শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১   ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নতুন ভিসা নীতির প্রেক্ষাপট-উদ্দেশ্য

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:৪৩ এএম, ২৭ মে ২০২৩ শনিবার

বিশিষ্টজনদের লেখা রাজনৈতিক ধারাভাষ্য

 
ড. আলী রীয়াজ
বাংলাদেশের নাগরিকদের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার যে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে তার উদ্দেশ্য বিষয়ে কোনও ধরনের অস্পষ্টতা নেই; বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে সহযোগিতা করা এবং বাংলাদেশে যারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট আছে তাঁদের প্রতি সমর্থন জানানোই এই নীতির লক্ষ্য। এই নতুন নীতির আওতায় বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে যারা বাধাগ্রস্থ করবে যুক্তরাষ্ট্র তাঁদেরকে ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারবে। নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ করার সুস্পষ্ট তালিকা দেয়া হয়েছে এবং কারা এর আওতায় আসবেন সেটাও বলা হয়েছে।
যেটা লক্ষ্য করার বিষয় তা হচ্ছে বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র গত প্রায় দেড় বছর ধরেই তার অবস্থান জানিয়ে আসছিল। ২০২২-২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কমপক্ষে ৮ জন কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করেছেন যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় এবং গণমাধ্যমের সামনে করা মন্তব্যে যা বলেছেন তাতে এটাই বোঝা গেছে যে, বাংলাদেশ সরকারের দেয়া প্রতিশ্রুতি তাদেরকে আশ্বস্ত করতে সক্ষম হয়নি। এর কারণ তিনটি- প্রথমত গত দুটি নির্বাচন, বিশেষ করে ২০১৮ সালের নির্বাচন; দ্বিতীয়ত গত কয়েক বছরে বিরোধী দল এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের সঙ্গে সরকারের আচরণ এবং তৃতীয়ত গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় দেশে স্থানীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো। এই বিষয়গুলোর প্রেক্ষাপটে এই বছরের মার্চে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম এ মোমেনের সঙ্গে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন সুস্পষ্টভাবেই বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের নির্বাচনের দিকে সারা বিশ্বের দৃষ্টি আছে। মে মাসে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অনুষ্ঠিত পার্টনারশিপ ডায়লগে নির্বাচনের বিষয়টিই প্রাধান্য পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ভিসা নীতির এটা একটি প্রেক্ষাপট।
এই কারণগুলোর বাইরেও যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থানের পেছনে আছে বাংলাদেশের সরকারের গৃহীত অভ্যন্তরীণ এবং পররাষ্ট্রনীতি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নীতির মধ্যে সাম্প্রতিককালে প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইন বা ডাটা প্রটেকশন অ্যাক্ট (ডিপিএ) বাংলাদেশে মার্কিন কোম্পানীগুলোর বিনিয়োগের জন্যে একটা হুমকি বলেই বিবেচিত হচ্ছে। সরকারের এই ধরনের আইন করার উদ্দেশ্য যে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দেয়া সেটা কেবল যুক্তরাষ্ট্রই নয়, যে কেউই বুঝতে পারেন। দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা যে ধরনের ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বা স্বজনতোষী পুঁজিবাদের সৃষ্টি করেছে তা উন্মুক্ত, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বাণিজ্যের ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিহীন। এক ধরনের জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা, তাতে এমনকি যদি বর্তমান ক্ষমতাসীনরাও থাকেন, এই ধরনের ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত থাকবে বলেই আশা করা যায়।  
পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান সখ্য। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এ যোগ দেয়। চীনের বিআরআই বিভিন্ন দেশে কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়ন সহযোগিতার কাঠামোই নয়, এটি হচ্ছে বিভিন্ন দেশে চীনের প্রভাব বলয় বিস্তারের একটি হাতিয়ারও। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সহযোগিতা এবং সখ্য যে কেবল অর্থনৈতিক সহযোগিতার মধ্যে সীমাবদ্ধই নেই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে ২০২১ সালে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং এই বলে হুশিয়ারি দিয়েছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের ‘কোয়াড’ (কোয়াড্রিলেটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ)-এ যোগ দিলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ‘যথেষ্ট খারাপ হবে’। এই সম্পর্কের মাত্রা যে ক্রমেই বাড়ছে তার উদাহরণ হচ্ছে গত পাঁচ মাসে চীনের দুইজন শীর্ষ পররাষ্ট্র বিষয়ক কর্মকর্তা বাংলাদেশে সফর করেছেন এবং তৃতীয় জন শুক্রবার বাংলাদেশ যাচ্ছেন। এই দুইজন শীর্ষ কর্মকর্তার বাংলাদেশ সফরের সময় লক্ষণীয়। জানুয়ারিতে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর বাংলাদেশ সফরের ঠিক আগেভাগে ঢাকায় যাত্রাবিরতি করেছিলেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন গ্যাং;  এপ্রিল মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ওয়াশিংটন যাওয়ার ঠিক এক দিন আগে ঢাকায় এসেছিলেন মিয়ানমার বিষয়ক চীনের বিশেষ দূত দেং সিজুন এবং শুক্রবার চীনের ভাইস মিনিস্টার সুন ওয়েইডং ঢাকা যাবেন। এগুলো দুই দেশের মধ্যে এক ধরনের রাজনৈতিক সম্পর্কেরই ইঙ্গিত দেয়। দক্ষিণ এশিয়া এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের প্রেক্ষাপটে এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের অস্বস্তি আছে। তদুপরি চীনের বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগে (গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ-জিডিআই) যোগ দেবার কথা বাংলাদেশ বিবেচনা করছে বলেও শোনা যাচ্ছে। বিপরীতক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজির ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া উৎসাহব্যঞ্জক বলে মনে হয়নি। ভূ-রাজনীতির এই সব বিবেচনা এই নতুন নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রেখেছে সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
এই নীতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থান সম্ভব হতো না যদি না জো বাইডেন প্রশাসন গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারকে তাঁর পররাষ্ট্র নীতির প্রধান ফোকাস বলে না বিবেচনা করতেন। এই প্রশাসন তাঁর মেয়াদের গোড়া থেকেই বলে আসছে যে তাঁরা বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের প্রশ্নকে প্রায়োরিটি দেবে। এই লক্ষ্যেই দুটি গণতন্ত্র সামিট (শীর্ষ বৈঠক) আয়োজিত হয়েছে। বাইডেন প্রশাসন এই ব্যাপারে যে সব পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলো সবই পারফেক্ট বা নিখুঁত নয়, কিন্তু বৈশ্বিকভাবে যে আদর্শিক লড়াই সেখানে যুক্তরাষ্ট্র সকলের অংশগ্রহণমূলক, অংশীদারিত্বের এবং জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থার পক্ষেই দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতিকে সেভাবেই বিবেচনা করতে হবে।
বাংলাদেশের এক্ষেত্রে এই নীতি বিষয়ক আলোচনার সময় আমদের এই ধারণা করা ঠিক হবে না যে যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসা নীতিই বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের নিশ্চয়তা বিধান করবে। বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের নিশ্চয়তা বিধান সম্ভব হবে যখন বাংলাদেশের নাগরিকদের মনে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয় যে এমন শাসন কাঠামো আছে যেখানে মন্ত্রিসভা থেকে স্থানীয় প্রশাসন সকলের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা গেছে। এই ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব হবে বাংলাদেশের ভেতরে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, এর কোনও বিকল্প নেই।
লেখক: ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, রাজনীতি ও সরকার বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি।