মুখোমুখি বাইডেন-হাসিনা
জিতবে কে?
সাপ্তাহিক আজকাল
প্রকাশিত : ০২:৩৮ এএম, ২৭ মে ২০২৩ শনিবার
মাসুদ করিম, ঢাকা থেকে
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আগাম নিষেধাজ্ঞার মতো চ্যালেঞ্জ কিভাবে মোকাবিলা করবে সরকার? বাংলাদেশের ভবিষ্যতই-বা কোন পথে? নির্বাচন কি আদৌ হবে, হলে বর্তমান সরকারের অধীনেই কি তা হবে? আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে হলে অংশ নেবে বিএনপি? বিচারবিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ভূমিকা কি হবে? যুক্তরাষ্ট্রের এই হুঁশিয়ারির তোয়াক্কা না করলে পরবর্তী ব্যবস্থা কি নেবে দেশটি? এমন হাজারো প্রশ্ন এখন দেশে-প্রবাসে মানুষের মুখে মুখে।
যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ ভিসা নীতি ঘোষণা করায় বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন মহল রীতিমত হতভম্ব। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বাধা দিলে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দেবে না। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, বিচার বিভাগের সদস্য কিংবা যে কেউ ভিসা বিধি-নিষেধের টার্গেট। আফ্রিকার ভঙ্গুর রাষ্ট্র সোমালিয়া কিংবা নাইজেরিয়ার কাতারে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে বাইডেন প্রশাসন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এমন অ্যাকশন নজিরবিহীন।
বাংলাদেশে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা রাজনীতির মাঠ আরেক দফা ঝাঁকুনি খেল। মুখোমুখি হাসিনা সরকার ও বাইডেন প্রশাসন। মুখোমুখি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী বিএনপি। সুষ্ঠু নির্বাচনের আশায় দেশে-বিদেশে যে খেলা শুরু হয়েছে তাতে কে জিতবে, তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
এমন এক ঘোলাটে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রেণে তৎপর বেসামরিক প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা। এসবের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে চলছে ভোটের প্রস্তুতি। পর্দার আড়ালে সক্রিয় বিদেশিরা। ব্লিঙ্কেনের ভিসা নীতি ঘোষণার পর বিএনপিসহ বিরোধী শিবিরে কিছুটা চাঙ্গা ভাব লক্ষ্য করা গেলেও সতর্ক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশকে ভিসা বিধি-নিষেধের আওতাভুক্ত করে গণতন্ত্রের শিক্ষা দেয়া সত্যি অভিনব। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বাধাদান মানে সভা-সমাবেশে বাধাদান, ভোটদানে হুমকি দিয়ে বিরত রাখা কিংবা মিডিয়া ও সুশীল সমাজকে ভয়ভীতি প্রদর্শনকেও বোঝানো হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার নমনীয় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। বৃহস্পতিবার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস রাজনীতিবিদের সঙ্গে বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। মোমেনের কথায় অসন্তোষের সুর। তিনি হাসকে জিজ্ঞাসা করেন, ভিসা বিধি-নিষেধ দিয়ে বিশ্বের কোনও দেশে গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনে কোনও কাজে লেগেছে? হাসের জবাব, না। বিষয়টা এখনও পরীক্ষামূলক। সোমালিয়ায় দেয়া হয়েছে। নাইজেরিয়ায় দেয়া হয়েছে। এবার বাংলাদেশে পরীক্ষা চলবে। হাস বলছেন, বাংলাদেশের জনগণ, সরকার, সকলের স্বার্থে এই নতুন নীতি করা হয়েছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পরিস্থিতিতে নাটকীয়তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কৌতুহলী সবাই। কী ঘটতে যাচ্ছে! সবার মুখে মুখে একটাই প্রশ্ন। যদিও অঘটন কিছু ঘটেনি এখনও। তবুও চারপাশে গুমোট অবস্থা। বিএনপি’র সাফ কথা, শেখ হাসিনার অধীনে কোনও নির্বাচনে যাবে না।
সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি কোনও প্রার্থী দেয়নি। বিএনপি নেতারা অনেকে ছুটছেন লন্ডনে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছ থেকে সরাসরি বার্তা পাওয়ার জন্যে। সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীও গিয়েছিলেন। সিলেটে মেয়র পদে তিনি দাঁড়ালেই বিজয় নিশ্চিত এমন অনুরোধেও অনড় তারেক রহমান। শেষ পর্যন্ত কান্না বিজড়িত কন্ঠে আরিফ ঘোষণা দিলেন, তিনি নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন না।
আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করতে যাচ্ছে। কারণ, সরকার বিএনপি’র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানতে নারাজ। নির্বাচনকালে জাতীয় সরকার গঠনের কথা রাজনৈতিক মহলে আলোচনা হচ্ছে। তবে সরকারের তরফে স্পষ্ট বলা হচ্ছে, সংবিধানের বাইরে যাওয়া মোটেও সম্ভব নয়। নির্বাচনকালে সরকার প্রধান শেখ হাসিনাই থাকবেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান আগেই বাতিল হয়েছে। নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতীয় সংসদে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা নির্বাচনকালীন সরকারে থাকতে পারেন। বিএনপি সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছে আগেই। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের অর্থ দাঁড়ায়, বিএনপি’র অন্তবর্তী সরকারে থাকার সুযোগ নেই। তাছাড়া, বিএনপি নেতারা বলছেন, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনকালীন সরকারে যাওয়ার তাদের কোনও ইচ্ছাও নেই।
ভোটের আগে সরকারবিরোধী আন্দোলন অনিবার্য। কর্মসূচিও দিচ্ছে বিএনপি। আওয়ামী লীগের কঠোর হুঁশিয়ারি। বিএনপি’কে মাঠেই ঠেকানো হবে। বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে মামলা, ধর-পাকড় শুরু হয়েছে। এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণা গোটা পরিস্থিতিকে ওলট-পালট করে দিয়েছে। বিএনপি’র পক্ষেও সরকার বিরোধী আন্দোলন করে নির্বাচন ঠেকানো সম্ভব নয়। কারণ ভোটে বাধা দিলে ভিসা বিধি-নিষেধের আওতায় পড়তে হবে। এই যখন অবস্থা তখন তত্ত্ববধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে বিএনপি কতটা আন্দোলন করতে পারবে। আপাত দৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই অনেকটা তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব কাধে তুলে নিয়ে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড করার চেষ্টা করছে।
যুক্তরাষ্ট্র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলছে না। বাইডেন প্রশাসন চায় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। ফলে শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে বিএনপি’র নেতৃত্বে বিরোধী দল অংশ নেবে বলে মনে হচ্ছে। আর বিএনপি যদি লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড পায় তবে সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জটা অনেক বড়। যদিও শেখ হাসিনা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকার করেছেন। অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, এমন নির্বাচন করতে হবে যা গোটা বিশ্ব তাকিয়ে দেখবে। শেখ হাসিনা আগেই বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র তাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। যুক্তরাষ্ট্র স্যাংশন দিলে দেশটি থেকে বাংলাদেশ পণ্য কিনবে না বলে হুঁশিয়ার করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তিকেও হিসাবে ধরছেন না তিনি। ২০১৪ সালে বিএনপিবিহীন নির্বাচনের সময়েও যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। ২০১৮ সালে বিএনপি অংশ নিলেও আসন পায়নি খুব বেশি। তাই ওই নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
আন্দোলনের নামে সহিংসতার সুযোগ কমে যাচ্ছে। আপাতত তাই মনে হচ্ছে বিএনপি নির্বাচনে যোগ দিতে পারে। যদি আন্তর্জাতিক মহলের নিবিড় নজরদারির মধ্যে ভোট হয়। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে, আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি যে দলই বিরোধী দলে যাক; তারা যেন শক্তিশালী বিরোধী দল হয়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে বাইডেন প্রশাসনের দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় এখন শেখ হাসিনার প্রধানতম মিত্র ভারত। বিএনপি ক্ষমতায় আসা মানে হলো পাকিস্তানপন্থী জামায়াতে ইসলামীরও ক্ষমতার মসনদে বসা। তাছাড়া, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমাতে শেখ হাসিনার সহায়তা ছাড়া সফল হওয়া মোটেও সম্ভব নয়। এসব কারণে ভারত এবারও শেখ হাসিনার সঙ্গে থাকবে। সেপ্টেম্বরে জি-২০ সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে স্বাগতিক ভারত।
অভ্যন্তরীণ শক্তি সমূহ, আমলা, পুলিশ কিংবা অন্যদের ভোটে ভূমিকা ভিসা নীতির পর কীভাবে প্রতিপালন হবে সেটা এখন দেখার বিষয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র অনেক রাজনীতিক, আমলা, পুলিশ কিংবা অন্যদের সন্তান যুক্তরাষ্ট্রে থাকে। ওই সব সন্তানদের পিতা-মাতার ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ হলে সন্তানদের ভিসা বাতিল হবে। ফলে কেউ কারও কথায় অতিউৎসাহী হয়ে এক্সপোজড নাও হতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার কিছু কিছু প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা খুবই খারাপ। জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি সংকট মোকাবেলায় অনেক দেশের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রতি জোর দিচ্ছে বাংলাদেশ। এই মূহূর্তে বাংলাদেশ দৃশ্যত নতুন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। বিদেশিরা এখানে ক্রীড়নকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। তবে নির্বাচন না হওয়ার কোনও আশঙ্কা এখনও দেখা যাচ্ছে না। সংবিধানের আওতায় শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হওয়ার কথা। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রসহ কারও কোনও আপত্তি নেই। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার বিষয়টি তত্ত্বাবধান ও পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব আন্তর্জাতিক মহলের কাছে দেওয়া হলে সরকার ও বিরোধী দল উভয়ের আপত্তি না থাকার সম্ভাবনা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সময় খুব বেশি নেই। আন্দোলন করে সরকার হটানোর মতো শক্তি ও সময় এই মূহূর্তে বিএনপির হাতে নেই। ফলে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মহলের গ্যারান্টির মাধ্যমে নির্বাচনমুখী হতে পারে দলটি। যদিও পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ সবাই নিবিড় পর্যবেক্ষণ করবে বলেই মনে হচ্ছে।