ফিলিস্তিনিরা কেন ইসরাইলের সরকারবিরোধী বিক্ষোভে নাই?
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০৪:৫০ এএম, ১৭ এপ্রিল ২০২৩ সোমবার
যে কোনো সমাজে সংখ্যালঘু দুর্বল অংশ আন্দোলন বা প্রতিবাদের সুযোগ পেলে সামনে এগিয়ে যায়। তাদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন সমাজের অংশ কখনো তাদের পক্ষে থাকে। তবে দুর্বল সংখ্যালঘুরা শেষ পর্যন্ত সুবিধাবঞ্চিতই থেকে যায়। হঠাত্ দানা বেঁধে যে কোনো আন্দোলন তারা নিজেদের কণ্ঠ উঁচু করার সুযোগ হিসেবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের সাধারণ মানুষ সম্প্রতি সরকারবিরোধী বিক্ষোভে রাস্তায় নামতে শুরু করেছে। ঐ দেশটিতে সাধারণভাবে এটি একটি বিরল ঘটনা। তারপরও সেখানকার ফিলিস্তিনদের এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মাঠে নামতে দেখা যায়নি।
ইসরাইল একটি ঘোষিত ইহুদি রাষ্ট্র। সেখানে বসবাসরত সংখ্যালঘু অইহুদিদের অবস্থা কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। জনসংখ্যার ২০ ভাগ ফিলিস্তিনি আরব। তারা যে নানাভাবে অধিকার বঞ্চিত সেটা নতুন খবর নয়। ঘটনা হলো—সম্প্রতি বিক্ষোভে তাদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ছে না। বিচার বিভাগের সংস্কার ও দেশে গণতন্ত্র রক্ষার দাবিতে সাধারণ ইসরাইলিরা রাজপথে নেমেছে। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন উগ্র ডানপন্থি কোয়ালিশন সরকার চেষ্টা করছে সুপ্রিম কোর্টের ওপর প্রভাব বিস্তার করার। এরই অংশ হিসেবে সর্বোচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষমতা পেতে চাইছে। পার্লামেন্টে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েও এই কাজটি করার উদ্যোগ নেওয়ার পর বর্তমান সংকট শুরু হয়। দেশটির সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন সময়ে অধিকৃত পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনের উদ্যোগ আটকে দিয়েছে। এ ঘটনার পর সাধারণ ইসরাইলিরা প্রতিবাদমুখর হয়ে রাজপথে নেমেছে। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা এই প্রতিবাদে অংশ নেয়নি। প্রশ্ন হলো ইসরাইলি সুপ্রিম কোর্ট সময় সময় ফিলিস্তিনদের পক্ষে রায় দিলেও ফিলিস্তিনিরা প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে গলা মেলায়নি কেন? এর একটি কারণ সম্ভবত এটাই যে যদিও সুপ্রিম কোর্ট অবৈধ বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে কিন্তু ঐ কোর্ট মূলত ইসরাইলিদেরই স্বার্থ করে থাকে, ফিলিস্তিনদের নয়।
ইসরাইলি প্রতিবাদকারীদের অভিযোগ, নেতানিয়াহু পার্লামেন্টকে ব্যবহার করে বিচারব্যবস্থার ওপর হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছেন। তারা যখন বিক্ষোভ করছে ফিলিস্তিনিরা তখন পালন করছে ভূমি দিবস। ইসরাইলি ফিলিস্তিনদের অনেকের জায়গা দখল করে সেগুলো দেশটির পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে বণ্টন করা হয়েছিল। এরই প্রতিবাদে তারা ১৯৭৬ সালের ৩০ মার্চ বিক্ষোভ করে। এতে ছয় ফিলিস্তিনি নিহত ও শতাধিক আহত হয়। সেই থেকে দিনটিকে তারা ভূমি দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। সম্প্রতি এই বিক্ষোভ ইসরাইলের সীমান্ত ছাড়িয়ে আশপাশের ফিলিস্তিনি নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ২০১৮ সালে গাজা ও পশ্চিম তীরেও বিক্ষোভ হয়। এরপর মার্চ এলেই দেশটির প্রতিরক্ষা বিভাগ স্নাইপার নিযুক্ত করে ফিলিস্তিনি প্রতিবাদকারীদের ওপর গুলি ছোড়ার জন্য। ভূমি দিবসকেন্দ্রিক বিক্ষোভে এ পর্যন্ত দুই শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত ও স্নাইপারের গুলিতে অনেকে অঙ্গহানির শিকার হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট কখনোই ফিলিস্তিনদের রক্ষা বা আক্রমণকারীদের বিচারের আওতায় আনার কথা বলেনি। বরং কোর্ট হত্যাকারীদের পাশেই দাঁড়িয়েছে। ফিলিস্তিনিরা জানে তারা ইসরাইলের নাগরিক হোক বা নাহোক সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে যাওয়া মানে মৃত্যুদণ্ড ডেকে আনা। তাই তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই আদালতের সম্মান রক্ষায় দাঁড়াতে ইচ্ছুক নয়, যেটা তাদের ওপর আক্রমণকারীদের হাতকেই শক্তিশালী করে থাকে। মাত্র এক সপ্তাহ আগেই আল আকসা মসজিদে ফিলিস্তিনদের রমজান মাসের রাত্রিকালীন নামাজ আদায়ের সময় ইসরাইলি পুলিশ নির্মম হামলা করেছে। ৫০ জনের ওপর ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে। অথচ সরকার বিরোধী ইসরাইলি বিক্ষোভকারীদের প্রতি পুলিশ বলতে গেলে কোনো কঠোরতাই দেখায়নি।
নেতানিয়াহুর সরকার সুপ্রিম কোর্টের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে সংবিধানে একটি ধারা সংযোজনের চেষ্টা করছে। ১৯৪৮ সাল থেকে বলবৎ সংবিধানে এমন কোনো ধারা নেই। এ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এর সংবিধানে সব নাগরিকের জন্য সমতার কোনো বিধান ছিল না। তবে ১৯৯২ সালে মানবিক মর্যাদার মৌলিক বিধান বিষয়ক একটি আইন পাশ হয়েছে। কিন্তু সেটি করা হয়েছে রাষ্ট্রের ইহুদি চরিত্র অক্ষুণ্ণ রেখেই। বিষয়টি নিয়ে ফিলিস্তিনি ও অইহুদি বিভিন্ন গ্রুপ আদালতের দ্বারস্থ হলেও সুবিচার পায়নি।