শুক্রবার   ০১ নভেম্বর ২০২৪   কার্তিক ১৭ ১৪৩১   ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

রুপালি গিটার ফেলে চলে যাওয়ার এক বছর

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৯:০৮ এএম, ১৮ অক্টোবর ২০১৯ শুক্রবার

চিরতরে ঘুমিয়ে আছেন ব্যান্ডসঙ্গীতের কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চু। গত বছরের ১৮ অক্টোবর সকালে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে অকাল প্রয়াণ হয় এই কিংবদন্তির। তার রুপালি গিটার ফেলে বহুদূরে চলে গেলেও ভক্তরা তাকে অনুভবে হৃদয়ে হৃদয়ে চেতনায় ধারণ করে আছেন। তাদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার কাছে তন্দ্রা আজ অসহায়!

কিশোর বয়সেই প্রেমে পড়েছিলেন গিটারের, এই সুরযন্ত্রের সঙ্গে বেঁধেছিলেন মনপ্রাণ। তার গিটারের অপূর্ব মূর্ছনা ও কণ্ঠের জাদু মাতিয়ে রাখত সঙ্গীতপ্রেমীদের। অপূর্ব কণ্ঠে তিনি গেয়েছিলেন- এই রুপালি গিটার ফেলে/একদিন চলে যাব দূরে, বহুদূরে/সেদিন অশ্রু তুমি রেখো/গোপন করে। প্রিয় রুপালি গিটার ফেলে সত্যিই আজ অনেক দূরে গিটারের জাদুকর আইয়ুব বাচ্চু। 

 

গত বছরের ১৬ অক্টোবর রাতে রংপুরে একটি কনসার্ট শেষ করে ১৭ অক্টোবর দুপুরে ঢাকায় ফিরেন আইয়ুব বাচ্চু। ১৮ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বাসায় হার্ট অ্যাটাক করেন তিনি। তড়িঘড়ি তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটের দিকে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

 

 

আইয়ুব বাচ্চু’র মৃত্যুর খবরে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে ১৯ অক্টোবর শুক্রবার দুপুর সাড়ে দশটায় ব্যান্ড সঙ্গীতের এক অভিধান আইয়ুব বাচ্চু’র মরদেহ সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে রাখা হয়। তাকে চিরবিদায় জানাতে উপচে পড়া মানুষের লাইন জাতীয় শহীদ মিনার পার হয়ে চানখারপুলের মোড়ে গিয়ে ঠেকেছিল! তাকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা ও এক নজর দেখার জন্য। রাজনৈতিক নেতা, সঙ্গীতশিল্পী, অভিনয়শিল্পী, নির্মাতা কিংবা তার ভক্ত অনুরাগী- সবাই ছুটে এসেছিলেন।

এরপর জাতীয় ঈদগাহ মাঠে বাদ জুমা প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। আইয়ুব বাচ্চু’র দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত শুক্রবার বিকেল ৩টার দিকে রাজধানীর মগবাজারের কাজী অফিস গলির মসজিদের সামনে। এই গলিতে আইয়ুব বাচ্চু’র যে স্টুডিও ছিল সেই ভবনের সামনে তার মরদেহ রাখা হয়। তারপর তৃতীয় জানাজার জন্য আইয়ুব বাচ্চু’র মরদেহ তেজগাঁওয়ের চ্যানেল আইয়ের ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। চ্যানেল আইয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে আইয়ুব বাচ্চু’র মরদেহ আবারো স্কয়ার হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়।

 

১৯ অক্টোবর শুক্রবার রাতে অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা থেকে দেশে আইয়ুব বাচ্চু’র মেয়ে ফাইরুজ সাফরা আইয়ুব ও ছেলে আহনাফ তাজোয়ার আইয়ুব দেশে ফিরেন। ২০ অক্টোবর শনিবার সকালে তার মরদেহ নেয়া হয় তার শৈশব কাটানো চট্টগ্রামের এনায়েত বাজারে। এই এনায়েত বাজারেই তার জন্ম আর বেড়ে ওঠা। সেখানে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা ও শেষ জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশে দুপুরে সমাহিত করা হয় বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের কিংবদন্তি, গিটারের জাদুকর আইয়ুব বাচ্চু’কে।

 

 

দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যান্ড এলআরবির দলনেতা আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন একাধারে গায়ক, গিটারিস্ট, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক। গিটারের জাদুকর হিসেবে আলাদা সুনাম ছিল তার। ভক্তদের কাছে তিনি ‘এবি’ নামেও পরিচিত। আইয়ুব বাচ্চু’র নিজের একটি স্টুডিও আছে। ঢাকার মগবাজারে অবস্থিত এই মিউজিক স্টুডিওটির নাম ‘এবি কিচেন’।

১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রাম শহরে জন্মগ্রহণ করেন আইয়ুব বাচ্চু। ছোটবেলা থেকেই গিটার বাজাতে ভালোবাসতেন, গান গাইতে ভালোবাসতেন। তবে ব্যান্ডের সঙ্গে তার যাত্রা শুরু ১৯৭৮ সালে ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডের মাধ্যমে। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালে তিনি ‘সোলস’ ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম অ্যালবাম ‘রক্তগোলাপ’ প্রকাশ হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। তার সফলতার শুরু দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ‘ময়না’ (১৯৮৮) দিয়ে। এরপর ১৯৯১ সালে বাচ্চু ‘এলআরবি’ ব্যান্ড গঠন করেন। এই ব্যান্ডের সঙ্গে তার প্রথম ব্যান্ড অ্যালবাম ‘এলআরবি’ প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। এই অ্যালবামের ‘শেষ চিঠি কেমন এমন চিঠি’, ‘ঘুম ভাঙ্গা শহরে’, ‘হকার’ গানগুলো জনপ্রিয়তা পায়।

 

১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে তার জনপ্রিয় অ্যালবাম ‘সুখ’ ও ‘তবুও’ বের হয়। ‘সুখ’ অ্যালবামের ‘সুখ’, ‘চলো বদলে যাই’, ‘রুপালি গিটার’, ‘গতকাল রাতে’ আলোড়ন তৈরি করে। এর মধ্যে ‘চলো বদলে যাই’ গানটি বাংলা সংগীতের ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় গান। গানটির কথা লিখেছেন ও সুর করেছেন বাচ্চু নিজেই। ১৯৯৫ সালে তিনি বের করেন অ্যালবাম ‘কষ্ট’। সর্বকালের সেরা একক অ্যালবামের একটি বলে অভিহিত করা হয় এটিকে। এই অ্যালবামের প্রায় সব গানই জনপ্রিয়তা পায়। অ্যালবামের ‘কষ্ট কাকে বলে’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘অবাক হৃদয়’, ও ‘আমিও মানুষ’। একই বছরে ‘ঘুমন্ত শহরে’ প্রকাশিত হয়। সেটিও সাফল্য পায়। আইয়ুব বাচ্চুর সর্বশেষ তথা দশম অ্যালবাম ‘জীবনের গল্প’ প্রকাশ হয় ২০১৫ সালে।

শুধু অডিও গানে নয়, প্লেব্যাকেও তিনি জনপ্রিয়তা পান। তার গাওয়া প্রথম প্লেব্যাক ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’ বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় গান। এ ছাড়া ‘আম্মাজান’ ছবির শিরোনাম গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।

আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া জনপ্রিয় গানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। এর মধ্যে ‘চলো বদলে যাই’, ‘রুপালি গিটার’, ‘ফেরারি মন’, ‘বাংলাদেশ’, ‘উড়াল দেব আকাশে’, ‘ঘুমভাঙা শহর’, ‘আসলে কেউ সুখী নয়’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘হাসতে দেখো’, ‘নীল বেদনা’, ‘মাধবী’, ‘আমি তো প্রেমে পড়িনি’, ‘এক আকাশের তারা তুই’, ‘মন চাইলে মন পাবে’ অন্যতম। আইয়ুব বাচ্চু তার যেকোনো কনসার্ট শেষ করতেন গিটারে জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ সুর তুলে। সেই রুপালি গিটারের সুর ও তার গান দীর্ঘদিন মানুষের মুখে মুখে ফিরবে।