শেখ হাসিনাকে চায় না যুক্তরাষ্ট্র!
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:২৭ এএম, ২০ মে ২০২৩ শনিবার
ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের
বাড়তি নিরাপত্তা প্রত্যাহার
মন্তব্য প্রতিবেদন
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় না তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থাকেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নানা ধরনের তৎপরতার বিষয়টি কিছুটা অস্পষ্ট থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে আর কোনো রাখ-ঢাক রইল না। শেখ হাসিনার বক্তব্যেই বাংলাদেশ নিয়ে জো বাইডেন প্রশাসনের অবস্থান এখন পরিস্কার হয়ে গেল। কিন্তু প্রশ্ন, আমেরিকা না চাইলে কিভাবে বহাল তবিয়তে আছে হাসিনা সরকার? এদিকে, ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের বাড়তি নিরাপত্তা প্রত্যাহার করে কী বার্তা দিতে চাইছে বাংলাদেশ? এ নিয়ে রাজনৈতিক মহল এখন সরব।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো তাকে ক্ষমতায় চায় না বলেই বাংলাদেশের বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তিনি দাবি করেছেন, বাংলাদেশে গত ১৪ বছর ধরে গণতন্ত্র অব্যাহত থাকায় দেশে অসাধারণ উন্নয়ন হয়েছে।
শেখ হাসিনা তাঁর সাম্প্রতিক যুক্তরাজ্য সফরের সময় বিবিসির ইয়ালদা হাকিমের সাথে একটি একান্ত সাক্ষাৎকার দেন। প্রায় আধঘণ্টা ধরে চলা ওই সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে অভিযোগ, বিচার বহির্ভূত হত্যা, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, গণতন্ত্র এবং রোহিঙ্গা ইস্যুসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার পক্ষ থেকে বাংলাদেশে অটোক্রেসি বা একনায়কতন্ত্র ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে বলে যে অভিযোগ করা হয়, সেটি নাকচ করে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘গত ১৪ বছর ধরেই শুধুমাত্র দেশে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রয়েছে, তাই আমরা উন্নতি করতে পারছি।’
বিবিসির ইয়ালদা হাকিমের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আলাপচারিতায় দীর্ঘক্ষণ কথা হয়েছে র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে। বিবিসি প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র কেন বাংলাদেশের একটি বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বলে তিনি মনে করেন?
এই প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যে বাহিনীর ওপর তারা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেটা যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শেই ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাদের সকল প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছিল। যেভাবে তারা বাহিনীটাকে তৈরি করেছে, তারা তো সেভাবেই কাজ করছে বলে আমার বিশ্বাস। তাহলে কেন তারা এই নিষেধাজ্ঞা দিল? এটা আমার কাছেও বিরাট এক প্রশ্ন।’
শেখ হাসিনার কাছে বিসিবি জানতে চায়, তাহলে কেন তারা এটা করেছে বলে তিনি মনে করেন? তিনি বলেন, ‘আমি জানি না, হয়তো তারা আমার কাজ অব্যাহত থাকুক তা চায় না, আমি বাংলাদেশের জন্য যেসব উন্নতি করেছি, সেটা তারা হয়তো গ্রহণ করতে পারছে না। এটা আমার অনুভূতি। একটা পর্যায়ে সন্ত্রাস সব দেশের জন্য সমস্যা হয়ে উঠেছিল। আমাদের দেশে আমরা সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করেছি। এরপর মাত্র একটা ঘটনা ঘটেছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে কঠোর পরিশ্রম করেছে।’
এদিকে তার ৪২তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অপালোচনা সভায় দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেছেন, তাকে নিয়ে দেশি-বিদেশি গভীর ষড়যন্ত্র চলছে।
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত এই আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা নস্যাৎ করে দিতে দেশি-বিদেশি গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলাদেশের বর্তমান অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখাই হবে আমাদের মূল প্রচেষ্টা। কেউ যাতে জনগণের ভাগ্য নিয়ে আর ছিনিমিনি খেলতে না পারে সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে, নজর দিতে হবে। তিনি বলেন, সৎ উদ্দেশ্যে কাজ করলে যেকোনো জায়গাতেই সফলতা নিয়ে আসা সম্ভব হয়, সেটা মেনেই আমি কাজ করি। দেশের মানুষের উন্নত জীবন নিশ্চিত করাই আমার বড় লক্ষ্য।
শেখ হাসিনা বলেন, ভোটের অধিকার আর গণতন্ত্র কবে ছিল এই দেশে? ‘৭৫ এর পর তো ভোট চুরির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। বরং বিভিন্ন সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচনকে গণমুখী করে মানুষকে ভোটাধিকারের বিষয়ে সচেতন করতে কাজ করেছে কেবল আওয়ামী লীগ। তিনি বলেন, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স থেকে ছবিসহ নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও ন্যাশনাল আইডি কার্ড, সবই তো আওয়ামী লীগের মাধ্যমেই হয়েছে। তারপরও কেউ যদি আমাদের ভোটাধিকার আর গণতন্ত্রের ছবক দিতে আসে তাদের বিষয়ে আসলে কিছুই বলার নাই আর।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বেশ কিছুদিন যাবত আমেরিকার সমালোচনায় সরব রয়েছেন। শেখ হাসিনা যেভাবে ক্রমাগত আমেরিকার কঠোর সমালোচনা করছেন, তাতে রাজনৈতিক মহল বিস্মিত হচ্ছেন। প্রকাশ্যে এই সমালোচনার সূত্রপাত হয়েছিল এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সংসদের বিশেষ অধিবেশনে ভাষণ দেবার সময়। সর্বশেষ লন্ডনে বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারেও তিনি আমেরিকার সমালোচনা করতে পিছ-পা হননি।
আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধারাবাহিক সমালোচনা দেশে-বিদেশে অনেকের মাঝে ব্যাপক কৌতুহল তৈরি করেছে। আমেরিকার বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার প্রকাশ্য এবং সরাসরি সমালোচনার বেশ কয়েকমাস আগে থেকেই আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল যে দুই দেশের মধ্যে হয়তো কিছু ‘অস্বস্তি’ তৈরি হয়েছে। তবে সর্বশেষ বিসিবি’র সাথে সাক্ষাৎকারে এটি দিনের আলোর মতই পরিস্কার হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বর্তমান সরকারের এই টানাপোড়েন শুরু হয় ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে, যখন বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাব ও তার কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আমেরিকা।
শেখ হাসিনা আমেরিকার সমালোচনায় মুখর হবার আগেও ক্ষমতাসীন দলের কিছু সিনিয়র নেতাদের বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছিল।
ঢাকার নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের নানা তৎপরতা নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মাঝে অসন্তুষ্টি তৈরি হয়েছিল আগেই। মি. হাস যখন নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল হক সুমনের ঢাকার শাহীনবাগের বাসায় যান তখন ক্ষোভ চেপে রাখেননি আওয়ামী লীগ নেতারা।
এই ক্ষোভের কারণ মূলত দুটি। র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আর নির্বাচন ঘিরে চাপ। এই দুটো বিষয় মূলত বাংলাদেশ সরকারকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। এমনটাই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। যদিও নির্বাচন নিয়ে চাপ থাকার বিষয়টি সরকার কিংবা আওয়ামী লীগের নেতারা কখনোই স্বীকার করেননি। কিন্তু শেখ হাসিনার কথায় এখন এটিও পরিস্কার।
ক্ষোভের প্রধান কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন। সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বারবার তাগাদা দিচ্ছে আমেরিকা। এর বড় কারণ হচ্ছে, ২০১৪ সাল এবং ২০১৮ সালের বিতর্কিত সাধারণ নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে জোরালো সমালোচনা রয়েছে।
গত কয়েক মাসে আমেরিকা এবং বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে যতগুলো বৈঠক হয়েছে তার প্রায় সবকটিতে আমেরিকার তরফ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করা হয়েছে।
এপ্রিল মাসের ১০ তারিখে ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের যখন বৈঠক হয়, সেখানে বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি প্রভৃতি বিষয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে বিশেষ তাগিদ দেয়া হয়। মি. ব্লিঙ্কেন সে বৈঠকে বেশ পরিষ্কার করেই বলেছেন, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের দিকে আমেরিকা এবং পুরো বিশ্ব তাকিয়ে আছে।
এমন পরিস্থিতিতে গেল সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের বাড়তি নিরাপত্তা প্রত্যাহার করে নেয়ার সেই উত্তাপে ডে অনেকটা ঘি ঢালা হয়েছে তা স্পষ্ট। তবে এই আগুন বিস্তৃত হবে নাকি নিভে যাবে তা হয়তো এ বছরের শেষ নাগাদ বোঝা যাবে। ইতোমধ্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকা খবর দিয়েছে, সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ভারতকে পাশে চায় বাংলাদেশ। আগামী সেপ্টেম্বরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হবে জি-২০ শীর্ষ বৈঠক। বাংলাদেশ এই ফোরামে না থাকলেও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একমাত্র দেশ হিসেবে এই বৈঠকে পর্যবেক্ষক হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছে। এতে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি যাচ্ছেন। এরআগে জুনে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয় সফরে যুক্তরাষ্ট্র আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। অনেকেই এই সফরের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মেরুকরণের বিষয়টি খুঁজছেন। তাদের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রের চোখ রাঙানির উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর অবস্থান ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থনেই হচ্ছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত দুই দেশের সরকার প্রধান ও দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বাংলাদেশের প্রসঙ্গ উঠলে তা অবাক হওয়ার মতো কিছু হবে না। কেননা, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের সাথে সবচেয়ে ভাল সম্পর্ক ভারতের। দেশটি হয়তো এই সম্পর্ক আরও কিছুদিন জিইয়ে রাখতে চাইবে।
প্রসঙ্গত, এ বছরের শেষে কিংবা আগামী বছরের শুরুতে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলাতে সেই নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সে দিকেই এখন দৃষ্টি সবার।