কবর থেকে উদ্ধার নবজাতকটির অবস্থা ‘গুরুতর’
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৩:১৭ পিএম, ১৬ অক্টোবর ২০১৯ বুধবার
উত্তর ভারতে একটি মাটির পাত্রে জীবিত অবস্থায় কবর দেয়া যে শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়েছে, সে এখন জীবন বাঁচিয়ে রাখার জন্য লড়াই করছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
সেপটিসেমিয়া এবং মারাত্মকভাবে কম প্লেটলেট গণনার কারণে শিশুটি সার্বিক পরিস্থিতি ‘গুরুতর’ বলে জানিয়েছেন শিশু বিশেষজ্ঞ রবি খান্না।
তিনি বলেছেন, ‘তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে, তবে আমরা পাঁচ থেকে সাত দিন পরেই নিশ্চিতভাবে সেটা জানাতে পারব।’
এ বিষয়ে পুলিশ ‘অজ্ঞাত ব্যক্তিদের’ বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছে এবং বলেছে যে তারা এই কন্যা নবজাতকের বাবা-মাকে খুঁজছে।
শিশুটিকে এভাবে কবর দেয়ার পেছনে তারা সম্ভাব্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে এখনও কোন অনুমান করছেন না, তবে লিঙ্গ বৈষম্যের দিক থেকে বিশ্বের মধ্যে ভারতের অবস্থান খুবই খারাপ।
নারীদের প্রায়শই সামাজিকভাবে বৈষম্যের শিকার হন এবং মেয়েদের একটি আর্থিক বোঝা হিসাবে দেখা হয়, বিশেষত দরিদ্র সম্প্রদায়ে।
বারেইলি জেলার সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা আভিনন্দন সিং বলেছেন, শিশুটিকে কবর দেওয়ার পেছনে তিনি শিশুটির বাবা-মায়ের জড়িত থাকার বিষয়ে সন্দেহ করছেন কারণ ‘এই ঘটনাটি ব্যাপক প্রচারিত হওয়ার পরেও কেউই এই শিশুটিকে তাদের সন্তান দাবি করতে এগিয়ে আসেনি’।
গত বৃহস্পতিবার ঘটনাক্রমে নবজাতকের সন্ধান পেয়েছিলেন গ্রামের এক বাসিন্দা। তিনি তাঁর নিজের অপরিপক্ক অবস্থায় জন্ম নেয়া একটি মৃত কন্যা শিশুকে কবর দিতে গিয়ে ওই নবজাতকের সন্ধান পান। হিন্দুরা সাধারণত তাদের মৃতদেহ পুড়িয়ে থাকে করে তবে নবজাতক এবং ছোট শিশুদের প্রায়শই কবর দেওয়া হয়।
সিং বলেন, ‘তারা যখন মাটির নীচে প্রায় ৩ ফুট [৯০ সেন্টিমিটার] পর্যন্ত খনন করছিলেন, তখন তাদের কোদালটি একটি মাটির পাত্রে আঘাত করে এবং সেই আঘাতে পাত্রটি ভেঙে যায় এবং তারা একটি শিশুর কান্নার শব্দ শুনতে পান। যখন তারা পাত্রটি টেনে ওপরে তুলে আনেন তখন এর ভেতরে তারা ওই শিশুটিকে দেখেন।’
শিশুটিকে এরপর স্থানীয় সরকারী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে ভর্তি করা হয়।
হাসপাতালের প্রধান শিশু বিশেষজ্ঞ ডাঃ সৌরভ অঞ্জন বারেইলি বলেন, ‘আমার মনে হয় যখন শিশুটিকে হাসপাতালে আনা হয় তখন তার বয়স প্রায় এক সপ্তাহ ছিল’।
তিনি বলেন, শিশুটি সময়ের আগেই জন্ম নিয়েছিল, সম্ভবত ৩০ সপ্তাহে জন্মগ্রহণ করেছিল শিশুটি এবং তার ওজন মাত্র ১.১ কেজি। যেটা কিনা জন্মের সময়ে শিশুর আদর্শ ওজনের হিসেবে খুব কম।
ডাঃ অঞ্জন বলেছেন যে শিশুটি হাইপোথেরমিকও ছিল অর্থাৎ তার দেহের তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের চেয়ে কম ছিল। এবং হাইপোগ্লাইকেমিয়া ছিল। শিশুটির রক্তে শর্করার পরিমাণ ছিল ৩৫ যেটা কিনা কমপক্ষে ৪৫ হওয়া জরুরি।)
‘শিশুটি খুব ছোট আর দুর্বল ছিলেন, আমরা তাৎক্ষণিকভাবে তাকে অক্সিজেন দিয়েছিলাম এবং হাইপোথার্মিয়ার চিকিৎসাও শুরু করি।’
উন্নততর সুবিধা থাকায় রোববার শিশুটিকে ডাঃ রবি খান্নার পেডিয়াট্রিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
ডাঃ রবি খান্না বলেন, ‘তাকে নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে রাখা হচ্ছে এবং একটি টিউবের মাধ্যমে তরল খাওয়ানো হচ্ছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। তার প্লেটলেট সংখ্যা ১০ হাজারে এ নেমে গেছে যেখানে স্বাভাবিক পরিসীমা দেড় লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ হয়ে থাকে, তাই আমরা তার রক্তে সংক্রমণ নিয়ে উদ্বিগ্ন’।
শিশুটি কতক্ষণ মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিল সে বিষয়ে আলাদা আলাদা অনুমান রয়েছে। তবে চিকিৎসকরা বলছেন যে তারা কেবলমাত্র এটাই বলতে পারবেন যে শিশুটি কীভাবে বেঁচে ছিল।
ডাঃ খান্না বলেন, ‘তিন থেকে চার দিন’ আগে কবর দেওয়া হয়ে থাকতে পারে।
‘শিশুটি এতদিন তার ব্রাউন ফ্যাটের কারণে বেঁচে আছে। বাচ্চারা তাদের পেটে, উরু এবং গালে ফ্যাট নিয়ে জন্মায় এবং কিছুটা জরুরি অবস্থায় তারা এটার উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু সেই শক্তি ফুরিয়ে যাওয়ার পর শিশুটির শরীর কুঁকড়ে যেতে থাকে- আপনি তার ছবিতে দেখতে পাচ্ছেন,’ তিনি বলেন।
তবে ডাঃ অঞ্জনের ধারণা তার চেয়ে কিছুটা আলাদা।
তিনি বিশ্বাস করেন যে তাকে উদ্ধারের কেবল ‘দুই থেকে তিন ঘণ্টা’ আগে সমাধিস্থ করা হয়েছিল এবং যদি তাকে উদ্ধার না করা হতো তবে সম্ভবত আরও এক বা দুই ঘণ্টার জন্য বেঁচে থাকতে পারতো।
তিনি বলেন যে, ‘পাত্রটির ভিতরে শিশুটিকে রাখা হয়েছিল সেখানে একটি বাতাসের পকেট ছিল যা তাকে অক্সিজেন সরবরাহ করেছে। অথবা কিছু অক্সিজেন হয়তো আলগা হয়ে যাওয়া মাটির ভেতর দিয়ে ফিল্টার হয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছে। যেহেতু পাত্রটি ঘন মাটির তৈরি না। তাই এটিও বাতাস চলাচলে সহায়তা করতে পারে।’
স্থানীয় রাজ্য নেতা রাজেশ কুমার মিশ্র, ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) থেকে বলেছেন যে তিনি বাচ্চাটিকে ‘দত্তক’ নিয়েছেন এবং একবার যদি শিশুটি ভাল হয়ে ওঠে, তবে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী শিশুটিকে নিজ বাড়িতে বড় করবেন।
‘এটি একটি অলৌকিক ঘটনা যে সে বেঁচে আছে, আমি বিশ্বাস করি যে ঈশ্বর তাঁর জীবন বাঁচিয়েছেন এবং তাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। এখন আমাদের জন্য তার সমস্ত কিছু করা কর্তব্য। শিশুটি জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে দুলছে। একবার সে সুস্থ হয়ে উঠলে আমি তাকে বাড়িতে নিয়ে আসবো এবং তাকে আমার মেয়ে হিসাবে বড় করবো,’ তিনি বলেন।
মিশ্রা একটি হিন্দু দেবীর নাম অনুসারে কন্যা শিশুটির নাম রেখেছেন সীতা।
জনপ্রিয় পৌরাণিক কাহিনী রামায়ণ অনুসারে, রাজা জনক যখন একটি জমি চাষ করছিলেন তখন সীতাকে তিনি খুঁজে পান।
তিনি বলেন, ‘আমি বাচ্চাটির খোঁজ নিতে দিনে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে যাই। আজ বিকেলে যখন আমি আমার স্ত্রীর সাথে তাকে দেখতে গিয়েছিলাম, তখন আমি তার নামটি ডাকলাম এবং সে চোখ খুলল, প্রসারিত করে আমার দিকে তাকাল।
শিশুটিকে কারা এভাবে ফেলে গিয়েছিল সে বিষয়ে এখনও তদন্ত চলছে। পুলিশ বলছে যে তারা সন্দেহ করেছে যে তার বাবা-মা দাফনের ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে।
ভারতে বাচ্চা মেয়েদের ফেলে দেয়া এবং হত্যার বিষয়টি অস্বাভাবিক নয় - কন্যাদের তুলনায় পুত্রদের একটি ঐতিহ্যগত অগ্রাধিকার রয়েছে। সেখানে একটি বহুল প্রচলিত বিশ্বাস হল যে কোন ছেলে পরিবারের নাম এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং তাদের বৃদ্ধ বয়সে তার বাবা-মাকে দেখাশোনা করবে।
অথচ বিয়ের পর স্বামীর সাথে থাকার জন্য মেয়ের পরিবারকে যৌতুক বাবদ খরচ করতে হয়।
বেআইনি লিঙ্গ নির্ধারণকারী ক্লিনিকগুলোর সহায়তায় বেশিরভাগ অনাকাঙ্ক্ষিত কন্যা শিশুর ভ্রূণ গর্ভপাত করা, অনেক সময় কন্যা শিশু জন্মের পর পর সেটাকে হত্যা করার ঘটনাও ভারতে অস্বাভাবিক নয়।
এ কারণে দেশটিতে লিঙ্গ অনুপাতে বিপজ্জনক ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে।
মিশ্রা বলেন, আমি জানি না এই শিশুটির আপন বাবা-মা'র এমন কী বাধ্যবাধকতা ছিল যে তারা এই শিশুটিকে পরিত্যাগ করেছে এবং তাকে কবর দিয়েছে, আমি কেবল এটুকুই বলতে পারি যে তারা যা করেছে তা ঠিক না।
‘আমি তার সুস্থতা ও দীর্ঘজীবনের জন্য প্রার্থনা করছি। আমি বিশ্বাস করি পুরো বিশ্ব তার বেঁচে থাকার জন্য, তার সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রার্থনা করছে।’