বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১   ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সরকার বিরোধীদল সবাই বলছে খোশ আমদেদ

সাপ্তাহিক আজকাল

প্রকাশিত : ০২:৪৫ এএম, ২৭ মে ২০২৩ শনিবার


 
ড. মোস্তফা সারওয়ার
সাধারণ বাংলাদেশিদের ভিসা প্রাপ্তির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতির কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না। ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট ব্লিঙ্কেন এই আশ্বাস দিয়েছেন। বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্তকারী ও তাদের পরিবারবর্গকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা প্রদান করা হবে না। ব্লিঙ্কেন টুইট করে এই সিদ্ধান্তর কথা জানিয়েছেন। পরে স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইটে এই ঘোষণাটি প্রকাশ করা হয়।
বিস্ময়ের ব্যাপার হল-প্রধানমন্ত্রীকে এই সিদ্ধান্তটি জানানো হয় ৩ মে যখন তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফরে ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশে এই ঘোষণাটি গোপন রাখা হয়েছিল। তিন সপ্তাহ পরে যুক্তরাষ্ট্র এটাকে ফাঁস করে দিল।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যে কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপে সক্ষম হবে।’ নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার চারটি বিষয়ের উপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছেন: ১. ভোট কারচুপি, ২. ভোটারদের ভয় দেখানো, ৩. শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও সংগঠিত হবার অধিকারকে সহিংসতার মাধ্যমে খর্ব করা, এবং ৪. ভোটার, গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দল অথবা সুশীল সমাজের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা প্রদান।   
নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত কারা করতে পারেন তারও একটি ফিরিস্তি ব্লিঙ্কেন দিয়েছেন। বর্তমান ও সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা বা কর্মচারি, সরকার সমর্থক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন সম্ভাব্য বাধাগ্রস্তকারী হিসেবে।
সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণীয় হলো অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশের সরকার ও বিরোধী দল উভয়কেই সম্ভাব্য বাধাগ্রস্তকারীদের তালিকায় রেখেছেন। এই ঘোষণাটি প্রকাশের কয়েক ঘণ্টা পর যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডনাল্ড লু চ্যানেল আই’র তৃতীয় মাত্রার অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের কোনো দল যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে না এবং বন্ধু হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক স্বার্থেই এই নতুন ভিসা নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।  
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে এই ঘোষণার পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা নিষেধাজ্ঞা নয়। বিএনপির উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত, তারা নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের সময় যে সহিংসতা চালিয়েছে, সেটার জন্যও ভিসা বিধিনিষেধ আসতে পারে। আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। তাই এই ভিসা নীতিতে সরকারের উদ্বেগের কিছু নেই।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘তারা বলেছে নির্বাচনে বাধা দিলে ভিসা নয়। আমাদেরও এটা কথা, এই নির্বাচনে যারা বাধা দেবে তাদের অবশ্যই প্রতিহত করব।’
বিডিনিউজ২৪.কম এর রিপোর্ট মোতাবেক, বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতিকে ইতিবাচকভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসা নীতিকে সাধুবাদ দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, সরকার এবং বিরোধী দল বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতির বিরোধিতা থেকে সাবধানে পথ চলার দিকে ঝুঁকছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রমাণ করেছে যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের ভিত্তি দারুণ মজবুত। পৃথিবীর কোন প্রক্রিয়া অথবা পদ্ধতি একশত পার্সেন্ট নিখুঁত হতে পারে না। এই ধারণা মনে রেখেও বলা যাবে যে, যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল ক্ষমতায় থেকে আপ্রাণ চেষ্টা করেও ডোনাল্ড ট্রাম্প পরিবর্তন করতে পারেনি। ট্রাম্প মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছে তার নিজের দলের নির্বাচনী কর্মকর্তা এবং তার দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারকদের বিরুদ্ধে। এমনকি অভ্যুত্থানের চেষ্টাও করা হয়েছিল। কিন্তু গণতন্ত্রের বিজয় ঠেকাতে পারেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চাইছেন, বিশ্বের সকল দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মত গণতন্ত্রের সুফল ভোগ করুক। সব দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। সব দেশে বেজে উঠুক গণতন্ত্রের বিজয় ডঙ্কা। একই কারণে ১৫ মে যুক্তরাষ্ট্র নাইজেরিয়ার জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। নাইজেরিয়ায় নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্তকারীদেরও ভিসা দেয়া হবে না।
ভিসা পাওয়া অধিকার নয়। এটা একটা বিশেষ ধরনের সুবিধা। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে নয়। বরং জনগণের অধিকার আদায়ের পক্ষের নীতি মালা। তাই আব্দুল মোমেন, শাহরিয়ার আলম ও ওবায়দুল কাদের এর বিপক্ষে ঘোষণা দেয়নি। অবস্থা দেখে-শুনে মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি সুষ্ঠু নির্বাচনে সহায়তা করবে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও সেক্রেটারি অব স্টেট ব্লিঙ্কেনকে জানাচ্ছি সাধুবাদ। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সদা বিভক্ত সরকার ও বিরোধী দল যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতির প্রতি খোশ আমদেদ জানাচ্ছে, এটা সত্যিই এক বিস্ময়কর ঘটনা। মনে পড়ল, দ্বিজেন্দ্রনাথ রায়ের নাটক ‘চন্দ্রগুপ্ত’। আলেকজান্ডার ভারত উপমহাদেশের মানুষের বিচিত্র চরিত্র এর পরিচয় পেয়ে হয়েছিলেন বিস্মিত। সেনাপতি সেলুকাসকে বলেছিলেন, ‘সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!’ আমাদের জন্য হয়ত অপেক্ষা করে আছে জানা-অজানা বিস্ময়ের অবগুণ্ঠনে কুয়াশাচ্ছন্ন এ বছরের দ্বিতীয়ার্ধ।  
লেখক: এমেরিটাস অধ্যাপক এবং সাবেক উপ-উপাচায, ইউনিভার্সিটি অব নিউ অরলিয়েন্স।