললÑ
তা’জ না’তেক গশত কেই শাহ না’য কুন
চোন ফেশা’ন্দী পর যে গেল পরওয়া’য কুন
তাজ বলে, ওহে বাদশাহ! আনন্দিত হোন শুভদিন
হৃদয়ের পালকের কাদা ঝরে গেছে, এবার উড়াল দিন।
আপনি কামনা-বাসনা, দুনিয়ার প্রতি লোভের কাদা ময়লা থেকে মনকে পরিষ্কার করে নিয়েছেন। এবার আপনি ডানা মেলে উড়াল দিতে পারেন ঊর্ধ্ব আকাশপানে, পরম আরাধ্যের সন্নিধানে। আত্মিক উন্নতির এটিই সঠিক পথ। মনকে পরিচ্ছন্ন করতে পারলেই তাতে আত্মার জগতের আলোর ঝলকানি বিচ্ছুরিত হবে। হে সাধক! হে সত্যের সন্ধানী, আল্লাহর সান্নিধ্যের অভিলাষী! জীবন চলার পথে তোমার জন্য নির্দেশনা হলোÑ
পস তোরা’ হার গম কে পীশ আ’য়দ যে দার্দ
বর কেসী তোহমত মনেহ বর খেশ গার্দ
তোমার জীবনে যখন কোনো দুঃখ-দুশ্চিন্তা নেমে আসবে
অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাবে না, খুঁজে দেখবে নিজেকে।
জীবন চলার পথে নানা অসংগতি আসে। পদে পদে হোঁচট খেতে হয়। দুঃখ-দুশ্চিন্তা পর্বতের মতো মাথায় চেপে বসে। ভুলভ্রান্তির শিকার হয়ে মনটা বিষিয়ে ওঠে। তখন সাধারণত মানুষ অন্যের ওপর দোষ চাপায়। বলে, অমুকের কারণে এমনটি হয়েছে। মওলানার উপদেশ হলোÑ বাতাস বাঁকা হয়ে প্রবাহিত হওয়ার কারণে সুলায়মান (আ.) এর মাথার টুপি বাঁকা হয়নি; বরং নিজের ভেতরে কোনো কিছু বাঁকা হয়ে থাকার কারণে সেই বক্রতা বাতাসের রূপ নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। তোমার মনের বক্রতার কারণেই যে নানা বিপত্তি, দুঃখ-দুশ্চিন্তা বিপদাপদ আসছে, তা তুমি দেখতে পাচ্ছ না। উল্টা তোমার ব্যর্থতার দায় অন্যের ওপর চাপাচ্ছ। কাজেই আগে নিজের ভেতরের খোঁজ নাও। দেখ, আল্লাহর সঙ্গে কতখানি ঠিক আছ। নচেৎ তোমার অবস্থা হবে ফেরাউনের মতো। ফেরাউনের দুশমন ছিলেন মুসা (আ.), যিনি তার ঘরে ছেলের আদরে প্রতিপালিত হচ্ছিলেন। অথচ ফেরাউন বাইরের লোকদের দুশমন ভেবে সমানে নিষ্পাপ শিশুদের জবাই করছিল।
তো হাম আয বীরুন বদী বা’ দীগরা’ন
ওয়ান্দারূন খোশ গশতে বা নফসে গেরা’ন
তুমিও বাইরে অন্যদের সঙ্গে মন্দ ঝগড়াটে
অথচ ভেতরে শিকলবন্দি নফসে আম্মারার সঙ্গে।
ওহে নফসের পূজারি! রাস্তায় অলিগলিতে তুমি যাকে দেখ মনে কর সবাই খারাপ, সবাই তোমার দুশমন। অথচ তাদের প্রকৃত অবস্থা তুমি জানো না। তারা কেউ তোমার দুশমন নয়; তুমিই খামখা কতক শত্রু সাজাও নিজের কল্পলোকে। যে তোমার আসল দুশমন, সে তোমার ভেতরে। সেই নফসে আম্মারার সঙ্গে তুমি বন্ধুত্ব পেতে আছ।
খোদ আদুওয়াত ঊস্ত কান্দাশ মী দহী
ওয়ায বুরুন তোহমাত বে হার কাস মী নহী
সে তোমার জানী দুশমনল্প পুষো দুধ কলা দিয়ে
বাইরে যাকে পাও তার ঘাড়ে দাও দোষ চাপিয়ে।
তুমি নিজের অক্ষমতা দুর্বলতা স্বীকার করতে রাজি নও; বরং অন্যদের সমালোচনা করে বেড়াও। ওহে ফেরাউন! আর কতকাল নিরপরাধ মানুষের খুন ঝরাবে আর নিজের কলুষিত গোনাহে জর্জরিত দেহের প্রতিপালন করবে? তুমি চিন্তা করে দেখ, ফেরাউনের জ্ঞানবুদ্ধি-বিচক্ষণতা অন্য রাজা-বাদশাহর চেয়ে কম ছিল না; বরং অনেক বেশি ছিল। কিন্তু তকদিরের ফয়সালা তাকে অন্ধ-অজ্ঞ বানিয়ে রেখেছিল। ফলে ঘরের শত্রু সে দেখতে পায়নি। বাইরের নিষ্পাপ শিশুদের শত্রু ভেবে সমানে জবাই করেছে। এর প্রধান কারণ তকদিরের ফয়সালা। তার মানে আল্লাহর হুকুমই চূড়ান্ত কথা। আল্লাহর নবীর সীমাহীন অবাধ্যতার কারণে ফেরাউনের ব্যাপারে আল্লাহর ফয়সালা চূড়ান্ত হয়েছিল। আল্লাহর হুকুমের মোহর যদি জ্ঞানীর চোখে ও কানে লেগে যায়, প্লেটোর মতো জ্ঞানী হলেও তার রক্ষা নেই, জন্তু-জানোয়ারের মতো নির্বোধ হয়ে যায়। আল্লাহর ফয়সালা কীভাবে আসে মওলানা তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
হুকমে হক বর লওহ মী আ’য়দ পদীদ
আ’নচুনা’নকে হুকমে গেইবে বা’য়েযীদ
আল্লাহর হুকুম লওহের ফলকে হয় উদ্ভাসিত
গায়েবি হুকুম যেমন বায়েজিদের কাছে প্রতিভাত।
গায়েবি হুকুম বা তকদিরের ফয়সালা কীভাবে আসে আর মানুষকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় তার সুন্দর ব্যাখ্যা এ বয়েত অর্থাৎ গায়েবি জগৎ থেকে আল্লাহর হুকুম লওহে মাহফুজে প্রতিফলিত হয়। কম্পিউটারের স্ক্রিনে যা প্রতিফলিত হয় তার উৎস মেমোরি। স্ক্রিনে ক্লিক করলে কাক্সিক্ষত ফাইল-ফোল্ডার ওপেন হয়, সক্রিয় হয়। লওহে মাহফুজের স্ক্রিনও যখন সক্রিয় হয় পৃথিবীতে তার মেমোরিগুলোর হুবহু প্রতিফলন ঘটে। তখন বান্দার ইখতেয়ার বা কর্মের স্বাধীনতা রহিত হয়ে নিয়তির হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হয়।
এ বয়েতে বায়েজিদ বোস্তামী কীভাবে একশ বছর পরে আবুল হাসান খারাকানীর জন্মলাভের আগাম সংবাদ পেলেন, সে রহস্যও জানা গেল। মানুষের অন্তর হলো ছোট্ট স্ক্রিন, আর লওহে মাহফুজ বড় স্ক্রিন। বড় স্ক্রিনের তথ্যগুলো প্রতিফলিত হয় ছোট স্ক্রিনে। স্বপ্নে আমরা অনেক সময় সেই প্রতিফলন দেখতে পাই। ছোট্ট পর্দা অপরিচ্ছন্ন থাকলে প্রতিফলন ঠিকভাবে আসে না। যাদের ছোট পর্দা স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো তারা ঠিকই বড় পর্দার তথ্য ভালোভাবে দেখতে পায়। আবুল হাসান খারাকানীর ব্যাপারে লওহে মাহফুজের সেই তথ্যই প্রতিফলিত হয়েছিল বায়েজিদের কলবের পরিচ্ছন্ন আয়নায়।
আবুল হাসান যখন বড় হলো, দেখা গেল তার অবয়ব স্বভাব ও আচরণ বায়েজিদ বোস্তামীর ভবিষ্যদ্বাণীর হুবহু প্রতিরূপ। আবুল হাসান বললÑ
গোফত মন হাম নীয খা’বশ দীদে আম
ওয়ায রওয়ানে শেখ ইন বেশনীদে আম
বলল আমিও দেখেছি স্বপ্নে মহামতি বায়েজিদকে
শুনেছি এসব কথা মনের কানে তার রুহ থেকে।
নিজাম ছিল, আবুল হাসান প্রতিদিন ফজরের পর চলে যেতেন খারাকান থেকে বোস্তামে বায়েজিদের মাজারে, যার দূরত্ব ছিল আজেকের হিসাবে ২৪ কিলোমিটার। দুপুর নাগাদ সেখানে ইবাদত সাধনায় কাটাতেন।
বা’ মেসা’লে শেখ পীশাশ আ’মাদী
ইয়া কে বী গুফতী শেকা’লশ হল শুদি
শেখের প্রতিরূপ নিয়ে আভির্ভূত হতো সম্মুখে
অথবা বিনা বাক্যব্যয়ে সমস্যার সমাধান হতো।
সেখানে মাঝেমধ্যে বায়েজিদ প্রতিরূপ অবয়ব ধারণ করে তার সামনে আভির্ভূত হতেন। কিংবা বিনা বাক্যব্যয়ে নানা জিজ্ঞাসা ও সমস্যার জট খুলে যেত আবুল হাসানের। বায়েজিদ বোস্তামীর জিয়ারতে গিয়ে এ ধরনের দুটি ঘটনার স্মৃতি এখনও এ লেখকের মনে দ্যুতি ছড়ায়, যার ইঙ্গিত রয়েছে আগের লেখায়।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৪খ. বয়েত, ১৮৯৭-১৯৩৪)ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

আল্লাহর নবী দুনিয়ার বাদশাহ সুলায়মান (আ.) এর রাজত্ব ছিল মানুষ, জিন, পশুপাখির ওপর। বাতাসও তার হুকুম মেনে চলত। সকাল-সন্ধ্যা তার বিশাল সিংহাসন পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে বহন করে নিত বাতাস। বর্তমানে বিমান আর ভূউপগ্রহের যুগে এ রহস্য এখন মানুষের যুক্তিগ্রাহ্য।
একদিনের ঘটনা। এতদিনকার অনুগত বাতাস বইতে লাগল উল্টাভাবে। কেমন বাঁকাতেড়া তার গতিপথ। সুলায়মান (আ.) লক্ষ করলেন, বাতাসের তোড়ে তার মাথার মুকুট বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। বাতাসকে বললেন, হে বাতাস! তোমার অবস্থা আজ এমন বেতাল কেন? সোজা হয়ে প্রবাহিত হও। আমি তো মুকুটটিও ঠিকভাবে রাখতে পারছি না মাথায়। বাতাস সুলায়মান (আ.) এর সঙ্গে কথা বলল, হে আল্লাহর নবী! আপনি নিজেই যে বাঁকাতেড়া চলছেন। আপনি যদি বাঁকা পথে চলেন আমার চলার গতিও বাঁকা হতে হবে। এটিই সৃষ্টির বিধান। এখানে আমার ওপর রাগ করার কিছু নেই।
মওলানা রুমি বলেন, তুমি আল্লাহর পথে ঠিকভাবে চল, তাহলে আল্লাহর বান্দারূপে প্রকৃতির সবকিছু তোমার সঙ্গে সঠিক আচরণ করবে। তুমি বাঁকা হলে তিনিও বাঁকা। সোজা হলে তিনিও সোজা। সৃষ্টিরহস্যের দিকে তাকাও, সঠিক মানদ-ের নিরিখে সৎ, সত্য ও সুন্দর জীবনযাপনের জন্যই আল্লাহ তায়ালা দাঁড়িপাল্লা সৃষ্টি করেছেন। যাতে একে অপরকে না ঠকায়। দাঁড়িপাল্লা সৃষ্টি না করলে বিশ্বব্যবস্থায় শৃঙ্খলা থাকত না। ন্যায়-অন্যায়ের চেতনা থাকত না।
‘আল্লাহ তায়ালা আকাশকে করেছেন সমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন মানদ-। যাতে তোমরা মানদ-ে সীমালঙ্ঘন না করো।’ (সূরা রহমান : ৭-৮)।
এটিই সৃষ্টিজগতের শাশ্বত ব্যবস্থাপনার বিধান, তুমি যদি পাল্লায় কম দাও, আমি তোমার মুনাফা কম করে দেব। তুমি সোজা হলে আমি সোজা, তুমি বাঁকা চললে আমিও বাঁকা।
এরই মধ্যে সুলায়মান (আ.) আটবারের মতো নিজ হাতে মাথার মুকুট ঠিক করলেন। কিন্তু প্রতিবারে মুকুট বাঁকা হয়ে যায়। তিনি বুঝতে পারলেন, কোথাও গোড়ায় গলদ আছে নিশ্চয়ই। মুকুট বাঁকা হওয়ার আসল কারণ তার মনের গহিনে লুকায়িত। তখনই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নিলেন। মনের গহিনে কামনা-বাসনার সবটুকু রেশ মন থেকে ঝেড়ে ফেললেন। দুনিয়ার প্রতি লোভের সব সুতা বিচ্ছিন্ন করলেন। লক্ষ করলেন, মাথার মুকুটটি আপনা-আপনি সোজা হয়ে গেছে। বাতাস তখন বলল, বাদশাহ নামদার! আপনার সঙ্গে দুটি কথা বলার অনুমতি ছিল আমার। আর বেশি কথা বলার, কোনো রহস্য ফাঁস করার অনুমতি নেই। এ সময় মাথার মুকুটের জবান খুলে গেল। 
তা’জ না’তেক গশত কেই শাহ না’য কুন
চোন ফেশা’ন্দী পর যে গেল পরওয়া’য কুন
তাজ বলে, ওহে বাদশাহ! আনন্দিত হোন শুভদিন
হৃদয়ের পালকের কাদা ঝরে গেছে, এবার উড়াল দিন।
আপনি কামনা-বাসনা, দুনিয়ার প্রতি লোভের কাদা ময়লা থেকে মনকে পরিষ্কার করে নিয়েছেন। এবার আপনি ডানা মেলে উড়াল দিতে পারেন ঊর্ধ্ব আকাশপানে, পরম আরাধ্যের সন্নিধানে। আত্মিক উন্নতির এটিই সঠিক পথ। মনকে পরিচ্ছন্ন করতে পারলেই তাতে আত্মার জগতের আলোর ঝলকানি বিচ্ছুরিত হবে। হে সাধক! হে সত্যের সন্ধানী, আল্লাহর সান্নিধ্যের অভিলাষী! জীবন চলার পথে তোমার জন্য নির্দেশনা হলোÑ
পস তোরা’ হার গম কে পীশ আ’য়দ যে দার্দ
বর কেসী তোহমত মনেহ বর খেশ গার্দ
তোমার জীবনে যখন কোনো দুঃখ-দুশ্চিন্তা নেমে আসবে
অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাবে না, খুঁজে দেখবে নিজেকে।
জীবন চলার পথে নানা অসংগতি আসে। পদে পদে হোঁচট খেতে হয়। দুঃখ-দুশ্চিন্তা পর্বতের মতো মাথায় চেপে বসে। ভুলভ্রান্তির শিকার হয়ে মনটা বিষিয়ে ওঠে। তখন সাধারণত মানুষ অন্যের ওপর দোষ চাপায়। বলে, অমুকের কারণে এমনটি হয়েছে। মওলানার উপদেশ হলোÑ বাতাস বাঁকা হয়ে প্রবাহিত হওয়ার কারণে সুলায়মান (আ.) এর মাথার টুপি বাঁকা হয়নি; বরং নিজের ভেতরে কোনো কিছু বাঁকা হয়ে থাকার কারণে সেই বক্রতা বাতাসের রূপ নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। তোমার মনের বক্রতার কারণেই যে নানা বিপত্তি, দুঃখ-দুশ্চিন্তা বিপদাপদ আসছে, তা তুমি দেখতে পাচ্ছ না। উল্টা তোমার ব্যর্থতার দায় অন্যের ওপর চাপাচ্ছ। কাজেই আগে নিজের ভেতরের খোঁজ নাও। দেখ, আল্লাহর সঙ্গে কতখানি ঠিক আছ। নচেৎ তোমার অবস্থা হবে ফেরাউনের মতো। ফেরাউনের দুশমন ছিলেন মুসা (আ.), যিনি তার ঘরে ছেলের আদরে প্রতিপালিত হচ্ছিলেন। অথচ ফেরাউন বাইরের লোকদের দুশমন ভেবে সমানে নিষ্পাপ শিশুদের জবাই করছিল।
তো হাম আয বীরুন বদী বা’ দীগরা’ন
ওয়ান্দারূন খোশ গশতে বা নফসে গেরা’ন
তুমিও বাইরে অন্যদের সঙ্গে মন্দ ঝগড়াটে
অথচ ভেতরে শিকলবন্দি নফসে আম্মারার সঙ্গে।
ওহে নফসের পূজারি! রাস্তায় অলিগলিতে তুমি যাকে দেখ মনে কর সবাই খারাপ, সবাই তোমার দুশমন। অথচ তাদের প্রকৃত অবস্থা তুমি জানো না। তারা কেউ তোমার দুশমন নয়; তুমিই খামখা কতক শত্রু সাজাও নিজের কল্পলোকে। যে তোমার আসল দুশমন, সে তোমার ভেতরে। সেই নফসে আম্মারার সঙ্গে তুমি বন্ধুত্ব পেতে আছ।
খোদ আদুওয়াত ঊস্ত কান্দাশ মী দহী
ওয়ায বুরুন তোহমাত বে হার কাস মী নহী
সে তোমার জানী দুশমনল্প পুষো দুধ কলা দিয়ে
বাইরে যাকে পাও তার ঘাড়ে দাও দোষ চাপিয়ে।
তুমি নিজের অক্ষমতা দুর্বলতা স্বীকার করতে রাজি নও; বরং অন্যদের সমালোচনা করে বেড়াও। ওহে ফেরাউন! আর কতকাল নিরপরাধ মানুষের খুন ঝরাবে আর নিজের কলুষিত গোনাহে জর্জরিত দেহের প্রতিপালন করবে? তুমি চিন্তা করে দেখ, ফেরাউনের জ্ঞানবুদ্ধি-বিচক্ষণতা অন্য রাজা-বাদশাহর চেয়ে কম ছিল না; বরং অনেক বেশি ছিল। কিন্তু তকদিরের ফয়সালা তাকে অন্ধ-অজ্ঞ বানিয়ে রেখেছিল। ফলে ঘরের শত্রু সে দেখতে পায়নি। বাইরের নিষ্পাপ শিশুদের শত্রু ভেবে সমানে জবাই করেছে। এর প্রধান কারণ তকদিরের ফয়সালা। তার মানে আল্লাহর হুকুমই চূড়ান্ত কথা। আল্লাহর নবীর সীমাহীন অবাধ্যতার কারণে ফেরাউনের ব্যাপারে আল্লাহর ফয়সালা চূড়ান্ত হয়েছিল। আল্লাহর হুকুমের মোহর যদি জ্ঞানীর চোখে ও কানে লেগে যায়, প্লেটোর মতো জ্ঞানী হলেও তার রক্ষা নেই, জন্তু-জানোয়ারের মতো নির্বোধ হয়ে যায়। আল্লাহর ফয়সালা কীভাবে আসে মওলানা তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
হুকমে হক বর লওহ মী আ’য়দ পদীদ
আ’নচুনা’নকে হুকমে গেইবে বা’য়েযীদ
আল্লাহর হুকুম লওহের ফলকে হয় উদ্ভাসিত
গায়েবি হুকুম যেমন বায়েজিদের কাছে প্রতিভাত।
গায়েবি হুকুম বা তকদিরের ফয়সালা কীভাবে আসে আর মানুষকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় তার সুন্দর ব্যাখ্যা এ বয়েত অর্থাৎ গায়েবি জগৎ থেকে আল্লাহর হুকুম লওহে মাহফুজে প্রতিফলিত হয়। কম্পিউটারের স্ক্রিনে যা প্রতিফলিত হয় তার উৎস মেমোরি। স্ক্রিনে ক্লিক করলে কাক্সিক্ষত ফাইল-ফোল্ডার ওপেন হয়, সক্রিয় হয়। লওহে মাহফুজের স্ক্রিনও যখন সক্রিয় হয় পৃথিবীতে তার মেমোরিগুলোর হুবহু প্রতিফলন ঘটে। তখন বান্দার ইখতেয়ার বা কর্মের স্বাধীনতা রহিত হয়ে নিয়তির হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হয়।
এ বয়েতে বায়েজিদ বোস্তামী কীভাবে একশ বছর পরে আবুল হাসান খারাকানীর জন্মলাভের আগাম সংবাদ পেলেন, সে রহস্যও জানা গেল। মানুষের অন্তর হলো ছোট্ট স্ক্রিন, আর লওহে মাহফুজ বড় স্ক্রিন। বড় স্ক্রিনের তথ্যগুলো প্রতিফলিত হয় ছোট স্ক্রিনে। স্বপ্নে আমরা অনেক সময় সেই প্রতিফলন দেখতে পাই। ছোট্ট পর্দা অপরিচ্ছন্ন থাকলে প্রতিফলন ঠিকভাবে আসে না। যাদের ছোট পর্দা স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো তারা ঠিকই বড় পর্দার তথ্য ভালোভাবে দেখতে পায়। আবুল হাসান খারাকানীর ব্যাপারে লওহে মাহফুজের সেই তথ্যই প্রতিফলিত হয়েছিল বায়েজিদের কলবের পরিচ্ছন্ন আয়নায়।
আবুল হাসান যখন বড় হলো, দেখা গেল তার অবয়ব স্বভাব ও আচরণ বায়েজিদ বোস্তামীর ভবিষ্যদ্বাণীর হুবহু প্রতিরূপ। আবুল হাসান বললÑ
গোফত মন হাম নীয খা’বশ দীদে আম
ওয়ায রওয়ানে শেখ ইন বেশনীদে আম
বলল আমিও দেখেছি স্বপ্নে মহামতি বায়েজিদকে
শুনেছি এসব কথা মনের কানে তার রুহ থেকে।
নিজাম ছিল, আবুল হাসান প্রতিদিন ফজরের পর চলে যেতেন খারাকান থেকে বোস্তামে বায়েজিদের মাজারে, যার দূরত্ব ছিল আজেকের হিসাবে ২৪ কিলোমিটার। দুপুর নাগাদ সেখানে ইবাদত সাধনায় কাটাতেন।
বা’ মেসা’লে শেখ পীশাশ আ’মাদী
ইয়া কে বী গুফতী শেকা’লশ হল শুদি
শেখের প্রতিরূপ নিয়ে আভির্ভূত হতো সম্মুখে
অথবা বিনা বাক্যব্যয়ে সমস্যার সমাধান হতো।
সেখানে মাঝেমধ্যে বায়েজিদ প্রতিরূপ অবয়ব ধারণ করে তার সামনে আভির্ভূত হতেন। কিংবা বিনা বাক্যব্যয়ে নানা জিজ্ঞাসা ও সমস্যার জট খুলে যেত আবুল হাসানের। বায়েজিদ বোস্তামীর জিয়ারতে গিয়ে এ ধরনের দুটি ঘটনার স্মৃতি এখনও এ লেখকের মনে দ্যুতি ছড়ায়, যার ইঙ্গিত রয়েছে আগের লেখায়।