শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১   ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দেশের রাজনীতি নিয়ে প্রবাসে এ কী হচ্ছে!

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ১২:১২ এএম, ১৩ মে ২০২৩ শনিবার


   
মন্তব্য প্রতিবেদন :
নিজ বাসভূমি থেকে প্রায় দশ হাজার মাইল দূরত্বের এই আমেরিকায় আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশিরা দেশের রাজনীতি নিয়ে এ কী কান্ড করছেন? দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি’র নামে বিভক্ত দুটি পক্ষ মূলত এখানে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশি কমিউনিটিকেই বিভাজিত  করে ফেলেছেন। দেশের মায়া ত্যাগ করে এই প্রবাসে চলে আসা মানুষদের যেখানে সুখে-দুখে একসাথে থাকার কথা সেখানে তারা এখন লিপ্ত পারস্পরিক কোন্দলে। এ কোন্দল দুঃখজনকভাবে এখন আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে রূপ নিয়েছে হানাহানিতে, সহিংসতায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি ওয়াশিংটন ডিসিতে ঘটে যাওয়া সংঘর্ষের ঘটনা এই বাস্তবতাকেই তুলে ধরেছে। বাংলাদেশি কমিউনিটির গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষই এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে আমেরিকার মাটিতে কেন আমাদের হানাহানিতে লিপ্ত হতে হবে? রাজধানী ওয়াশিংটনের প্রকাশ্য রাজপথে দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে পরস্পরের ওপর হামলা, পানির বোতল ছুঁড়ে মারা, কিল-ঘুষি এমনকি হাতের লাঠি দিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর চড়াও হওয়া এবং পরিণামে পুলিশের ধমক, গ্রেফতার এবং গাড়ির সঙ্গে চেপে ধরে হাতকড়া পরানো ইত্যাদি সব ঘটনা কি কোন সভ্য জাতির জন্য শোভা পায়? এই সব ঘটনা আমাদের ভাবমূর্তিকে কোথায় নামিয়ে দিয়েছে সে বোধ কি তাদের আদৌ আছে?
বলতে দ্বিধা নেই, এই বোধের পরিচয় দিতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। শান্তিপ্রিয় ও পরিশ্রমী কমিউনিটি হিসাবে নিজেদের যে ইমেজ বাংলাদেশিরা দিনে দিনে গড়ে তুলেছে তাকে নস্যাৎ করে দিতে তারা সামান্যতম কুন্ঠিত হননি। আমেরিকার মাটিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে-বিপক্ষে সমাবেশ বা বিক্ষোভ করে আসলে তাদের কোন স্বার্থ হাসিল হচ্ছে তাও সকলের কাছে বোধগম্য নয়। দেশের রাজনীতিতে এদের এই কর্মকান্ডের মূল্যায়ন কিভাবে হচ্ছে, দলীয় হাই কমান্ডের কাছে প্রবাসীদের এই রাজনৈতিক তৎপরতা কতটা সমাদৃত হচ্ছে সে সম্পর্কে কমিউনিটি সম্যক ওয়াকিবহাল নয়।
দেশের রাজনীতিতে দলগুলির সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন তা হলো ভোট। প্রবাসীদের ভোটাধিকার নেই। সে দিক দিয়ে তাদের সমর্থন বা বিরোধিতার কোন মূল্য থাকার কথা নয়। তার পরও কেন তারা এই দূর দেশে বাস করে পক্ষে-বিপক্ষে এমন হানাহানি করেন?
ইতোপূর্বে আমরা লক্ষ্য করেছি দেশের রাজনৈতিক নেতারা আমেরিকা সফরে এসে দলীয় নেতা-কর্মীদের নসিহত করতেন এদেশের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে। এদেশের রাজনীতিতে অংশ নিয়ে বাংলাদেশি কমিউনিটির কল্যাণে অবদান রাখতে। এ নসিহত এখনকার রাজনীতিকদের মুখে শোনা যায় না। এখনকার রাজনীতিকরা এদেশে এসে কর্মীসভায় সংবর্ধনা নেন এবং দেশের রাজনীতি নিয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা করে উত্তাপ ছড়িয়ে দেন। সেই উত্তাপে উজ্জ¦ীবিত হয়ে কর্মী সাধারণ আরো দ্বিগুন উত্তেজনায় রাস্তায় নেমে আসেন। স্বীকার করতেই হবে, এই কর্মীরা নিবেদিতপ্রাণ। দলের জন্য, দলের নেতা-নেত্রীদের পক্ষে তারা জান কবুল করে দিতেও পিছপা হন না। তারাই জঙ্গী মনোভাব নিয়ে রাস্তায় নামছেন, দল এবং নেতা-নেত্রীর পক্ষে গলা ফাটাচ্ছেন এবং প্রয়োজনে সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছেন।
আমেরিকায় আশ্রয় নেয়া অন্য আর কোন দেশের মানুষ কি নিজ দেশের রাজনীতি নিয়ে এখানে হানাহানি করছেন? আর কোন দেশের অভিবাসীরা কি এ দেশে বসে নিজেদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলির শাখা গঠন করছেন? রাজনৈতিক উত্তাপ তো কম-বেশি সব দেশেই রয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশি প্রায় সবগুলি দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা তো নানা রাজনৈতিক ইস্যুতে টগবগ করছে। এ সব দেশের হাজার হাজার মানুষ এদেশে বসবাস করছেন। তাদের রাজনীতি সচেতনতা, নিজ মাতৃভূমির প্রতি তাদের ভালবাসা বাংলাদেশিদের চাইতে নিশ্চয় কোন অংশে কম নয়। কিন্তু তারা কি কেউ নিজের দেশের রাজনীতি নিয়ে এখানে মাতামাতি করছেন? ‘দেশ উদ্ধারের’ যত দায় শুধু প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য এমন ‘ফরজ’ হয়ে উঠল কেন?      
প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফরের সংবাদ সংগ্রহে গণমাধ্যমের যারা ওয়াশিংটনে গিয়েছিলেন নিউইয়র্কে ফিরে আসার পর সাধারণ অভিবাসী থেকে শুরু করে সবাই তাদের কাছে শুধু বাংলাদেশিদের মারামারি-হাতাহাতির কথাই জানতে চাইছেন। কেউ একটিবারের জন্যও জানতে চাননি, যে বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতুতে অর্থায়ন বাতিল করেছিল বিশ্ব আর্থিক খাতের মোড়ল সেই সংস্থাটি থেকে বাংলাদেশ কিভাবে সর্বোচ্চ পরিমাণ ঋণ আদায় করে নিল!  
এই সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে কার কি স্বার্থ হাসিল হচ্ছে তা আজ এক বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে কমিউনিটির সামনে। এ নিয়ে যে যার মতো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছেন। কমিউনিটি বিশ্বাস করে  প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে রাস্তায় অবস্থান নেয়ার পরিণামে অনেকেরই ভাগ্য ফিরে যাচ্ছে। বিশেষ করে গুটিকয়েক নেতা এখান থেকে ঠিকই স্বার্থ হাসিল করে নিচ্ছেন। নিউইয়র্কের বাংলা সাপ্তাহিকগুলি নানাভাবে এ ব্যাপারে আভাস দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সরকারি দলের যারা রাস্তায় নেমেছিলেন তারা অনেক ক্ষেত্রেই নানা সুবিধার অধিকারী, বিশেষ করে দলের নেতৃবৃন্দ। এই নেতৃবৃন্দের মধ্যে কেউ কেউ ব্যাংকের মালিকানা পেয়েছেন, কেউ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের। একটি সাপ্তাহিকে লেখা হয়েছে শেখ হাসিনার পক্ষে রাস্তায় অবস্থান নেয়ার কারণে ‘বিশাল পুরস্কার’ পেতে চলেছেন একজন শীর্ষ নেতা। দলের আরো যারা আছেন তারাও সুবিধাভোগী নয়ত সুবিধার আশায়।
আর বিরোধী পক্ষে যারা হানাহানিতে জড়িয়েছেন, পত্রিকার ভাষায়, তারা নাকি তাদের ‘কৃতিত্বের’ সেলফি তুলে লন্ডন-ঢাকায় পাঠিয়েছেন। তারা আশায় আছেন ভাগ্যে কিছু জোটার। আশায় আছেন দলীয় নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হওয়ার, দল ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে আরো বড় কিছু প্রাপ্তির! প্রসঙ্গত আরো একটি বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য। নামে গণতান্ত্রিক হলেও এই প্রবাসের কোন রাজনৈতিক দলের শাখা কমিটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয় না। ঢাকা বা লন্ডন থেকে তাদের কমিটি ‘নাজেল’ হয়। সেখান থেকেই যাদেরকে নেতা বানিয়ে দেয়া হয় তারাই এই সব সংগঠনের নেতৃত্ব দেন।   
নির্দ্বিধায় বলা যায়, দেশীয় রাজনীতির নামে কিছু মানুষের এইসব ব্যক্তিগত স্বার্থে জলাঞ্জলি যাচ্ছে বাংলাদেশি কমিউনিটির মান-মর্যাদা, নস্যাৎ হচ্ছে তাদের ভাবমূর্তি।
সার্বিক পরিস্থিতিতে বরাবরের মতো আবারও তাদের প্রতি কমিউনিটি আহ্বান, বন্ধ করুন বিদেশের মাটিতে দেশের রাজনীতি নিয়ে দলবাজি, বন্ধ করুন সংঘাত-সংঘর্ষ, হানাহানি। অংশ নিন এ দেশের রাজনীতিতে। এগিয়ে আসুন কমিউনিটির কল্যাণে।