বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১   ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লিবিয়া এখনো মৃত্যুকূপ

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০১:৫৯ এএম, ১৪ নভেম্বর ২০২২ সোমবার

নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায় চলছেই, তবু অবৈধ ইউরোপযাত্রার ঢল

 মুন্সীগঞ্জ সদরের নুরুজ্জামান রাজু। উন্নত জীবনের আশায় ইতালির উদ্দেশে দেশ ছাড়েন আট মাস আগে। এ সময়ে তিনি ঢাকা থেকে দুবাই-মিসর হয়ে পৌঁছান লিবিয়া। লিবিয়া গিয়েই শুরু হয় তার জীবনের দুর্বিষহ অধ্যায়। শুরু নির্যাতন। ধাপে ধাপে টাকা দিয়েও বাঁচতে পারছেন না নির্যাতন থেকে। তার পরিবারের কাছে পাঠানো হয় নির্যাতনের ভিডিও। মুক্তিপণ আদায়ের জন্য ভিডিও কলে মারধর করে দেখানো হচ্ছে পরিবারকে। দাবি দুই দিনের মধ্যে দিতে হবে ১০ লাখ টাকা। ইতোমধ্যেই অবৈধ এই ইতালি যাত্রায় প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ করা রাজুর পরিবার নতুন এই মুক্তিপণের দাবি নিয়ে দিশাহারা।

রাজুর বন্ধু সুমন খান জানান,  মাদারীপুরের মোয়াজ্জেম নামের এক দালালের মাধ্যমে গত মার্চ মাসে লিবিয়ার উদ্দেশে রওনা হন রাজু। দালাল মোয়াজ্জেমের সঙ্গে সাড়ে ৪ লাখ টাকায় চুক্তিই ছিল লিবিয়া পর্যন্ত পৌঁছানোর। সে হিসেবে ভিজিট ভিসায় দুবাই ও মিসর নেওয়া হয় বিমানে। পরে লিবিয়া গিয়ে আরেক বাংলাদেশি দালালের সঙ্গে চুক্তি হয় ইতালি পৌঁছে দেওয়ার। ৫ লাখ টাকা চুক্তিতে অগ্রিম দেওয়া হয় ২ লাখ টাকা। কিন্তু অগ্রিম নেওয়ার পর যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় সেই দালাল। পাওয়া যায় না খোঁজাখুঁজি করেও। পরে ইতালি প্রবাসী দালাল বেলাল মিয়ার সঙ্গে হয় নতুন চুক্তি। আগের মতোই ৫ লাখ টাকা চুক্তি হয় লিবিয়া থেকে ইতালি পৌঁছানোর। অগ্রিম হিসেবে বাংলাদেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও বিকাশে দেওয়া হয় ৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। ইতালি থেকে বেলালের নিযুক্ত দালাল শরীফ রাজুসহ অন্যদের দেখভাল করার দায়িত্বে ছিল। কিন্তু এর মধ্যে ত্রিপোলির কাছেই মিজদাহ শহরে অপর এক গ্রুপ রাজুসহ দুজনকে জিম্মি করে। শনিবার রাজুর পরিবারের কাছে পাঠানো হয় নির্যাতনের ভিডিও। দাবি করা হয় ১০ লাখ টাকা। ভিডিওতে জিম্মিকারীদের বাংলায় কথা বলতে শোনা যায় এবং টাকা নিতে বাংলাদেশেরই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে, মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলার ফয়সাল ঢালী ছয় মাস ধরে লিবিয়ায় আছেন। ভালো কাজের কথা বলে তাকে লিবিয়া পাঠায় দালাল। ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকার চুক্তিতে লিবিয়ায় হাসপাতালে চাকরির কথা বলা হয়েছিল ফয়সালকে। থাকা-খাওয়া সব নিয়োগকর্তার এবং মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতনের প্রলোভন দেওয়া হয়েছিল তাকে। কিন্তু লিবিয়ায় যাওয়ার পর দেখা যায় বাস্তবতা ভিন্ন। ফয়সাল  বলেন, লিবিয়া আসার পর ৫ মাস ধরে কোনো কাজ দেওয়া হয়নি। যে হাসপাতালের কথা বলা হয়েছিল, সে হাসপাতালেও নেওয়া হয়নি। বেতন তো দূরের কথা, থাকা-খাওয়া নিয়েও সংকট। দুই বেলা খাবার জোটে না। এখানে কাজের পরিবেশ নেই। আমি দেশে ফিরতে চাই। দালালের কাছে পাসপোর্ট থাকায় দেশেও ফিরতে পারছি না। জানা যায়, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধপথে ইউরোপ যাত্রায় লিবিয়া এখনো মৃত্যুকূপ। মানব পাচারের চারণভূমিতে পরিণত হওয়া লিবিয়ায় বাংলাদেশিদের অকথ্য নির্যাতনের শিকার হতে হয়। নির্যাতন থেকে বাঁচতে দেশে থাকা ভিটামাটি ও পরিবারের শেষ সম্বল বেচে দিয়ে দিতে হয় মুক্তিপণ। নানান চেষ্টা সত্ত্বেও ইউরোপ যেতে ভূমধ্যসাগরে বাংলাদেশিদের মরণযাত্রা থামছেই না। দিন যাচ্ছে আর স্বপ্নে বিভোর যুবকদের ভিড়ও বাড়ছে লিবিয়ায়। বাংলাদেশের সরকারি সংস্থাগুলোর ধারণা, অবৈধপথে সাগর পাড়ি দিয়ে লিবিয়ায় যাওয়ায় জন্য ১০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি এখন লিবিয়ার বিভিন্ন শহরে অবস্থান করছেন। স্থানীয় পুলিশ ও কোস্টগার্ডের অভিযানে লিবিয়ায় প্রায় প্রতিদিনই আটকও হচ্ছে বাংলাদেশিরা। সাগর থেকে উদ্ধারও হচ্ছে নিয়মিত। খাটতে হচ্ছে জেল। আবার জীবনবাজি রেখে এই পথে গিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে অনেকে। বেঁচে থাকা অনেককে ফিরতে হচ্ছে নিঃস্ব রিক্ত হয়ে। কিন্তু তবুও ইউরোপের হাতছানি থেকে ফেরানো যাচ্ছে না বাংলাদেশিদের।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সর্বোচ্চ মৃত্যুর দেশের তালিকায় ১১তম স্থানে আছে বাংলাদেশ। ২০২১ সাল থেকে ইউরোপমুখী যাত্রায় এবং ইউরোপের ভিতরে অন্তত ৫ হাজার ৬৮৪ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত অবৈধভাবে ইউরোপে অভিবাসনের সময় ২৯ হাজারেরও বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আইওএম জানায়, ২০১৪ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ইউরোপে যাওয়ার পথে এবং ইউরোপের মধ্যে মৃত্যুবরণকারী ১৭ হাজারেরও বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী কোন দেশের, তা নির্ধারণ করা যায়নি। এর ফলে ইউরোপের পথে রওনা হয়ে নিখোঁজ হওয়া ওই ১৭ হাজারেরও বেশি ব্যক্তির পরিবার নিশ্চিতভাবে কোনো তথ্য পাবে না।-বাংলাদেশ প্রতিদিন